somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডাঃ জাফরুল্লাহর চিঠি আর শেখ হাসিনার জবাব

১৫ ই আগস্ট, ২০২০ ভোর ৬:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী গত ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। সেই চিঠির জবাব শেখ হাসিনা যেভাবে দিতে পারেনঃ

প্রিয় জাফর ভাই,
প্রথমেই দুঃখ প্রকাশ করছি আপনি আমার সাক্ষাৎ চেয়েও পাননি, যার ফলশ্রুতিতে আপনাকে একটি খোলা পত্র লিখতে হল বলে। আপনার পত্র আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে এবং সেটির জবাবেই দু'কলম লিখতে বসতে হল।

আপনি আমাকে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের নতুন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ সুবিধাসমেত জেনারেল ওয়ার্ড উদ্বোধন করতে দাওয়াত করেছেন এবং বিনয়ের সঙ্গে আমাকে না করতে হচ্ছে। করোনার দরুণ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সকল কাজ গণভবন থেকে সম্পন্ন করতে হচ্ছে বিধায় এই মুহুর্তে আমি সেটি উদ্বোধন করতে অপারগ।

আশাকরি আমার এই অপারগতা আপনি নিশ্চয়ই আপনার প্রতি গুরুত্বহীনতা হিসেবে ধরে নিবেন না। সম্প্রতি আপনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর আমি নিজে ঢাকা মেডিকেলে একটা পুরো কেবিন সার্বক্ষণিক বরাদ্দ রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলাম। আপনি আপনার প্রতিষ্ঠানেই চিকিৎসা নিতে অধিক আগ্রহী ছিলেন। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান জানাতেই এই প্রয়াস আমি নিয়েছিলাম।

জাফর ভাই, আপনি আমাকে ঈদের দিন খালেদা জিয়ার সাথে তাঁর বাসায় গিয়ে দেখা করতে অনুরোধ করেছেন। একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয় যে, ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে যখন একদিকে জামাতিদের পেট্রোল বোমায় সারা দেশ পুড়ছিল, ততদিনে প্রায় তিরিশজনের মতো পুড়ে মরেছে, ঠিক তখন হঠাৎ বেগম জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র মারা গেলে আমি শোক জানাতে গেলাম গুলশানের ৮৬ নম্বর বাসায়। জাফর ভাই, আমি কিন্তু একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী, একটি জাতির প্রতিনিধি, তদুপরি আমাকে দুয়ার থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালে আমার সদ্য বৈধব্যবরণের প্রাক্বালে তিনি আমার সুধাসদনের বাসায় এসে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন, দুয়ার থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার মতো বহু কারণ আমার ছিল। তা স্বত্বেও আমার পক্ষে সেই রুচিহীন কাজটি করা সম্ভব হয়নি।

প্রিয় জাফর ভাই, সেই বহু কারণগুলি কী কী, তা কি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে? আপনি বহুদিন যাবৎ বেগম জিয়ার উপদেষ্টা, সেই দিক বিবেচনায় রেখে আমি ধারণা করছি সেই কারণগুলি হতে কতিপয় কারণ আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে।

স্মৃতি যদি আপনার সাথে বেঈমানি না করে থাকে, আপনি যদি বিস্মরিত না হয়ে থাকেন, তাহলে বলি, ১৯৭৫ সালে আমার পরিবারের সবাইকে নৃশংসরুপে হত্যা করা হয়েছে। আমার পিতামাতা, সন্তানতুল্য ভাই শিশু রাসেল সহ আমার পরিবারের সবাইকে গুলি করা হয়। এর তিন মাস পর বেগম জিয়ার স্বামী জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় দখল করে সেই খুনিদের প্রথমেই বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে লোভনীয় চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে। অপরদিকে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দিয়। বাঙ্গালি জাতির পিতার সন্তান হিসেবে এইটুকু পর্যন্ত আমি সহ্য করেছি। কিন্তু আমার ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে জিয়া কবে নুনের ছিটা দিয়েছে জানেন জাফর ভাই? যেদিন জিয়া তিরিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সংসদে আইন পাশ করলো যে, পচাত্তুরের আগের হত্যার কোন বিচার করা যাবে না। আধুনিক সভ্য কোন রাষ্ট্রে সংসদে আইন করে হত্যার বিচার রোধ করাকে যদি আপনি ঠিক কীভাবে দেখেন?

