somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

থ্রিলারঃ অপহরণ

০৩ রা আগস্ট, ২০২১ সকাল ১১:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছবিঃ Todor Tsvetkov/Getty Images

-ইন্সপেক্টর সাহেব, আমি আমার ছেলেকে ফেরত চাই। মহিলা কেঁদে উঠলেন।
-ম্যাম, একটু শান্ত হোন। ইন্সপেক্টর মাসুম শান্ত করার চেষ্টা করলেন মিসেস আমজাদকে।
-ওরা আমার ছেলেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে আর আপনি আমাকে বলছেন শান্ত হতে?
-ম্যাম, এরকম পরিস্থিতিতে উত্তেজিত হয়ে কিছু করতে গেলে বিপদ শুধু বাড়ে, কমে না। আসুন, আবার প্রথম থেকে শুরু করা যাক। কখন বুঝতে পারলেন আপনার ছেলে কিডন্যাপ হয়েছে?
-বারটার আশেপাশে। স্কুলে গিয়েছিলাম ওকে আনতে। ও ছিল না সেখানে।
-স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেন নি?
-ওর ক্লাস টিচার, স্কুলের প্রিন্সিপাল-সবার সাথেই বলেছি। ও নাকি ছুটির পর অন্য সবার সাথে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেছে-ক্লাস টিচার এর চেয়ে বেশি কিছু জানেন না।
-আচ্ছা, গত দেড় বছর ধরেইতো সব শিক্ষা প্রতিষ্টান বন্ধ। ওদের স্কুল শুরু হয়েছে কবে থেকে?
-শনিবার থেকে। সপ্তাহে দুদিন করে ক্লাস হচ্ছে।
-শাকিরের ক্লাস কোন কোন দিন থাকে?
-শনি আর মঙ্গলবার।
-আজ মঙ্গলবার। তারমানে হয়ত শনিবার পুরো স্কুল ঘুরে প্ল্যান করে আজ এক্সিকিউট করেছে।ওর বয়স কত?
-দশ বছর। ক্লাস ফোরে পড়ে।
-ও কি নিজে নিজে আসা যাওয়া করে?
-না। সকালে ড্রাইভার দিয়ে আসে, দুপুরে আমি আনতে যাই।
-সকালে যান না কেন?
-আমার ঘুমে সমস্যা আছে। ঘুমাতে রাত হয়, তাই সকালে উঠতে পারি না।
-আপনাদের ড্রাইভার কেমন? বিশ্বস্ত?
-হ্যা, অনেকদিন ধরে আছে। আমার স্বামী যখন ছোট ছিলেন, তখন থেকেই। পঁচিশ-ত্রিশ বছর হবে প্রায়।এ কথা কেন বলছেন?
-আসলে পুলিশের চাকরি করিতো, তাই সব এঙ্গেল বিবেচনা করতে হয়। সেসব থাক, তো স্কুলে ছেলেকে না পেয়ে কি করলেন আপনি?
-ওর মোবাইলে কল করলাম।আমাদের বুয়া রিসিভ করল।
-মানে?
-সকালে তাড়াহুড়ায় ও বাসায় মোবাইল ফেলে গিয়েছিল।
-হুম। তারপর কি করলেন?
-আমি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসি। আমার ছেলেটা একটু এডভেঞ্চার প্রিয়, খুব টিনটিন পড়ে। ভাবলাম আবার একা একা বাসায় চলে আসার প্ল্যান করেছে কিনা।
-তারপর?
-বাসায় এসে ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করলাম। আমার ছেলেটা ফিরে আসে নি। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন মিসেস আমজাদ।
-আপনার স্বামীকে দেখছি না? অফিসে?
-নাহ, ব্যবসার কাজে দুদিন আগে বাইরে গেছেন।
-উনাকে জানাননি?
-নাহ, উনি হার্টের পেশেন্ট। জানলে সহ্য করতে পারবে না।
-ওহ। তা শেষ পর্যন্ত কিভাবে শিওর হলেন যে শাকির, মানে আপনার ছেলে অপহৃত হয়েছে?
