শুরুতে স্পোর্টিং লিসবন দলের
আক্রমণভাগে খেলতেন
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। কিন্তু
ম্যানেজার
তাঁকে একপর্যায়ে নামিয়ে আনলেন
লেফট উইংয়ে। যুক্তি হলো, ওই
জায়গায় নিজের দুরন্ত
গতিকে কাজে লাগিয়ে মাঠের
বাঁ দিক থেকে ত্বরিত
আক্রমণে সেরা সাফল্য
তুলে নিতে পারবেন
রোনালদো। তা ছাড়া তাঁর
তখনকার হালকা গড়নটাও
প্রতিপক্ষের মাঝমাঠের
শক্তিশালী খেলোয়াড়দের
সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট
উপযোগী ছিল না। মোটেও হতাশ
করেননি রোনালদো। ক্ষিপ্রতা আর
বলের ওপর অসাধারণ নিয়ন্ত্রণের
পাশাপাশি প্রতিপক্ষের রক্ষণদুর্গ
ভেঙে ফেলার
কাজে তাঁকে দেখা গেল দুর্দান্ত।
২০০২ সালের ৩ আগস্ট স্পেনের
সেভিয়ার ক্লাব রিয়াল বেটিসের
বিপক্ষে একটি ম্যাচের ৭৭
মিনিটে মাঠে নামেন ১৭ বছর
বয়সী রোনালদো। ৮৪তম
মিনিটে স্কোর ২-২। খেলা গড়ায়
অতিরিক্ত সময়ে। প্রতিপক্ষের
খেলোয়াড় হুয়ানিতো এক
সতীর্থের ফ্রি-কিক
থেকে বাধা পেয়ে ফিরে আসা বলটি বুকে নিলেন,
কিন্তু নিয়ন্ত্রণ হারালেন।
সুযোগটা হাতছাড়া করলেন
না রোনালদো৷ নিমেষেই
বলটি গোড়ালির পেছনের অংশ
দিয়ে টেনে নিজের
সামনে নিয়ে লেফট
উইং ধরে বিদ্যুৎবেগে ছুটলেন
গোলপোস্টের দিকে।
ড্রিবলিংয়ের জাদুতে বেটিসের
গোলরক্ষককে ধোঁকা দিয়ে বাঁ দিকে প্রায়
অসম্ভব এক কোণ
থেকে গোলপোস্টের অপর কোণ
লক্ষ্য করে শট নিলেন। রক্ষণভাগের
একজন ছুটে গিয়ে বলটি আটকানোর
নিষ্ফল চেষ্টা করলেন। দর্শনীয় সেই
গোলের
মাধ্যমে রোনালদো বুঝিয়ে দিলেন,
তিনি জাত খেলোয়াড়। সামর্থ্য,
কৌশল, নিয়ন্ত্রণ, এবং প্রতিভায়
তিনি সেরাদের একজন৷ গোলবক্সের
ভেতরে দেখাতে পারেন সহজাত
তাৎক্ষণিক তৎপরতা। পর্তুগিজ
সংবাদমাধ্যম রোনালদোর
গোলটিকে ‘শিল্পকর্ম’ আখ্যা দেয়।
আর তিনি গোলটি উৎসর্গ করেন
নিজের পরিবারকে, বিশেষ করে,
মাকে। মাঠে বসেই ছেলের সেই
গোল উপভোগ করেছিলেন
দোলোরেস।
এরপর একের পর এক ম্যাচে নিজের
ফুটবলশৈলীর ঝলক
দেখাতে লাগলেন রোনালদো।
অল্পবয়সী বলে তাঁকে আর কেউ
উপেক্ষা করেনি। ২০০২ সালের ৭
অক্টোবর পর্তুগিজ সুপার লিগার
খেলায় মোরিয়ারেনস
এফসি ক্লাবের
বিপক্ষে স্পোর্টিং লিসবনের
ম্যাচে তিনি দেখান তাক
লাগানো নৈপুণ্য৷
পাশাপাশি দৃষ্টিনন্দন একাধিক
গোলও করেন।
সংবাদপত্রগুলো পরদিন প্রথম পাতায়
ছবিসহ ফলাও করে ছাপে সেই
খেলার খবর। উদীয়মান
তারকা খেলোয়াড়টির বাড়িঘর,
এলাকা, শৈশব ও প্রথম ফুটবল কোচের
সন্ধানে তৎপর হন সাংবাদিকেরা।
রোনালদোর দরিদ্র
বাবা জোসে দিনিস
মাদেইরা দ্বীপে বসেই ৭
অক্টোবরের ম্যাচটির ধারাভাষ্য
শুনেছিলেন রেডিওতে। ছেলের
সাফল্যের গল্প তিনি করেন
প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে।
তাঁর মনে পড়ে,
ছেলেটি কীভাবে একেবারে শৈশব
থেকেই ফুটবল নিয়ে মেতে থাকত৷
বাবার স্বপ্ন, ছেলেটার ভবিষ্যৎ
উজ্জ্বল হবে। আর সে যত বড়
খেলোয়াড়, তার চেয়েও বড় মানুষ
হবে। রোনালদোর পরের
ম্যাচটি অবশ্যই
তিনি দেখতে যাবেন। আর সে জন্য
লিসবনে যাওয়ার বিমান টিকিটও
কিনে ফেলেন। ছয় বছরের মধ্যে এই
প্রথম তাঁর রাজধানীযাত্রা!
