somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জার্মানিতে আক্রান্ত মুসলিম অভিবাসী- আমাদের করণীয়

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফ্রাঙ্কফুর্ট নগরীর সন্নিকটে হ্যানাও শহরে সম্প্রতি একটি শিশা বারে মর্মান্তিক যে হামলায় নয় জন মুসলিম অভিবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাতে জার্মানিতে ঘৃণাভিত্তিক আক্রমণের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। জার্মান সরকারের হাতে এই মুহুর্তে বারো হাজার সাতশ উগ্র ডানপন্থীর তালিকা রয়েছে। যেকোনো মুহুর্তে এদেরই কেউ হ্যানাওএর থেকেও বড় দানব হয়ে হাজির হতে পারে।

ঘৃণাবাদী কাপুরুষোচিত হামলা জার্মানিতে গত এক দশকে আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালে ড্রেসডেন শহরে কোর্টে শুনানি চলাকালীন ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় মারওয়া শারবিনি নামের এক মিশরীয় নারীকে। এলেক্স নামের এক রাশিয়ান বংশোদ্ভূত জার্মান তাঁকে হত্যা করে। আঠারো বছরের এক ইরানি বংশোদ্ভূত জার্মান ২০১৬ সালের জুলাই মাসে মিউনিখে এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করে দশজনকে, আহত হয় ৩৬ জন। এসেন শহরে গেল নতুন বছর বরণের রাতে পঞ্চাশ বছর বয়সী এক জার্মান ব্যক্তি তার গাড়ি তুলে দেয় কিছু সিরিয়ান-আফগান জমায়েতের উপর। মারাত্মক আহত হয় আটজন। এছাড়াও ভিন্নবর্ণ ভিন্নগোত্র বা হিজাব পড়া দেখলে নানাবিধ কটূক্তি পথে ঘাটে হামেশা ঘটেই চলেছে। নব্য নাৎসিদের স্বর্গরাজ্য ড্রেসডেন শহরে এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীর গায়ে হাত তোলার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল এই কিছুদিন আগেই।

এসব আক্রমণকারীদের আবার নানা আয়োজন থাকে। তারা রাজনৈতিক নেতাদের মত হামলার আগে ইশতেহার প্রকাশ করে। হ্যানাও শহরের এই খুনিও করেছে। ২০১১ সালের ২২ শে জুলাই শান্তির দেশ নরওয়ের এক ছোট্ট দ্বীপে এক খৃষ্টান জঙ্গি গুলি করে হত্যা করে ৬৯ জন কিশোর-কিশোরী সহ মোট ৭৭ জন নিরাপরাধ মানুষকে। হামলার আগে ভ্রেইভিক নামের ওই খুনি ১৫১৮ পৃষ্ঠার একটি মেনিফেস্টো প্রকাশ করে যাতে দেখা যায়, ইউরোপ থেকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য(Diversity) আর ইউরোপের ইসলামীকরণ রোধ করাই ওর জীবনের ব্রত ছিল।

একাকী নেকড়েদের (Lone wolf) এরকম হঠাৎ আক্রমণ থেকে আমরা নিজেদের কিভাবে রক্ষা করতে পারি? মুসলিমরা কি তবে মসজিদে যাওয়া বন্ধ করে দিবে? লাইপজিগের পাশে হালে শহরে ইহুদি উপাসনালয়ে হামলা চালিয়ে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে, তাহলে কি ইহুদিরা সিনাগগে যেতে পারবে না? মুসলিম মহিলারা যারা হিজাব পরিধান করে, নিরাপত্তার কথা ভেবে কি তবে তারা নিজেদের স্বাধীনমত পোশাক পরবে না? পৃথিবীতে এমন কী প্রসাধনী আছে যা মেখে আফ্রিকানরা চোখের পলকে সাদা হয়ে জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হবে শ্বেত-শ্রেষ্ঠ্যত্ববাদীদের ভিড়ে মিশে?

আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে এই ঘৃণ্য মানসিকতার জঙ্গিরা আসলে কি চায়। তারা চায় ভীতি ছড়াতে। সহজ কথায় বলতে গেলে, উদাহরণস্বরূপ, একজন হিজাবধারী মুসলিম নারীর উপর কেউ হামলা করলো, সেটা দেখে ভয় পেয়ে সবাই না হলেও অন্তত দশজন নারী হিজাব পরিত্যাগ করলো। এতে করে ওই হামলাকারীর জয় হলো। আপনার ধর্ম বিশ্বাস, আপনার পোশাক আপনার ধর্মীয় পরিচয়ই শুধু বহন করে না, এটা আপনার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অংশও। যারা মসজিতে যান, তারা অবশ্যই মসজিদগমন বন্ধ না করে বরং বাড়তি সতর্কতা নিতে পারেন। মুল ফটকের সামনে নিরাপত্তা বাড়ানো যেতে পারে। মিশর পাকিস্তান আফগানিস্তানে মুসলিম জঙ্গিদের যেমন মূল টার্গেট থাকে একটি হামলা করেই অধিক ভিন্নধর্মের মানুষকে হত্যা করা, তেমনি ইউরোপীয় খৃষ্টান জঙ্গিদের উদ্দেশ্য থাকতে পারে এক আঘাতেই যাতে অধিক মুসলিম, ইহুদি বা বিদেশীদের হত্যা করা যায়। একারণে মুসলিমরা প্রতি শুক্রবারে নামাজের আগে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে অন্তত নামাজ চলাকালীন প্রশাসনিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারেন। মনে রাখবেন, ধর্মবিশ্বাস আপনার মানবাধিকার। কতিপয় দুর্বৃত্তের হঠকারিতায় আমাদের কারোরই উচিত হবে না আমাদের অন্তরের বিশ্বাস, ভালবাসা আমাদের নিজস্বতার বহিঃপ্রকাশ হতে নিজেদের দূরে রাখা।



ঘৃণার পৃথিবীতে আমাদের করণীয় কি?

নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ঘৃণা, জিঘাংসা আর অন্যায্যতায় পূর্ণ এই পৃথিবীতে মানুষের মনে ঔচিত্যবোধ জাগ্রত করতে আমাদের প্রতিটি মানুষের করণীয় বহু। আমাদের কার কথায় কীভাবে কোন দিক দিয়ে ন্যুনতম হলেও কোন ব্যক্তি মানুষ বা জাতিগোষ্ঠীর প্রতি আমাদের ঘৃণা- বিদ্বেষ প্রকাশ প্রায় সেটি খেয়াল করে চলতে হবে। সেই অপছন্দের মানুষ বা জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের রাজনৈতিক বা ধর্মীয় আদর্শ নিয়ে কড়া সমালোচনা করা যেতে পারে, কিন্তু সেই মানুষের প্রতি ঘৃণা বা অসম্মান প্রদর্শন এক ক্ষমাহীন অপরাধ। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক (Inclusive) সমাজব্যবস্থার ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া মানবজীবনের আর কোন সাধনাই সাধনা নয়। শুভবাদী, নীতিবাদী অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাসীরা বর্ণে-লিঙ্গে-ধনী-দরিদ্রে-ধর্মে-অধর্মে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে পুঙ্খানু সমতা, বৈষম্যহীনতায় বিশ্বাস করে। তারা কামনা করে পৃথিবীর সর্বত্র ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থা চালু হোক। হোক তা মুসলিম সংখাগরিষ্ঠ, হোক তা খ্রিষ্টান ইহুদী বা হিন্দু মানুষের দেশ। বিভাজন আর ঘৃণার মতাদর্শকে বুকে লালন করে, একটি প্রীতিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষাকে আহত করে এই পৃথিবী নামক নীল গ্রহের বেদনাকে আরও বাড়িয়ে আমরা একদিন বিদায় নিব, তা যেন না হয়।

বিভাজন, অনৈক্য, ধর্মীয় ভেদাভেদ, লৈঙ্গিক বৈষম্য, হিংসা-বিদ্বেষ, কলুষতা ভুলে সত্য-সুন্দর-সৌন্দর্য আর শান্তির প্রতি সমর্থনের হাত সর্বদা প্রসারিত রাখা একজন আধুনিক শান্তিবাদী উদার সংস্কৃতিবান মানুষের অবশ্যপালনীয় দায়িত্ব। আর এভাবেই মানুষ শুধুমাত্র একটি সুনির্দিষ্ট সীমানার নাগরিক না হয়ে, হয়ে উঠতে পারে শান্তির পৃথিবীর নাগরিক।

ধন্যবাদান্তে
জাহিদ কবীর হিমন
বার্লিন থেকে
২২.০২.২০২০
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৫১
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×