(বোলপুর স্টেশন, শান্তিনিকেতন, রাত ৯:৪৮। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে শিয়ালদহগামী দার্জিলিং মেলে যাত্রীদের ওঠার হিড়িক পড়েছে। মালদা স্টেশনেই ট্রেন অর্ধেক খালি হয়ে গেছিল। একেবারে ফাঁকা দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় একা বসেছিলেন ডাকসাঁইটে অভিনেত্রী ষাট ছোঁয়া গিরিবালা দেবী, কাগজ পড়ছিলেন। মঞ্চের দাপুটে নমস্য অভিনেত্রী গিরিবালা আজকাল অবসর নিয়েছেন, তবে নিজের দল গান্ধর্ব থিয়েটারের পরিচালকমণ্ডলীর অবৈতনিক উপদেষ্টা হিসেবে মঞ্চনাটককে নিয়মিত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। গান্ধর্ব থিয়েটারে তিনি পরম শ্রদ্ধাভাজন, তাঁর আত্মজীবনী নিয়ে 'গিরিবালা' নামে একটি নাটকও খুব শীঘ্র তারা মঞ্চস্থ করার আয়োজন করছে।
কামরার প্রশান্ত নির্জনতায় ছেদ পড়লো। কালো, ভারী একটি স্যুটকেস হাতে প্রবেশ করলেন বছর সাতান্নর এক মহিলা; পরনে মেটেরঙা সুতি শাড়ি, ধূসরের মাঝে মাঝে পেকে আসা চুল, মোটা ফ্রেমের চশমা, গালে-কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। শৌখিন অফ-হোয়াইট জামদানি, সোনালী ফ্রেমের চশমা আর স্টেপ করে কাটা চুলের স্নিগ্ধ অভিজাত গিরিবালার পাশে তাঁকে নিতান্তই দীনহীন মনে হচ্ছিল।
স্যুটকেসের ভারী আওয়াজে গিরিবালা মুখ তুলে চাইলেন। ভদ্রমহিলা উল্টোদিকের সিটে বসতেই চোখ থেকে কাগজ সরিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। আজ এত বছর পরও চিনতে তাঁর অসুবিধে হলো না; মুখের ভাঁজ, ধূসর চুল ছাপিয়ে গিরিবালার সামনে ফুটে উঠেছে লবঙ্গ। এ সেই লবঙ্গ, গান্ধর্ব থিয়েটারের ওপর প্রতিশোধ নিতে গিরিবালার প্রাক্তন স্বামী গোপীনাথ শীল যাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন; এ সেই লবঙ্গ, স্বামীর মুখে যার উপচেপড়া প্রশংসা শুনে গিরিবালা ঈর্ষায় কাতর হয়ে ভাবতেন, থিয়েটারের এই 'মেয়েমানুষের' থেকে তিনি কোন অংশে কম। আজ চুয়াল্লিশ বছর পরও থিয়েটারের প্রাক্তন অভিনেত্রী লবঙ্গকে চিনতে ভুল করলেন না তিনি, কারণ একদা বঞ্চিত, ঈর্ষান্বিত স্ত্রী গিরিবালা স্বামীকে লুকিয়ে থিয়েটার দেখতে গিয়ে বিশ্লেষণ করতেন লবঙ্গের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অব্দি খুঁটিনাটি।)
গিরিবালা : আপনি কী লবঙ্গ দেবী?
(বাঙ্কে স্যুটকেস তুলতে ব্যস্ত লবঙ্গ গিরিবালাকে খেয়াল করেননি। এবারে নাম শুনে চমকে তাকালেন-)
লবঙ্গ : (বিস্ময়াহত) আপনি গিরিবালা দেবী না!
গিরিবালা : (একটু হেসে) ঠিক ধরেছেন। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
লবঙ্গ : জোড়াসাঁকোয়। কিন্তু, আপনি চিনলেন কী করে? আমি তো হারিয়ে গেছি চুয়াল্লিশ বছর হলো। আর গোপীনাথ…
গিরিবালা : (সচকিত) গোপীনাথ?
লবঙ্গ : সেও মারা গেছে আজ ছ'বছর হলো। তার মৃত্যুর পর থেকে আমি বৃদ্ধাশ্রমে। একটি ছেলে আছে, ব্যাঙ্গালোরে সংসার পেতেছে, মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে মায়ের প্রতি তার কর্তব্য পালন করে।
(করুণ হাসলেন লবঙ্গদেবী)
গিরিবালা : I am really sorry.