এদিকে রোনালদোর খ্যাতি তখন
পর্তুগালের সীমানা ছাড়িয়েছে।
ইউরোপজুড়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়
নবাগত এই সম্ভাবনাময় তরুণ
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
ফুটবলারকে নিয়ে। ‘নতুন
রোনালদোকে’ নিয়ে প্রথম পাতায়
প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইতালির
পত্রিকা গাজেত্তা দেল্লো স্পোর্ত।
নান্দনিক খেলা দেখিয়ে ভক্তদের
হৃদয়ে ঠাঁই করে নেন ‘সোনার
ছেলে’ রোনালদো। তাঁর ওপর গভীর
আস্থা দলের কোচ
লাজলো বোলোনির। তবে প্রথম
একাদশে ঠাঁই পেতে সতীর্থ
জার্দেল, কারেসমা, জোয়াও
পিন্তো, তনিতো আর নিকুয়ালের
সঙ্গে লড়াইও করতে হয়
রোনালদোকে। মৌসুমে মোট
২৫টি ম্যাচে খেলার সুযোগ পান
তিনি। এর মধ্যে মাত্র ১১টি খেলায়
তিনি শুরু
থেকে মাঠে নামতে পেরেছিলেন।
লিগে দুটি আর কাপে একটি গোল
করেন তিনি। সব
মিলিয়ে মৌসুমটা স্পোর্টিং লিসবনের
অনুকূলে ছিল না। চ্যাম্পিয়নস লিগ
আর ইউইএফএ কাপ দুই আসর থেকেই
দলটি ছিটকে পড়ে। দলীয় সাফল্য যত
কমই হোক, শিষ্য ক্রিস্টিয়ানোর
প্রশংসায় পঞ্চমুখ বোলোনি,
‘ওকে ছাড়া আমরা দ্বিতীয় সারির
দলে পরিণত হতাম।’
এরপর পর্তুগাল অনূর্ধ্ব-২০ দলে খেলার
সুযোগ পান রোনালদো। তত
দিনে মাদেইরার
ছেলেটিকে দলে নিতে আগ্রহ
দেখায় ইউরোপ তথা বিশ্বের
সবচেয়ে বড় ক্লাবগুলো৷ সেই
তালিকায় রয়েছে আর্সেনাল,
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড,
লিভারপুল, চেলসি, জুভেন্টাস,
পার্মা, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ,
বার্সেলোনা,
ভ্যালেন্সিয়া ইত্যাদি।
যুক্তরাজ্যের একাধিক ক্লাব
থেকে তাঁকে নিতে বড় অঙ্কের
অর্থের প্রস্তাবও আসে।
তবে রোনালদোর ভাবনায় ইংলিশ
ফুটবলের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকলেও
তাঁর হৃদয়টা আসলে স্প্যানিশ
ফুটবলে অনুরক্ত। এ
ছাড়া তাড়াহুড়ো করে স্পোর্টিং লিসবন
ছাড়ার তেমন খেয়ালও ছিল
না তাঁর।
২০০৩ সালে ফ্রান্সের তুলুস
টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনার
অনূর্ধ্ব-২০ দলকে একটি ম্যাচে ৩-০
গোলে হারিয়ে দেয় রোনালদোর
পর্তুগাল। পরের
একটি ম্যাচে দলটি জাপানের
কাছে হেরে যায়। তারপর
তুরস্ককে হারিয়ে টুর্নামেন্টের
ফাইনালে পৌঁছে যান
রোনালদোরা।
শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচটিতে ইতালির
বিপক্ষে মনে রাখার মতো একটি জয়
(৩-১) পায় পর্তুগাল। দেশটির
সংবাদমাধ্যমে দলটির
ভূয়সী প্রশংসা করে বলা হয়, লুইস
ফিগো ও রুই কস্তার
উত্তরসূরিরা গড়ে উঠছে ঠিকমতোই।
তরুণ ফুটবলারদের
দলটি দেশে ফিরে পায় বিপুল
সংবর্ধনা। তবে দলের
সঙ্গে দেশে না ফিরে রোনালদো থেকে যান
ফ্রান্সে। সেখানে মা ও বোনের
সঙ্গে ছুটি কাটান । তারপর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের
সঙ্গে স্পোর্টিং লিসবনের পক্ষে ৬
আগস্ট একটি প্রীতি ম্যাচ খেলেন৷
তাঁর জীবনে একটি অপ্রত্যাশিত
বাঁক আসে এরপরই ।
সেই গল্প আরও রোমাঞ্চকর৷
সূত্র: বিভিন্ন সময়ে প্রথম আলোয়
প্রকাশিত প্রতিবেদন, একাধিক
ওয়েবসাইট ও লুকা কাইয়োলির বই

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।