-দুইটার দিকে একটা ফোন এসেছিল। বলল, শাকির ভাল আছে। যদি ওদের কথামত চলি, তাহলে ওকে নিরাপদেই ফিরে পাব।
-ওরা? তারমানে একাধিক লোক?
-জানি না। ফোনেতো একজনই কথা বলেছে।
-কিসে ফোন করেছিল? মোবাইলে?
-নাহ, ল্যান্ডফোনে।
-কোন দাবী দাওয়া জানিয়েছে?
-নাহ, শুধু বলেছে আবার ফোন করবে।
-এটা কখনকার ঘটনা?
-বললাম না, দুইটার সময় ফোন করেছিল।
-ওহ, ঠিক খেয়াল করতে পারিনি। আপনি তারপর কি করলেন?
-আপনার সাথে যোগাযোগ করলাম। আর কি করব-বুঝতে পারছিলাম না।
-আপনি ঠিক কাজই করেছেন। এখন তিনটা বাজে। তারমানে এক ঘন্টা হয়ে গেছে। এর মধ্যে আর ফোন এসেছে?
মিসেস আমজাদ না-সূচক মাথা নাড়লেন। তারা মাথা নাড়ানো শেষ হওয়ার আগেই ফোনটা বেজে উঠল।
-ফোনটা রিসিভ করুন। আর স্পীকারটা অন করে রাখুন। মাসুম সাহেব বললেন।
-হ্যা…এ…এ…লো। স্পীকারটা অন করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললেন মিসেস আমজাদ।
-আমি জানি, আপনি পুলিশে খবর দিয়েছেন। কাজটা ভাল করেন নি। যাই হোক, বেশি কথা বলব না, সরাসরি পয়েন্টে আসি। আমাদের দাবী বেশি না, জাস্ট বিশ লাখ। আমি জানি, এটা আপনার জন্য কোন ব্যাপার না। টাকা রেডি রাখুন। কখন, কোথায় পৌছে দেবেন-সেটা নেক্সট কলে জানাব।
মিসেস আমজাদ কোন কথা বলার সুযোগ পেলেন না, তার আগেই কল কেটে গেল।
-এখন কি হবে? আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন মিসেস আমজাদ।
-শান্ত হোন, মিসেস আমজাদ। কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছে, ছেলেটার বয়স আঠার বিশ বছরের বেশি হবে না। প্রফেশনাল না সম্ভবত। নাটক সিনেমা দেখে যা শিখেছে, সেভাবেই মুখস্থ ডায়লগ ডেলিভারী দিয়ে দিয়েছে।
-কিন্তু ও তো স্পষ্ট করেই বলল, সে জানে আমি আপনাদের সাথে যোগাযোগ করেছি।
-দেখুন মিসেস আমজাদ, আপনারা ধনী পরিবার। আপনাদের ছেলে কিডন্যাপড হয়েছে। যেকোন পরিবার এ অবস্থায় যে কাজটা সবার আগে করবে, সেটা হচ্ছে পুলিশে খবর দেয়া। এটা কমন সেন্সের ব্যাপার। ছেলেটা জেনে বলেনি, আন্দাজে ঢিল ছুড়েছে। আর কথার টোন শুনে শিক্ষিত ঘরের ছেলে বলেই মনে হচ্ছে।
-এত শিওর হচ্ছেন কিভাবে?
-দেখুন গত এক মাসের ভেতর এই এলাকায় আরও দুটো অপহরণের ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো আমি হ্যান্ডেল করেছি। কিডন্যাপারের প্রথমেই নিজের কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য ভিক্টিমকে নির্যাতন করে তার চিৎকার অপরপক্ষকে শোনায়। এতে সে যে সত্যিই অপহরণ করেছে , সেটাও প্রমাণিত হয়, আবার অপরপক্ষকে মানসিকভাবে দূর্বল করে ব্যাকফুটে পাঠানো যায়।
-আপনার পয়েন্টটা কি?
