২০১৩ সালে তিন মাসের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলেম মার্কিণ মুলুকে। সফরের এক পর্যায়ে পাঁচ দিনের জন্য ফ্লোরিডার নেপলসে, এক বাল্যবন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলাম তার বহুদিনের বকেয়া আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে। সেখানে থাকতেই, গত ২৭ মে ২০১৩ তারিখে তার এক মিসরীয় বন্ধুর অকস্মাৎ মৃত্যুর খবর আসে। দাফন হবে ‘টাম্পা বে’ এর কাছে, ‘স্কাইওয়ে মেমোরিয়াল গার্ডেন্স’ এর এক সমাধিস্থলে, শ্যামলিমায় ঘেরা একটি নীরব প্রান্তরে।
সেটা ছিল বন্ধুর বাড়ি থেকে প্রায় ঘন্টা তিনেকের ড্রাইভ। বব গ্রাহাম সানশাইন স্কাইওয়ে ব্রীজের পর আরো কিছুদূর যেতে হয়। দুই একবার পথ ভুল করাতে সেখানে পৌঁছে দেখি দাফন-পর্ব প্রায় শেষের পথে, মাটি দেওয়া হচ্ছে। মরহুম ব্যক্তি জীবনে নিঃসঙ্গ ছিলেন। তার অস্ট্রিয়ান বিমানবালা স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ হবার পর বহুবছর ধরে একাই নেপলসে থাকতেন। আর বহুদিন ধরে আমার বন্ধুটির সাথে শুধু জুম্মার দিনে কাকতালীয়ভাবে পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তেন, প্রায় কোন রকম ব্যতিক্রম ছাড়াই। প্রথমে এভাবেই তাদের মাঝে অল্প স্বল্প সখ্য গড়ে ওঠে, তারপরে আরও জানাশোনা এবং তারও পরে সেটা বন্ধুত্বের পর্যায়ে চলে যায়। এটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে প্রথমদিকে কোন মেলামেশা ছাড়াই শুধু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সাপ্তাহিক জুম্মার নামাজ আদায় করার মাধ্যমেই এ বন্ধুত্বের ভিত্তি রচিত হয়েছিল।
‘স্কাইওয়ে মেমোরিয়াল গার্ডেন্স’ এর এক কোণের সেই নিঝুম নিরিবিলি ক্ববরস্থানে গিয়ে আমিও একমুঠো মাটি তার ক্ববরে ছড়িয়ে দিলাম, আর শান্তি কামনা করলাম সেখানে শায়িত সকলের জন্যে। অনতিদূরেই একটি সমাধিফলক নজর কেড়ে নিল। সমাধিফলক না বলে বলা উচিৎ কালো মার্বেল পাথরে উৎকীর্ণ একটি নামফলক, কবরের উপরে সেঁটে দেওয়া। সবুজ ঘাসে প্রায় চাপা পড়া সে প্রস্তর ফলকে উৎকীর্ণ ছিল সম্ভবতঃ এক বাঙালী মায়ের নাম, ‘নাজমা বেগম – জন্ম মার্চ ২৩, ১৯৩৭ – মৃত্যু অগাস্ট ১১, ২০১১’ (ইংরেজীতে লেখা)। জন্ম-মৃত্যুর তারিখ দেখে ঠাওর করেছিলাম, প্রায় ৭৫ বছর বয়সে এ মায়ের মৃত্যু হয় স্বদেশ থেকে দূরে, বিদেশ বিভুঁইয়ে। সেখানেই রয়ে গেছেন তিনি, চিরতরে। তিনি একজন বাঙালি মা ছিলেন, এটা ভাবতেই আমার ভাল লাগলো। কিন্তু শুধু নামেই কি একজন মানুষের সঠিক পরিচয় পাওয়া যায়? হতে পারে, নামটা কোন পাকিস্তানি, ভারতীয়, মালদিভীয়, ব্রুনীয়, মালয়েশীয়, ইন্দোনেশীয় এমনকি ইরানী মহিলারও হতে পারে!
সেখানে অন্যান্য আরও অনেক ভিন্ন ধর্মালম্বীদেরও সমাধি ছিল। সেটি যেন ছিল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এক অনন্য নজির। ধারণা হলো, শুধু কবরস্থান পরিদর্শক, গোরখোদক আর সদ্যপ্রয়াতদের নিকটস্থ ব্যক্তিগণ ছাড়া সেখানে তেমন আর কারো যাতায়াত নেই। তাই নাজমা বেগমের কবর দেখে মনটা ব্যথিত হলো। তাঁর নামফলক দীর্ঘ ঘাসের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে দেখে মনে হলো, ব্যস্ততার এই দেশে জীবিত লোকদেরই কেউ খবব্র রাখেনা। মৃত ব্যক্তির কবরে কেই বা আসবে দু’দন্ড মৌন সময় কাটাতে! বড় হওয়া ঘাসগুলো কেটে রাখতে! হয়তো বা কেউ কখনো আসেনি, আর আসবেও না। তবে দেশে থাকলেও যে এর ব্যতিক্রম হতো, এমন কোন নিশ্চয়তাও নেই।
ব্যথিত হৃদয়ে তার প্রায় ঢাকা পরে যাওয়া কবরের ফলক থেকে আমার দু'হাতে যতটুকু পারা যায়, কিছু ঘাস উপড়ে দিলাম, চারিপাশ একটু পরিস্কার করে দিলাম। আর তার জন্য রেখে এলাম নীরব কিছু প্রার্থনা।
নেপলস, ফ্লোরিডা
ইউ এস এ
৩১ মে ২০১৩




(ইতোপূর্বে অন্যত্র প্রকাশিত)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০২১ সকাল ১১:৩৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