এরপর এরশাদের জামান পেরিয়ে দেশ যখন সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করলো তখন প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্রের বিয়েতে গিয়েছি ১৯৯৩ সালে, তাঁর সাথে আমার দেখাও হয়েছে কয়েকবার। হঠাৎ একদিন শুনি উনি ১৫ আগষ্টে জন্মদিন পালন করা শুরু করবেন। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু তিনি আমার বিশ্বাসে চীড় ধরালেন, তিনি ঢাউস আকারের কেক কেটে কুৎসিত আনন্দে মেতে উঠা শুরু করলেন। জাফর ভাই, ধরে নিন আমার হৃদয় পাথর দিয়েই গড়া, তবু কি সেই পাথরের হৃদয় ফুটে ঝরনা প্রবাহিত হবে না যদি দেখি আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী আমাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে আমার কঠিনতম শোকের দিনে উৎকট আনন্দ শুরু করে?

জিয়া পঁচাত্তুরের খুনিদের যে পুরুষ্কার দিয়েছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় বেগম জিয়াও খুনি কর্নেল রশিদকে বিরোধীদলীয় নেতা করেছিল। এরপর আমি ক্ষমতায় এসে খুনিদের বিচারের ব্যবস্থা করি, কিন্তু ২০০১ সালে বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে আবার তাঁর স্বামীর দেখানো পথেই খুনিদের রক্ষা করে চলে। খালেদার নেতৃত্বে জামাতিরা যখন বলে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশকে তারা অবশ্যই আফগানিস্তান বানিয়ে ছাড়বে তখন ২০০৪ সালের আগস্টের একুশ তারিখের এক তপ্ত বিকেলে আমার উপর পড়ল এমন সব আর্জেস গ্রেনেড, যাতে মৃত্যু হল ২৪ জনের, আহত হল পাঁচ শ। জাফর ভাই, আপনি জানেন, আমাকে এর আগেও হত্যা করার বহু চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু এই একুশে আগস্টের একটি হামলাই কি দুটি রাজনৈতিক দলের মাঝে চিরতরে দেয়াল তুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। আমি নীলকন্ঠী শেখ হাসিনা, আমি বিষ খেয়ে বিষ হজম করি। এই কারণেই আজ প্রায় এগারো বছর ক্ষমতায় থেকেও বেগম জিয়ার উপর গ্রেনেড-বোমা তো দূরের কথা, একটি ককটেলও ফুটেনি। আর্জেস গ্রেনেডের তুলনায় জেল জরিমানা যদি অধিক নিষ্ঠুরতা হয়ে থাকে, তবে আমি নিষ্ঠুরই।

প্রিয় জাফর ভাই, আপনার চিঠির জবাবে এত কথা লেখার প্রয়োজন পড়তো না কারণ এসব কথা এসব ইতিহাস সবাই জানে। কিন্তু আপনি যখন বেগম জিয়াকে গ্রেনেডের বদলে ঈদের সেমাই খাইয়ে আসতে বলেন তখন আমার বলার তো কিছু থাকেই। এরপরও আপনার কাছে আমার প্রশ্ন- একজন সুবিবেচক নাগরিক হিসেবে আপনি আমার সমর্থক নাও হতে পারেন, কিন্তু ঠিক কবে থেকে আপনি এমন খুনি চক্রের সমর্থক হয়ে উঠলেন আর কেনই বা আপনার মতো মুক্তিযোদ্ধা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ এমন একটি রাজনৈতিক আদর্শের পক্ষাবলম্বী হয়ে উঠলেন যা ইতিহাসের বহু রক্তাক্ত ঘটনার জন্য দায়ী, খুনিদের সমাজে প্রতিষ্ঠাকারী, যা শুধু ধর্মে-ধর্মে বিভক্তির কথা বলে, সংখ্যাগরিষ্ঠার জোরে যারা শুধু নিজেদের মত আর আদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চায়?

শ্রদ্ধেয় জাফর ভাই, আপনার চিঠিতে আপনি বলেছেন আমি একাকী আর নিঃসঙ্গ। আমি তো নিঃসঙ্গ সেই কত যুগ ধরেই, আপনি কেন এত দেরিতে বুঝলেন আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। নিঃসঙ্গতা আরো ভর করেছে যখন ১৫ আগস্টের রাত্রি প্রথম প্রহরে আপনাকে এই পত্রটি লিখছি।

ভালো থাকবেন
শেখ হাসিনা
১৫ আগস্ট ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০২০ ভোর ৬:১৯
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×