-পয়েন্ট হচ্ছে বেশি সময় ধরে ফোনে কথা বললে আমাদের পক্ষে ফোন লোকেট করাটা তূলনামূলকভাবে ইজি হয়ে যায়।আগের দুটো কেসেই কিন্তু আমরা ফোন থেকে অপরাধীর লোকেশান বের করতে পেরেছিলাম। এই ছেলে সেটা করেনি। সে সরাসরি কাজের কথা বলে ফোন ডিসকানেক্ট করে দিয়েছে, সময় নষ্ট করেনি।
-তাহলেতো এই ছেলে প্রফেশনালি বিহেভ করেছে, আপনি ওকে আনপ্রফেশনাল বলছেন কি হিসেবে?
-প্রফেশনালি না, স্মার্টলি বিহেভ করেছে। সম্ভবত হলিউডি থ্রিলার বেশি বেশি দেখার ফল।
-মানে কি?
-দেখুন, এইসব কাজ রিস্কি। যদি কিডন্যাপার আগে থেকেই প্রমাণ করতে পারে আপনার কাছে তার ছেলে বন্দী আছে, তাহলে আপনি প্রতিটা পদক্ষেপ নেবেন ভয়ে ভয়ে। ভয় পেয়ে পুলিশে যোগাযোগ না করে সরাসরি টাকা দিয়ে আসার সম্ভাবনাই বেশি, কারণ আপনি অলরেডি জানেন তার কাছে আপনার ছেলে আছে এবং তাদের কথা না শুনলে ছেলের সমূহ বিপদ। এটা কিডন্যাপার সাইকোলজি।নিজের সেফটি এনশিওর করা। এক্ষেত্রে ছেলেটা সেটা করেনি। তারমানে রিস্ক মিনিমাইজেশনের ব্যাপারটা তার বা তাদের মাথায় নেই। আনপ্রফেশনাল বলেই হয়ত।
-বুঝলাম। তো এখন কি করতে বলছেন?
-আমার ধারণা, ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে কোথায়, কিভাবে টাকা নেবে-সে ব্যাপারে। হয়ত আগামী কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওর ফোন পাবেন।
-এখন আমার করণীয় কি?
-প্রথমেই নিশ্চিত হওয়া যে, আসলেই ওদের কাছে আপনার ছেলে আছে কিনা। এবার ফোন করলেই বলবেন, আপনি শাকিরের সাথে কথা বলতে চান।
-যদি ওরা না দেয়?
-আপনি বার্গেনিং করবেন। বলুন, কথা না বলে আপনি টাকা দেবেন না।
-ওরা মানবে?
-দেখুন, যেহেতু অপরাধ করে টাকা কামাতে চাইছে, তারমানে ওরা ডেসপারেট। ওদেরকে আপনি যত পুশ করবেন, তত ওদের ভুল চাল দেয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। ওদের ভুল চাল মানেই আমাদের সুবিধা।
-তাহলে…
মিসেস আমজাদ তার কথা শেষ করতে পারলেন না, তার আগে ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠল।
-হ্যালো।ভয়ে ভয়ে বললেন মিসেস আমজাদ।
-বিকাল পাঁচটার মধ্যে টাকা চাই।
-কিন্তু আমার কাছে এত টাকা নেই এই মুহূর্তে। তিনটা বেজে গেছে এরইমধ্যে, এত স্বল্প সময়ে এতগুলো টাকা আমি কোথায় পাব?
-সে আপনার মাথা ব্যাথা। আমি জানি, আপনি পারবেন।
-আমার একটা শর্ত আছে।
-আপনার আবার কিসের শর্ত?
-আগে আমি আমার ছেলের সাথে কথা বলব।
-সেটা সম্ভব না।
-না কেন? তাহলে কিভাবে বুঝব তুমি সত্য বলছ?
