করোনার আগে যখন মনের আনন্দে থাইল্যান্ড চষে বেড়াচ্ছিলাম তখন সুরাট থানি প্রদেশের বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র কোহ সামুইও যুক্ত ছিল। আমরা যখন গিয়েছিলাম সে সময় ছিল চীনা নববর্ষের ছুটি। চাইনীজ অধ্যুষিত কোহ সামুই দ্বীপটিতে চীন থেকে আসা চীনা পর্যটকরা যেন গিজ গিজ করছিল। ব্যাংকক থেকে সুরাট থানি প্লেনে গিয়েও সারাদিন লেগেছিল কোহ সামুই পৌছাতে । সেইদিন রেষ্ট নিয়ে পরদিন ভোর থেকেই সামুইর বিখ্যাত মেরিন পার্কের ঘুর ঘুর করে সন্ধ্যায় ফিরেছি।
তারানিম ম্যাজিক পার্কে এক দুরিয়ান চাষীর নির্মিত সব ভাস্কর্য্যের একটি নমুনা
পরদিন নিজেরাই ট্যাক্সি ভাড়া করে সামুইর সর্বোচ্চ পাহাড় চুড়ায় পাথরে নির্মিত ব্যাতিক্রমী সাথে অনিন্দ্য সুন্দর সব ভাস্কর্য্য আর কুটিরে সাজানো তারানিম ম্যাজিক পার্ক দেখতে গিয়েছিলাম এ বিষয় নিয়ে আমি আগেই ব্লগে লিখেছি। সেখান থেকে যখন কোহ সামুইর বিখ্যাত রিং রোড ধরে ফিরে আসছি তখন অনেক দূরে দিগন্ত রেখার কাছে হঠাৎ করেই কালো রঙের এক ভয়ংকর দর্শন মুর্তির দেখা পেলাম।
পাথরের ফটকের উপর লেখা কোহ সামুইর গ্যুয়ান ইউর মন্দির
যতই কাছে আসছি ততই যেন তাঁর বিশালত্ব আরও প্রকট হতে লাগলো। আমি সামনে ঝুকে এই ব্যাপারে জানতে চাইলে আমাদের চটপটে ইংরেজীতে পারদর্শী গাড়ি চালক জানালো এটা হলো গুয়ান ইউর মন্দির, মুর্তিটা গুয়ান ইউর, আমরা কি দেখতে ইচ্ছুক ? গুয়ান ইউ কি জিনিস ! আমাদের তো কোন ধারনাই নেই, কিন্ত অচেনাকে জানার প্রবল আগ্রহ আমার তাই বার বার মাথা ঝুকিয়ে ইয়েস কা, ইয়েস কা, খাপুন কা বলে আমার আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগলাম। ড্রাইভার আমার অবস্থা দেখে একটু হেসে মন্দিরের সামনে এসে বাদিকে টার্ন নিয়ে জায়গামত গাড়ি থামালো।
ছোটখাটো এই মন্দিরের আঙ্গিনার শেষ সীমানায় বসে আছেন ভয়ংকর দর্শন গুয়ান ইউ
গেটের কাছে গাড়ি থামতেই আমি ছোট্ট আংগিনা পেরিয়ে সেই বিকট দর্শন মুর্তির সামনে এসে দাড়ালাম। বিশাল একটি স্তম্ভের উপর তাঁর চেয়েও বিশাল এই চৈনিক মুর্তিটি মুল মন্দিরের প্রধান প্রবেশ মুখের সামনে নির্মিত। দেখলেই মনে হয় যেন ছাদের উপর বসে আছে।
ছবিটি অনেক কাছ থেকে তোলা হয়েছে, এখানে বোঝা যাচ্ছে তাঁর প্রকান্ডতা
কালচে সবুজের উপর স্বর্নালী ধাতু্র অস্ত্রে সাজানো সামরিক পোশাক পরে বসা বিখ্যাত সেনাপতি গুয়ান ইউ যিনি ইউ শাং বলেও পরিচিত। তাঁর বা হাতে স্বর্নালী রংগের একটি বই না কি যেন বুঝতে পারলাম না, ডান হাত দিয়ে তিনি তাঁর দীর্ঘ দাড়ি ধরে রেখেছেন। একটা জিনিস অবাক লাগলো যে কাছে আসার পর তাঁকে কিন্ত অতটা ভয়ংকর দর্শন লাগছিলো না যা দূর থেকে লাগছিলো।
গেটের পরে ভেতরে ঢোকার পর মন্দিরের দিকে দুদিক দিয়ে চলে গেছে এমন সুদৃশ্য সিলিং সহ করিডোর
গুয়ান ইউর ভাস্কর্য্যের সামনে তিন খন্ড কালো মার্বেল পাথরের উপর স্বর্নালী অক্ষরে লেখা আছে তাঁর পরিচিতি আর সংক্ষিপ্ত জীবনী। ১৬০ খৃষ্টাব্দে বর্তমান চীনের সাংশি প্রদেশে এক শিক্ষিত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহন করেন। পরবর্তীকালে চীনের বিখ্যাত থ্রী কিংডম বা ইস্টার্ন হান রাজত্বকালে তিনি নিজেকে বিখ্যাত এক সেনাপতি ও সমর নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