লবঙ্গ : গিরিবালাদেবী, জানেন, মৃত্যুর আট মাস আগে গোপীনাথের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার আগ পর্যন্ত সে শুধু আপনার নাম করতো।
(গিরিবালা মুখ নিচু করে বসেছিলেন। এবার মুখ তুলে লবঙ্গের দিকে চাইলেন)
লবঙ্গ : আপনার মনে আছে, গোপীনাথ প্রথম যেদিন আপনাকে স্টেজে দেখে প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে "গিরিবালা, গিরিবালা" বলে ডাকছিল আর চিৎকার করছিল, "ওকে খুন করবো"? সেদিন মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে পুরো ঘরে ভাঙচুর করেছিল, আমায় লাথি মেরে ফেলে দিয়ে শুধু বারবার বলছিল, "গিরিবালা...ওকে আমি খুন করবো!"
গিরিবালা : আর?
লবঙ্গ : তারপর থেকেই সে শুধু আপনার নাম করতো, তার রাগের জায়গা নিল আপসোস; শুধু বলতো, "অমন লক্ষ্মীপ্রতিমার মত বউ আমি পায়ে ঠেললাম! ছিঃ!" আপনার সাথে বহুবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছে, আপনার প্রতিটি নাটক সে নিয়ম করে থিয়েটারে দেখতে যেতো, আমিও কখনো-সখনো গেছি তার সাথে…
গিরিবালা : আমি জানি, লবঙ্গ দেবী।
লবঙ্গ : আমায় নাম ধরেই বলবেন, বয়সে আপনার ছোট।
গিরিবালা : বেশ, তাই হবে।
লবঙ্গ : গোপীনাথ আপনার রূপের বড় প্রশংসা করতো, বলতো, "এমনটি সত্যিই দেখা যায় না! হঠাৎ আলো পড়ে যেমন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, তেমনই রূপ আমার গিরির।" আজ এত কাছ থেকে আপনাকে দেখে সে কথার সত্যতা পেলাম; সত্যিই, এই এত বয়সেও আপনি দেবীপ্রতিমার মত উজ্জ্বল।
গিরিবালা : জানো লবঙ্গ, একদিন তোমার রূপ আর আকর্ষণের গল্পও সে ঠিক এমনি করেই আমায় বলতো।
লবঙ্গ : তাই বুঝি?
গিরিবালা: হ্যাঁ। আমি সারাটা দিন একলা বাড়িতে কেবল দাসী সুধামুখীকে নিয়ে কাটাতাম, আর সদ্যযৌবনা নিজেকে শাড়িতে-বালাতে-হারে-আংটিতে সাজিয়ে তুলে অপেক্ষা করতাম, কখন গোপীনাথ ফিরবে। কোনো রাতে ফিরতো, কখনো নয়। যে রাতে ফিরতো, সে রাতে শুধু তোমার রূপের গল্পই শুনতাম, আর ভাবতাম, আমি কেন তুমি হলাম না?
লবঙ্গ : (একটু হেসে) খুব জ্বলতেন বুঝি?
গিরিবালা : খুব বেশি। তারপর, যেদিন তোমায় উপহার দেবে বলে সারা ঘর তন্নতন্ন করেও গোপীনাথ চাবি পেলো না, শেষে রাগের মাথায় আমার গা থেকে জোর করে গয়না খুলে আমায় লাথি মেরে বেরিয়ে গেল, আমার পুনর্জন্ম তো হলো সে রাতেই, লবঙ্গ।
লবঙ্গ : প্রকৃতির এ-ই নিয়ম গিরিবালা দেবী, পাশার দান উল্টে যাবেই। আজ আপনার সব আছে, অথচ দেখুন, যে অভিনেত্রী লবঙ্গকে দেখতে থিয়েটার উপচে পড়তো, সে আজ নিঃস্ব। বড় অভিনেত্রী হতে চেয়েছিলাম, সে আর হলো না; নিজের বলতেও কেউ আর রইলো না। যাকে ভালোবেসেছিলাম, স্বামী মেনেছিলাম, সে-ও কোনোদিন আপন করে নেয়নি। ছিলাম রক্ষিতা, পরে হলাম অপয়া স্ত্রী। হা:হা:হা:!
গিরিবালা : লবঙ্গ, তুমি গোপীনাথকে ভালোবেসেছিলে?
লবঙ্গ : (ক্ষণিক নীরব থেকে, পরে মুখ নিচু করে) ভালো না বাসলে তাঁর এক কথায় যশ-খ্যাতি সব ছেড়ে অনিশ্চিতকে বরণ করতে পারতাম?
গিরিবালা : তুমি কী আমায় এখনো ঈর্ষা করো?
লবঙ্গ : (সহসা মুখ তুলে) হ্যাঁ, করি!
(গিরিবালা করুণ হাসলেন)
গিরিবালা: তোমার অবস্থানে একদিন আমিও ছিলাম। আজ বলতে দ্বিধা নেই, হিংসায়-ঈর্ষায় পুড়ে খাক হয়ে দিনরাত তোমায় কতশত অভিশাপ যে দিয়েছি! অথচ আজ বুঝি, সেদিন যদি গোপীনাথ, সেই সাথে আমার জীবনেও তুমি প্রবেশ না করতে, আমি এই গিরিবালা দেবী হতে পারতাম না। তোমায় ধন্যবাদ, লবঙ্গ।
লবঙ্গ : বিদ্রূপ করছেন?