-তাহলে আপনার ছেলেটা কোথায়? বেডরুমে ঘুমাচ্ছে? ওপাশ থেকে বিশ্রী হাসি শোনা যায়।
-কথা না বলে আমি টাকা দেব না।
-ঠিক আছে, না দেন। কাল সকালে শহরের কোন একটা নালা কিংবা ডাস্টবিন থেকে ছেলের লাশ কালেক্ট করে নেবেন তাহলে।
অপরপাশ থেকে ফোন ডিসকানেক্টেড হয়ে গেল।
-এখন কি হবে? আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মিসেস আমজাদ।
-একটু শান্ত হোন।
-ওরা যদি সত্যিই আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলে?
-হুম, ব্যাটাকে যতটা আনপ্রফেশনাল ভেবেছিলাম, ততটা সে নয়। শাকিরের কন্ঠ শোনায় নি, জানে ফোনকল লম্বা হয়ে গেলে আমরা ট্রেস করে ফেলব। এখন সে উলটো আমাদেরকেই চাপে ফেলে দিয়েছে।
-কিন্তু আমার ছেলের কি হবে? ওকে কি ওরা মেরে ফেলবে?
-খুন করা এত সহজ ব্যাপার না। দেখুন বাচ্চা ফেরত পেলে অনেক পরিবারই মামলা নিয়ে এগোতে চায় না। কিন্তু একবারে খুন করে ফেললে অনেক ঝামেলা। লাশ ডিসপোজ করার ঝামেলা, আবার অপহরন-হত্যা মামলা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ানো। পুলিশও এদের পিছে লেগে থাকে। তাই একেবারে বাধ্য না হলে কোন অপহরণকারীই খুনের দিকে যেতে চায় না। এতে তার নিজের বিপদই বাড়বে।
-কিন্তু…
-কোন কিন্তু নয়। আমার ধারণা আবার ফোন আসবে। এবার আর বেশি কথা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। টাকার পরিমাণ, সময় আর ডেলিভারী লোকেশান কনফার্ম করুন।
ইন্সপেক্টর মাসুমের অনুমানকে সত্য প্রমাণ করে মিনিটখানেকের মধ্যেই আবার ফোনটা বেজে উঠল।
-যা বলব, মনযোগ দিয়ে শুনুন।বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ হচ্ছে, টি-টোয়েন্টি।আপনার ছেলের জীবনের দামও তাই টোয়েন্টি। যতক্ষণ বাংলাদেশের ইনিংস চলছে, তার মধ্যেই স্টেডিয়ামে এসে টাকা ডেলিভারী দিয়ে ছেলেকে নিয়ে যাবেন। আপনার ছেলে গ্যালারীতেই থাকবে। নো হাংকি পাংকি। তাহলে ছেলের উইকেট এক্কেবারে ডাউন। কোন রিভিউ নেয়ার সুযোগ পাবেন না।
কল কেটে গেল।
-এখন উপায়?
-আমাদেরকেও খেলতে হবে। টিভিটা অন করুন।
টিভিটা অন করতেই দেখা গেল, খেলা শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাট করছে, ইতিমধ্যেই কয়েক ওভার চলে গেছে।
-শালার জীবনেও যেই দল টসে জিতে না, তারাই আজকে টসে জিতে আগে ব্যাট নিয়ে নিল। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন ইন্সপেক্টর মাসুম।
-কি হল? ব্যাপার বুঝতে না পেরে জানতে চাইলেন মিসেস আমজাদ।
-কিডন্যাপারের কথা শোনেননি? যতক্ষণ বাংলাদেশের ইনিংস চলবে, তার মধ্যেই ওকে টাকা দিতে হবে। এখান থেকে স্টেডিয়াম কতদূর?
-বেশি দূর না।
-আপনার কাছে বিশ লাখ টাকা আছে এই মুহূর্তে?
