
বসন বলে একটি মেয়েকে আমি বড় স্নেহ করি, ভালোবাসি। সে অমলেশদাকে ভালোবেসেছিল। উঁহু, "ছিল" বললে ভুল বলা হবে, সে অমলেশদাকে ভালোবেসেছে, কারণ এখনো যে বাসে তার প্রমাণ আমি পেয়েছি।
বসন বড় নিঃসঙ্গ। তবে এই নিঃসঙ্গতা তার ভেতরেই বসত করে, প্রকৃতি আর একাকীত্বের একান্ত মৌলিক সৌন্দর্যের কাছে বিলীন হয়ে নিজেকেও সে ভুলিয়ে ভালিয়ে, বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাখে। যদিও আমি যতবার তার বাড়ির তিন তলার বড়সড় ঘর তিনটেয় গেছি, ঠিক ততবার একটা হু হু নির্জনতা বুঝতে পেরেছি। সেই নির্জনতা, সেই চাপা অস্ফুট হাহাকার নান্দনিক ছবির উপকরণ নয়, তার ভেতর গরল হয়ে লুকিয়ে আছে অন্য জন্মের বেদনা, এ জন্মের আহত আত্মসম্মান।
শ্রীমদ্ভগবদগীতায় আছে, "লোকে যেমন পুরোনো, জীর্ণ পোশাক ত্যাগ করে নতুন পোশাক পরে, আত্মাও তেমনি পুরোনো দেহ ছেড়ে নতুন দেহে আশ্রয় নেয়।" বসন, বসন্তে জন্ম বলে যার নাম বসন, গোটা এক জন্ম জুড়ে নিজের অজ্ঞাত পাপের ক্ষালন করেছে ভালবাসার বিনিময়ে, গয়নার বাক্সের একশো ভরি সোনার জড় অলংকারের পায়ে নিজের প্রাণ, স্নেহ, মমতা সব সমর্পণ করে। তখন অবশ্য তার পুরোনো দেহের "আইডেন্টিটি" ছিল রসময়ী নামে। পুরুষতন্ত্রের ছোবল খেয়ে সে মরণে পা বাড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধকে স্বামী বলে বরণ করেছিল, বারো বছর বয়সে বৈধব্যের স্বাদ নিয়েছিল। তারপর এক জীবন, এক জন্ম সোনার গয়নার নিষ্প্রাণ ঝলমলানি আঁকড়ে সে বেঁচেছিল কারণ, সমাজের শিখিয়ে দেয়া ভাগ্যের মিথ বরণ করে, ভাইদের কপট আদরে বেঁচে থাকার পথটাই সে জানতো।
রসময়ী এবার বসন্তে জন্ম নিয়েছে। সম্ভবত, তাকে অজানা পাপের শাস্তি দিয়ে বিধাতার খানিক অনুশোচনা হয়েছিল, তাই তিনি তাঁকে ষড়ঋতুর শেষটায় নিয়ে এলেন। বসন বড় সুন্দর, পরিবারের আদরের। যৌবনের ধর্মে সে শুধু ভাব করতে চেয়েছিল "গুড বয়" অমলেশদার সাথে, চিঠি লিখে আলাপ করবার ইচ্ছেটুকু শুধু জানিয়েছিল। চিঠিটা পেয়ে অমলেশদা বসনদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে কলেজ যাবার পথ বদল করলো। এই সামান্য ঘটনাহীন ঘটনাই জাগিয়ে তুলল বসনের গতজন্মের বিষণ্ণতা, দীর্ঘ বৈধব্যের হাহাকার।
আমি জানি, বসন জানে কী করে ভালোবাসতে হয়। সে বোঝে কাকে ভালোবাসা বলে। তাই যখন বান্ধবী নিজের প্রেমিকের গল্প শোনায়, বলে সে নাকি তার প্রেমিকের নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে বাস করে, তখন বসন শুনতে পায় বুলি সর্বস্ব প্রেমের ফাঁকা আওয়াজ। রসময়ী সত্য - মিথ্যের ফারাক জানতো না, সে শুধু স্বামী - সংসারের রূপকথা চেয়েছিল। কিন্তু, বসন শামসের "forty rules of the religion of love" জানে- সজ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে।
প্রবল আত্মসম্মান নিয়ে জন্ম নেয়া বসন্তকুমারী গভীর অভিমানিনী। তবে যেদিন অমলেশদা সেই পুরাতনের প্রায়শ্চিত্ত করতে, বসনের কুষ্ঠ হওয়ার স্বেচ্ছাকৃত মিথ্যে প্রচারণা শুনেও আর দ্বিধা করেনি, সেদিনই তিনতলার বড়, আরামদায়ক ঘরগুলোয় প্রথম বসন্ত এসেছে। রসময়ীর কান্না সেদিনই সে ঘরের বাতাসে ঘুরপাক খেয়ে চিরতরে মিলিয়ে গেছে, বিধাতারও প্রায়শ্চিত্ত পূর্ণ হয়েছে।
বসনের জন্মঋতুতে জন্ম আমারও। ইচ্ছে রাখি, কখনো কোনো কন্যাশিশু যদি আমার মাতৃসত্তাকে পূর্ণ করে তোলে, তাকে ডাকব "বসন" বলে।
( শ্রী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য সৃষ্টি "গয়নার বাক্স" এর অনুপ্রেরণায়)
(সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত: @ ঋদভিকা পাল)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০২১ রাত ৯:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



