somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দুটি ক্ষুদ্র সাফল্যের কথা

২৪ শে অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৪:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি গত ৪/৫ বছর যাবত “Serving The Humanity” নামের এক সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত আছি। এটা মুলতঃ কিছু প্রাক্তন এমসিসি ক্যাডেটদের নিয়ে গঠিত, যারা জনদরদী মনোভাবাপন্ন এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ পেশায় প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। এই প্রতিষ্ঠানটি এমসিসি এর বাইরেও কিছু পরোপকারী, উৎসাহী ব্যক্তিদের নিয়ে জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার দূরমুট নামক এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রথমে খুবই ছোট্ট পরিসরে একটা স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে, যার উদ্দেশ্য ছিলো এলাকার মূলতঃ নারী ও শিশুদের কাছে অন্ততঃ গড় মানের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা। এটা জানা কথা যে গ্রাম ও চর এলেকার হতদরিদ্র নারীদেরকে তাদের জীবন সংকটাপন্ন হবার আগে পর্যন্ত পরিবারের কেউ ডাক্তারের কাছে নেয়না। তাই মূলতঃ তাদেরকে লক্ষ্য করেই আমা্দের এ উদ্যোগ ছিলো। সেখানে টিনছাদসহ একটি পাকা ঘর নির্মাণ করে ক্লিনিকের কার্যক্রম শুরু করা হয়, যার জন্য জমি দান করেছে এমসিসিরই দুই প্রাক্তন ক্যাডেটের (সহোদর) পরিবার। মাত্র দশ টাকার বিনিময়ে যে কেউ সেখানে ঔষধসহ (নির্দ্দিষ্ট তালিকার অন্তর্গত) চিকিৎসা সেবা পেতে পারে। খুবই আনন্দের বিষয় যে সেখান থেকে এখন গড়ে মাসে প্রায় ১৪০০-১৫০০ রোগী চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকে, যাদের মধ্যে বেশীরভাগই হতদরিদ্র নারী ও শিশু। ঐ প্রজেক্ট থেকে সেখানে শিশুদের জন্য কৃ্মিনাশক (Deworming) কার্যক্রমও গ্রহণ করা হয়।

যাহোক, এই ক্লিনিক সম্বন্ধে জানানোটা আমার এ লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিলনা, অন্য কথা প্রসঙ্গে বলতে হয়, তাই প্রথমে এসব কথা বলে নিলাম। ক্লিনিকটার জন্য যখন একটা পাকা ঘর বানাতে হবে, তখন ইট বালু সিমেন্ট ইত্যদি কেনা হলো। দ্রুতই কাজও শুরু হলো। ইট ভাঙ্গার কাজে মূলতঃ নারী ও শিশুরা যুক্ত হলো। একজন প্রাক্তন ক্যাডেট যিনি এই প্রতিষ্ঠানের চালিকাশক্তি, ইটভাঙ্গারত সেই নারী ও শিশুদের কিছু ছবি তুলে পোস্ট করে দিলো গ্রুপ মেইলে, যেন গ্রুপের ডোনাররা কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে অবগত হন। ব্যস, এখান থেকেই শুরু হলো এক নতুন মোড়, কাজের এক নতুন শাখা। দেশী প্রবাসী ডোনাররা (এক্স ক্যাডেট, এমসিসি ও তাদের কিছু বন্ধুবান্ধব) প্রশ্ন তুলতে থাকলো, শিশুদের কেন এ কাজে নিয়োগ করা হলো। সেখান থেকেই শুরু হলো নতুন চিন্তা ভাবনা। ক্লিনিকের পাশাপাশি এই শিশুদের কাছে শিক্ষাকে কিভাবে সহজলভ্য করা যায়, সে নিয়ে চিন্তা ভাবনা। সিদ্ধান্ত হলো, এসব শিশুকে আমাদেরই উদ্যোগে স্কুলে ভর্তি করানো হবে। পাশেই একটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিলো, খুবই জীর্ণ শীর্ণ দশা। মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন করে প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলা হলো। তিনি রাজী হলেন দুপুরের পর একটি কক্ষ ছেড়ে দিতে, আমাদের ব্যবস্থাপনায় একজন শিক্ষক নিয়োগ করে সেখানে ঐসব শিশুদের জন্য ক্লাস নেয়া হবে। আমি নিজে সেখানে ব্যক্তিগত পরিদর্শনে গিয়ে অবাক হয়ে যাই গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর দৈন্যদশা দেখে। বিদ্যালয়ে মাসের প্রায় ২৮ দিনই ছাত্র বা শিক্ষক কেউই আসেনা। শুধু সরকারের ভাতা পাবার জন্য মাসে দুই একদিন এসে সবাই রেজিস্টারে সই করে যায়। বাকী দিনগুলোতে বিদ্যালয়ের মাঠে ও বারান্দায় গরু ছাগল ভাগাভাগি করে বিচরণ করে, আর শ্রেণীকক্ষ ও শিক্ষক কক্ষে কুকুর ও ছাগল ভাগাভাগি করে সুখনিদ্রা যায়।