-বাসার সেফে সাত-আট লাখ টাকা থাকার কথা। বাকিটা ব্যাংক থেকে তুলতে হবে।
-তাহলে যদি ব্যাংকে চলুন। সাড়ে তিনটা বাজে প্রায়, আর আধ ঘন্টা পরে ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ হয়ে যাবে।
-সেকি, পুলিশের কোন টিম যাবে না আমাদের সাথে?
-আপাতত না।
-কেন?
-দেখুন, বাংলাদেশের ইনিংসের বেশি কিন্তু বাকি নাই। তারমানে হাতে সময় বেশি নেই। আমাদের এখন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে স্টেডিয়ামে যেতে হবে। তারপর শাকিরকে উদ্ধার আর কিডন্যাপারদের ধরার প্রশ্ন। আমাকে এখন ফোর্স নিতে হলে সাদা পোশাকে টীম ম্যানেজ করতে হবে, তারপর প্রোপার প্ল্যানিং, পজিশনিং আর এক্সেকিউশনের ব্যাপার আছে।প্ল্যানিং-এ কোন ভুল হওয়া চলবে না, নাহয় কিডন্যাপার সতর্ক হয়ে যাবে, শাকিরের বিপদ বাড়বে তাতে।
-যদি কিডন্যাপারদের বড় দল হয়? আপনি একা সামলাতে পারবেন?
-আসলে করোনার এই সময়ে আমরা খুব বিপদে আছি। একদিকে লকডাউন এনশিওর করার জন্য আমাদের বেশির ভাগ সদস্যকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে, বাকিদের একটা বড় অংশ অস্ট্রেলিয়া দলের নিরাপত্তায় নিয়োজিত। এই মুহূর্তে সাথে চাইলেও ফোর্স পাব না।
-তাহলে?
-আপাতত আমিই যাচ্ছি আপনার সাথে। তারপর নাহয় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়া যাবে।


দুই
-সব ঠিক আছে? পেছন ফিরে জানতে চাইলেন ইন্সপেক্টর মাসুম।
-হ্যা। ছোট্ট করে জবাব দিলেন মিসেস আমজাদ।
-টাকাটা আরেকবার গুণে দেখবেন?
-দেখেছি। একহাজার টাকার বান্ডিল সব, প্রতি বান্ডিলে একশটা করে নোট, মোট বিশ বান্ডিল। বলতে বলতে টাকা ভর্তি কালো ব্যাগটা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন মিসেস আমজাদ। আমার শাকির।
ইন্সপেক্টর মাসুম কিছু বললেন না। মোবাইলটা বের করে স্কোর দেখে নিলেন। সতের ওভার চলে গেছে, আর তিন ওভার বাকি। তিন ওভার মানে তিন গুণ পাঁচ অর্থাৎ পনের মিনিট আছে হাতে।
সামনে ফিরে চুপচাপ ভাবতে শুরু করলেন মাসুম। বাসার সেফে ছয় লাখ টাকা ছিল। ব্যাংকে যাওয়ার পর তেমন কোন ঝামেলা হয়নি। মিসেস আমজাদ বড় ক্লায়েন্ট। একটা চেক দেওয়ার সাথেসাথেই ওরা বাকি টাকা বের করে দিয়েছে। ম্যানেজার রুমে নিয়ে চা-নাস্তার দাওয়াত দিয়েছিল, তবে মিসেস আমজাদ সময় নষ্ট করতে রাজি হননি।
-ড্রাইভার সাহেব।
-জ্বি স্যার।
-স্পীড বাড়ান। আমাদের তাড়াতাড়ি পৌছাতে হবে।
ড্রাইভার কোন জবাব দিল না, নীরবে এক্সেলেরেটরে চাপ বাড়াল। সরু রাস্তার বুক চিরে ল্যান্ডক্রুসারটা উড়তে শুরু করল।
-মাসুম সাহেব।
-জ্বি।
-আমাদেরতো টিকেট কাটা নেই। স্টেডিয়ামে ঢুকব কিভাবে?