চারিদিকে এমন লাল পতাকায় শোভিত
তাঁর ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তবে সামরিক ও বেসামরিক বিষয়ে তাঁর প্রভুত জ্ঞ্যান, তার সমর কুশলতা, তাঁর সত্যবাদিতা, তাঁর বিশ্বস্ততা, তাঁর ধর্মপরায়নতা এই সব কিছু গুনাবলীর জন্য চীনারা তাকে যুদ্ধের এক মহান দেবতা হিসেবে গন্য করেন। আর এই কারনেই বিভিন্ন দেশের তাও, কনফুসিয়ান ও বুদ্ধ মন্দিরগুলোতে তাঁর ছবি দেখা যায় এবং সেখানে তিনি পুজিত হয়ে থাকেন। ২২০ খৃস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে এই মহান সমর নায়ক গুয়ান ইউর মৃত্যু হয়।
ছাদ থেকে ঝুলে আছে সুদৃশ্য লাল চাইনীজ বাতি
কোহ সামুইতে প্রচুর চীনাদের বসবাস তাই তারা এই বিখ্যাত যোদ্ধার স্মরনে ১৬ মিটার উচু এই মন্দির নির্মান করেছে যা দূর থেকেও মানুষের নজরে পরে। সামুইর পর্যটকদের কাছে এক আকর্ষনীয় স্থান বলে বই এ উল্লেখ থাকলেও সেদিন আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ ছিল না। হয়তো বিকেলের দিকে আসে আমরা তো গিয়েছিলাম সেই ভর দুপুরে।
বিয়ের আয়োজন চলছে। আখ গাছটা দেখা যাচ্ছে এটা বরযাত্রীর সামনে দুজন ব্যাক্তির হাতে থাকে কনের বাড়ীতে যাবার সময়, তারপর গেট ধরা সেই আমাদের মতই সব কিছু।
এই মন্দিরের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এখানে চীনা পরিবারগুলো তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করাকে গুরুত্বপুর্ন বলে মনে করে থাকে। বর বধু ছাড়াও আমন্ত্রিত অতিথিরাও এখানের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে আগ্রহী কারন এখানে এসে তারা গুয়ান ইউর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারে যিনি কি না তাদের কাছে চুড়ান্ত সততা এবং আনুগত্যের প্রতীক। আমরা যেদিন গিয়েছিলাম সেদিনও মনে হয় কোন বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রস্ততি চলছিল যা সেদিনের সাজসজ্জা থেকে ধারনা করেছিলাম।
মন্দিরের ভেতরে অপরূপ নকশা যা চীনা শিল্পকলাকে প্রতিনিধিত্ব করছে
লাল মুখের বিশাল দেহী গুয়ান ইউর মুর্তিটি ছাড়াও মন্দিরের ভেতরে সোনালী রঙের চৈনিক নকশায় অপরূপ কারুকাজ, চাইনীজ ক্যালিগ্রাফি দেখে মুগ্ধতার সাথে বিস্ময়ও মিশে ছিল আমার। নকশা করা বিশাল ড্রাম নানা রকম বাতির শেড আর ব্যানার ঝুলছিল ছাদ থেকে যা হচ্ছে সুপ্রাচীন চাইনীজ ঐতিহ্য। এখানে বলতে হয় যে চীনাদের কাছে লাল মুখ আনুগত্য আর ধার্মিকতার প্রতীক।
ঐতিহ্যবাহী চীনা সাজসজ্জা
হঠাৎ করেই এই ঐতিহবাহী স্থাপনাটি দেখা হলো যে সম্পর্কে আমাদের আগে কোন ধারনাই ছিল না। আপনারাও কোহ সামুই গেলে একে দেখে আসতে ভুলবেন না। আর গুয়ান ইউর মুর্তিটি এতই বিশাল যে আমার মোবাইলে তা ধারন করা সম্ভব হয় নি ।
মন্দিরের ভেতরের ১টি ছবি ছাড়া সব আমার মোবাইলে তোলা
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৩৭