পরের বছরই আমরা সেখানে অবস্থিত ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত একটা কিন্ডারগার্টেনের সাথে যোগাযোগ করে আমাদের শিশুদেরকে সেখানে ভর্তি করে দেই। সুখের কথা, আজ আমাদের নির্বাচিত প্রায় ৮০ জন শিশু ও বালক বালিকা সেখানে আমাদের অর্থায়নে শিক্ষালাভ করছে। আরও অনেক এক্স ক্যাডেট আরও অনেক শিশুকে স্পনসর করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে, কিন্তু ম্যানেজমেন্ট সম্ভব নয় বলে আমরা আপাততঃ আর এর কলেবর বাড়াচ্ছিনা। ভর্তি হওয়া শিশুদেরকে ফ্রী টিউশন ছাড়াও বিনামূল্যে দুই জোরা করে স্কুল ইউনিফর্ম, স্কুলব্যাগ, স্টেশনারি দেয়া হয় এবং লেখাপড়া ও খেলাধূলায় উৎকর্ষতা প্রদর্শনের জন্য বার্ষিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পুরস্কার প্রদান করা হয়। এ ছাড়া প্রত্যেক কুরবানী ঈদের সময় একটি গরু কুরবানী করে ওদের মাঝে মাংস বিলিয়ে দেয়া হয় এবং কখনো কখনো প্রীতিভোজেরও আয়োজন করা হয়। আমরা তাদের অভিভাবকগণকে তাদের শ্রম দ্বারা উপার্জিত আয় থেকে বঞ্চিত হবার জন্য ক্ষতিপূরণ অফার করেছিলাম। কয়েকমাস নেবার পরে তারা তাদের সন্তানদের অভাবনীয় সাফল্য ও পরিবর্তন দেখে কতজ্ঞতাস্বরূপ তা নিতে বিনয়ের সাথে অস্বীকৃতি জানায়। আমাদের সমাজের এই দরিদ্র শ্রেণীর আত্মসম্মানবোধ ও কৃতজ্ঞতাবোধ দেখে আমি অভিভূত হয়ে যাই। এর ক্ষুদ্রাংশও যদি আমাদের মত স্বার্থলোভী, সুবিধাভোগী শ্রেণীর মধ্যে থাকতো!

যাহোক, যে দুটি সাফল্যের কথা বললাম, তা নিছক সিন্ধুর মাঝে দু’ফোঁটা বিন্দুসম, কিন্তু তাহলেও তো এগুলোকে সাফল্যই বলা যায়, তাই না? শুধু স্বেচ্ছাশ্রম আর স্বেচ্ছা অনুদানের ভিত্তিতে অর্জিত এটুকু সাফল্যের কথা বললাম এজন্য যে, 'বাংলাদেশে কোন কিছুই সহজে করা যায়না', এ ধরণের কথা শুনে কেউ যেন কখনো নিরুৎসাহিত না হন। ইচ্ছে থাকলে প্রতিকূলতার মাঝেও অনেক কিছু করা যায়। আর দশে মিলে চেষ্টা করলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়।

ঢাকা, ২৮ মার্চ ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

এসটিএইচ ক্লিনিক এর ছবি। নীচের ছবিতে দেয়া সাইনবোর্ডটি দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ঘরের দেয়ালে লাগানো।

এসটিএইচ ক্লিনিক এর সাইনবোর্ড

Ex Cadets' Forum (ECF) নামে একটি প্রাক্তন ক্যাডেটদের ফেইসবুক গ্রুপ আছে। তাদের আবার Toys R Urs (Toys Are Yours) নামে একটা প্রকল্প আছে, যেখানে তারা স্বচ্ছল ও দয়ালু ব্যক্তিদের কাছ থেকে পুরনো ব্যবহারোপযোগী খেলনা সংগ্রহ করে দরিদ্র শিশুদের মাঝে বিতরণ করে। তাদের কিছু উদ্যোক্তাদের সাথে যোগাযোগ করে আমরাও আমাদের প্রাক্তন ইট ভাঙ্গা শ্রমিক, বর্তমানে স্কুল ছাত্র ছাত্রী শিশুদের মাঝে বিতরণ করি। গত ঈদের মাত্র ৫/৬ দিন আগে সেগুলো বিতরণ করা হয়। খেলনাগুলো পেয়ে শিশুরা খুবই খুশী হয়। আর তাদের মাঝে ঈদের এই আনন্দটুকু ছড়িয়ে দিতে পেরে আমরাও যারপরনাই খুশী হই। এই উদ্যোগের কয়েকটি চিত্র এখানে দিলামঃ



(ইতোপূর্বে অন্যত্র প্রকাশিত)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৯ দুপুর ১২:২৬
৭টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×