-সমস্যা নেই, পরিচিত কলিগ আছে। আমি কথা বলে রেখেছি, সমস্যা হবে না।
মিসেস আমজাদ চুপ হয়ে গেলেন।
পরবর্তী দুই মিনিট নীরবেই কেটে গেল।
-স্যার, আইসা পড়ছি।
মিসেস আমজাদ আর ইন্সপেক্টর মাসুম, দুজনেই নেমে পড়লেন গাড়ী থেকে।
-এখন? জানতে চাইলেন মিসেস আমজাদ।
-আসুন, ভেতরে ঢুকি।
মাসুম সাহেবের পিছু পিছু স্টেডিয়ামে ঢুকলেন মিসেস আমজাদ।
-এবার?
চারিদিকে তাকালেন ইন্সপেক্টর মাসুম। এই করোনাকালে পুরো গ্যালারী যেন ধু ধু মরুভূমি, শুধু ভিআইপি গ্যালারীতে কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে।
ওরা কারা?
গলায় ফিতা ঝুলছে প্রত্যেকেরই। দল কিংবা স্টেডিয়ামের কর্মকর্তা হবে হয়ত।
তার মাথায় চিন্তার ঝড় চলছে। একেতো করোনার এই সময়ে মাঠে কোন দর্শকের প্রবেশাধিকার নেই, তারওপর দলটার নাম অস্ট্রেলিয়া। নিরাপত্তা নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কড়াকড়ি হচ্ছে। এর মধ্যে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে কিডন্যাপার একটা বাচ্চাকে নিয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকবে কিভাবে? তাছাড়া টাকাভর্তি ব্যাগ নিয়ে সে বেরোবেই বা কি করে?
একটাই উপায় আছে, হয় স্টেডিয়াম কিংবা বোর্ডের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী এর সাথে জড়িত। এদের সাহায্য ছাড়া কিডন্যাপারের পক্ষে কোনভাবেই তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
কিন্তু সেই লোকগুলো কারা?
গলায় ফিতা ঝুলানো ওই লোকগুলো?
-আমার শাকির কোথায়? কোনরকমে কান্না আটকে রেখেছেন মিসেস আমজাদ।
মাসুম কোন জবাব দিলেন না। বলা ভাল, কোন জবাব খুঁজে পেলেন না। তাকালেন স্কোরবোর্ডের দিকে। ঊনিশ ওভার শেষ হল। লাস্ট ওভারে বাংলাদেশের বিশ রান প্রয়োজন।
বিশ রান প্রয়োজন মানে? বাংলাদেশ কি তবে প্রথমে ব্যাট করেনি? চেজ করছে? এত বড় দেখার ভুল তার হল কি করে?
শীট। আর মাত্র এক ওভার পরেই খেলা শেষ। তারপরেই পুরো স্টেডিয়াম এমনিতেই খালি হয়ে যাবে। ইনিংস শেষে কি শাকিরকে খুন করবে ওরা?
-ম্যাম।
-বলুন।
-ভিআইপি গ্যালারীতে ওরা যেতে পারবে না। সিকিউরিটির ব্যাপার স্যাপার আছে। আবার এই করোনার মধ্যে খালি গ্যালারীতেও বসে থাকলেও সবার চোখ পরে যাবে।
-তাহলে?
-বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, আপনি কখনো আগে খেলা দেখেছেন?
-একবার এসেছিলাম শাকির আর ওর বাবার সাথে। ভিআইপি গ্যালারীর টিকেট পাইনি, আমরা বসেছিলাম স্টেডিয়ামের একেবারে শেষ মাথার গ্যালারীটায়।
-তাহলে ওদিকেই চলুন।
-কেন?
-পুরো গ্যালারীটাই খালি। এখন গ্যালারীতে আসলে ক্যামেরার সামনে পড়ে যাবে, আন্ডিটেক্টেড থাকবে না। মনে হচ্ছে ইনিংস শেষে সব ক্যামেরা যখন মাঠে খেলোয়ারদের ওপর ফোকাস করবে তখনই ওরা বের হবে। এমন কোন জায়গায় ওরা থাকতে চাইবে, যেটা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। শাকির যেহেতু ওখানে আগে খেলা দেখেছে, তাই জায়গাটা ওর চেনা। এখানে ওর প্যানিকড হওয়ার সম্ভাবনা একটু হলেও কম থাকবে। আর জায়গাটাও এক্সিট গেইটের কাছে, কিডন্যাপারের জন্য নিরাপদ।
-তাহলে?