গিরিবালা : একেবারেই না! আমার অন্তরের সমস্ত কৃতজ্ঞতা তোমায় দিলাম। যদি গ্রহণ করো, বড় খুশি হবো।
(দু'জনেই নীরব হলেন। ফের লবঙ্গ দেবীই নীরবতা ভাঙলেন)
লবঙ্গ : কিন্তু গিরিবালাদেবী, আমি কী পেলাম? ভালোবাসা, গোছানো যত্নের সংসারের স্বপ্ন দেখা কী একটি মানুষের পক্ষে অন্যায় না আমার মত সাধারণ মেয়েদের তেমন স্বপ্ন দেখা পাপ? বলতে পারেন?
(গিরিবালা নিজের আসন ছেড়ে লবঙ্গের পাশে বসে তাঁর কাঁধে হাত রাখলেন)
গিরিবালা : না লবঙ্গ, পাপও নয়, অন্যায়ও নয়। পৃথিবীর সব নিয়ম কেউই বুঝতে পারে না, আমারও বড় অদ্ভুত লাগে। তুমি শুধু ভালোবেসেছিলে, কোনো অন্যায় করোনি। কিন্তু…
লবঙ্গ : কিন্তু আমার অজ্ঞাত পাপ আমায় সারাজীবনভর শাস্তি দিয়ে গেল। কেবল আপনাকে ঈর্ষা করাই সার হলো, আর কিছু পেলাম না।
(লবঙ্গ দেবী হাতে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলেন। গিরিবালা তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন)
গিরিবালা : আমি তোমার বন্ধু, লবঙ্গ। আমায় ভালোবাসতে পারো?
(লবঙ্গ কান্নার উচ্ছাস খানিক দমন করে গিরিবালার দিকে অস্পষ্ট চোখে তাকালেন)
গিরিবালা : লবঙ্গ, তুমি বা আমি- আমরা কেউই অন্যায় করিনি। তুমি যেমন গোপীনাথকে ভালোবেসেছিলে, আমিও তা-ই। কাঙালের মত ভালোবাসা ভিক্ষে করেও পাইনি, তুমিও আমারই মতন কেবল নামেমাত্র স্ত্রী ছিলে। অন্যায় যদি কেউ করে থাকে, তো সে গোপীনাথ। অথবা, গোপীনাথই বা বলছি কেন, অপরাধী তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।
লবঙ্গ : পুরুষতান্ত্রিক সমাজ?
গিরিবালা : হ্যাঁ। এ সমাজ আমাদের শিখিয়েছিল স্বামীর হাতে মার খেয়েও সতীলক্ষ্মী হয়ে পড়ে থাকতে হবে, এ সমাজ পুরুষের বহুগামিতা বৈধ করে বলেছিল, রক্ষিতা ছাড়া লোক কখনো "বাবুর সম্মান" পাবে না। দোষ তো এ সমাজের, লবঙ্গ। পুরুষতন্ত্রের ফাঁদে পড়ে আমরা দুই অপরিচিত নারী একে অপরকে ঈর্ষা করতে শুরু করলাম, আর আজ জানি, ঈর্ষার মত সর্বগ্রাসী হওয়ার ক্ষমতা দাবানলেরও নেই।
(খানিক নীরবতা)
লবঙ্গ : গিরিবালাদেবী, আপনি ঠিক বলেছেন। আজ চুয়াল্লিশ বছর হলো আমি শুধু পুড়েছি, মরেছি। ভালোবাসা চেয়েও পাইনি, শুধু দিনরাত আপনাকে অভিশাপ দিয়ে গেছি আর আমার একলার যন্ত্রণা বয়েছি।
গিরিবালা : লবঙ্গ, আমরা সব ভুলে আবার নতুন করে শুরু করি? যে সমাজে আমরা ছিলাম তা আজও পুরোপুরি নির্মূল না হলেও অনেকটাই পরিবর্তিত। আমরা দু'জন এই নতুন সমাজের নতুন সদস্য হয়েই আজ জোড়াসাঁকোয় যাবো, কেমন?
লবঙ্গ : আপনিও বুঝি জোড়াসাঁকোয় রবিবাবুর কাছে যাচ্ছেন?
গিরিবালা : হ্যাঁ গো, কতদিন দেখিনি তাঁকে! আর, তিনি না থাকলে আমাদের দু'জনের দেখা কী করে হতো বলোতো? তাঁকে ধন্যবাদও জানাতে হবে!
(দু'জনেই হেসে উঠলেন। রাতের আঁধার কেটে ট্রেন ছুটে চললো তার গন্তব্যে)
(সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত: @ঋদভিকা পাল)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