-আপনি টাকার ব্যাগ হাতে এগিয়ে যান, আমি চোখ রাখছি।
-আপনি আসবেন না?
-আমিও আসছি পেছন পেছন, একটু দূর থেকে, যাতে ওরা বুঝতে না পারে। শাকিরকে দেখলেই ওকে নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাবেন।
-কেন? গুলি করবেন নাকি?
-নাহ। পুলিশ হতে পারি, কিন্তু একটা ইন্টারন্যাশনাল সিরিজে স্টেডিয়ামে এসে গুলি চালানোর মত দুঃসাহস করাটা বোকামী না, বড় ধরণের ভুল হবে। স্পেশালি দলটা যখন অস্ট্রেলিয়া। কত কাহিনী করে ওদেরকে এবার বাংলাদেশে আনতে হয়েছে-জানেন? স্টেডিয়ামে গোলাগুলি হলে চাকরীও চলে যেতে পারে।
আর কোন প্রশ্ন করলেন না মিসেস আমজাদ, নীরবে টাকার ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। ঠোঁটদুটো নড়ছে তার-দোয়াদরূদ পড়ছেন নাকি?
হঠাৎ কি মনে করে যেন স্কোরবোর্ডের দিকে তাকালেন তিনি।
এক ওভারে বিশ রানের প্রয়োজন ছিল, এখন দুই বলে চার রান।
তারমানে চার বলে ষোল রান নিয়েছে?
৪ ৪ ৪ ৪।
বাহ, সাকিবতো আসলেই বাঘের বাচ্চা।
ছোটখাটো দেখতে বোলারটা কে? জাম্পা নাকি?
হ্যা, জাম্পাইতো। এইতো হাঁটতে শুরু করেছে।
সাকিবের ব্যাটটা উঁচু হতে শুরু করেছে, আরেকটা চার হবে নাকি? ছক্কা দিয়ে ইনিংস শেষ করলে অবশ্য আরো ভাল হয়।
সাকিব সামনে বাড়ল, উচিয়ে মারল, হাওয়ায় ভাসতে শুরু করল বলটা। “ছক্কা” বলে চিৎকার করতে গিয়েও থেমে গেলেন মাসুম সাহেব, বাউন্ডারীতে ক্যাচ হয়ে গেছে!
সাকিব ফিরে আসছে, মাঠে নামছে মাহমুদউল্লাহ।এইতো দুজন ক্রস করল।
গভীর টেনশান নিয়ে ক্রীজের দিকে চেয়ে রইলেন মাসুম সাহেব।
এক বল। চার রান। মাহমুদ উল্লাহ কি পারবে?
কেন যেন মাসুমের বাংলাদেশ-ভারতের সেই টি-টোয়েন্টির কথা ঘুরতে লাগল, তিন বলে সেবার দুটো রান নিতে পারেনি মুশফিক-মাহমুদ উল্লাহ। আবার কোনবার যেন শ্রীলংকার বিপক্ষে এই মাহমুদুল্লাহ-ই শেষদিকে নার্ভ ঠান্ডা রেখে চার-ছয়ের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। কোন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে আজ?
এক দৃষ্টিতে ক্রীজের দিকে চেয়ে রইলেন মাসুম।
জাম্পা এগিয়ে আসছে। এইতো হাতটা ঘোরাল, বলটা ছাড়ল, ব্যাট ঘোরাল মাহমুদ উল্লাহ…
-জিতে গেছি। ইয়ে…
ইন্সপেক্টর মাসুমের ঘোর ভাঙল কারও বিজয়োল্লাস শুনে।
দ্রুত ফিরলেন সেদিকে। গ্যালারীর শেষ মাথায় বছর দশেকের স্কুল ড্রেস পড়া একটা ছেলে দুই হাত শূন্যে তুলে দিয়ে লাফাচ্ছে আনন্দে, নিজের দুই চোখ মুছতে মুছতে তার দিকে দৌড়ে চলেছেন মিসেস আমজাদ। কোন সন্দেহ নেই, এই ছেলেটিই শাকির-মিস্টার এন্ড মিসেস আমজাদের আদরের সন্তান।
সাথে সাথে স্নায়ুগুলো সব সতর্ক হয়ে উঠল মাসুমের। কিডন্যাপার কোথায়? শাকিরের আশেপাশে?
সাথে সাথে শরীরের সব শক্তি দিয়ে শাকিরকে লক্ষ্য করে দৌড়াতে শুরু করলেন তিনি। দায়িত্ব ভুলে হঠাৎ করে খেলায় ডুবে যাওয়ার জন্য নিজেকে গালিও দিলেন কয়েক দফা।
ইতিমধ্যে শাকিরকে জড়িয়ে ধরেছেন মিসেস আমজাদ, কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে ক্রমাগত চুমু দিয়ে যাচ্ছেন।
-কাউকে দেখেছেন? মাসুম জানতে চাইলেন। দৌড়ানোর ফলে নিঃশ্বাসের ক্রমাগত ওঠানামা নিজেই টের পাচ্ছেন তিনি।
না-সূচক মাথা নাড়লেন মিসেস মাসুম।
আর কোন প্রশ্ন করার সুযোগ পেলেন না মাসুম, তার আগেই একটা ছেলেকে এগিয়ে আসতে দেখলেন তাদের দিকে।
-স্যার, গ্যালারী এখন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ দর্শকদের জন্য। আপনারা ভেতরে ঢুকলেন কিভাবে?
স্টেডিয়াম সিকিউরিটি? হতে পারে।
মাসুম নিজের আইডি কার্ড উচিয়ে ধরলেন। অন ডিউটি পুলিশ।
ছেলেটা আর কোন প্রশ্ন করল না, সরে গেল তাদের কাছ থেকে।
শাকিরের দিকে ফিরলেন মাসুম।
-বাবা শাকির।
-জ্বি আংকেল।
-তুমি এখানে কি করছিলে?
-আম্মুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
-একা একা ভয় পাওনিতো?
-নাহ। ও তো বললই আম্মু আমাকে নিতে আসবে।
-ও? কার কথা বলছ?
-যে আংকেলটার সাথে তুমি এখন কথা বললে।
হোয়াট?
মাসুম চারপাশে তাকালেন। টাকাভর্তি ব্যাগটা ফ্লোরে রেখে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছিলেন মিসেস আমজাদ, ওটা নেই। সেইসাথে গায়েব হয়ে গেছে মাসুমের সার্ভিস রিভলবার আর ওয়াকিটকি!
নিশ্চয়ই কথার ফাকে কোন এক সময় ওগুলো হাতিয়ে নিয়েছে লোকটা, টেনশানে বুঝতেই পারেন নি মাসুম।
স্টেডিয়াম থেকে দ্রুত বের হয়ে এলেন মাসুম। তাতে কোন লাভ হল না, গতির ঝড় তুলে একটা গাড়িকে বেরিয়ে যেতেই দেখলেন শুধু।
শেষ মুহূর্তে কাঁচ নামিয়ে লোকটা হঠাৎ তাকাল মাসুমের দিকে। বোঝা না গেলেও মাসুম ঠিকই জানেন, হুডি, সানগ্লাস আর মাস্কে ঢাকা চেহারার পেছনে একটা হাসি আছে। সেই হাসি উপহাস করছে মাসুমকে, পুরো সিস্টেমকে।

-আমি তুমি আমরা
০২/০৮/২০২১
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০২১ বিকাল ৩:১৭
১২টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×