somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পিছু ফিরে দেখাঃ “মেরা জীবন কোড়া কাগজ...”

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৭৫ সালের শেষের ক’টা দিন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সদ্য কমিশন লাভ করে ঢাকার একটা ইউনিটে যোগদান করেছি। পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের দেশে ফিরিয়ে আনাতে তখন আবাসন সংকট চলছিল। জরুরী ভিত্তিতে আবাসনের ব্যবস্থা করার জন্য তখন সেনানিবাসের এখানে সেখানে “রূপসা” প্রকল্পের অধীনে কিছু ব্যাচেলর অফিসার্স কোয়ার্টার্স (বিওকিউ) তৈরী করা হয়েছিল। সদ্য বিবাহিত কিংবা ছোট পরিবারের জন্য দুই কক্ষ বিশিষ্ট কিছু ম্যারেড অফিসার্স কোয়ার্টার্সও নির্মিত হয়েছিল। ইটের হাল্কা গাঁথুনী, উপরে টিনের ছাদ- একেক সারিতে কোথাও ছয়টি, কোথাও আটটি কক্ষ নিয়ে এরকম কয়েকটি সারি বানানো হয়েছিল। অবস্থান, তৎকালীন ব্রিগেড মেস (বর্তমানে অবলুপ্ত, এএইচকিউ মেস এবং সিগন্যাল্স মেস এর মধ্যবর্তী স্থানে) এর বিপরীতে রাস্তার উলটো দিকে। এই বিওকিউ এর সর্ব উত্তরের সারিতে সর্ব পশ্চিমের কক্ষটি আমি বরাদ্দ পেলাম। পশ্চিমের জানালা দিয়ে দেখা যায় সবুজ ধানক্ষেত, ভাসানটেক যাওয়ার পায়ে চলা পথ। পথটি আমার কক্ষের সামনে দিয়ে একেবারে প্রায় গা ঘেঁষে প্রধান সড়কের সাথে মিলিত হয়েছে। এই পথ দিয়ে ভাসানটেকের লোকজন সেনানিবাসে প্রবেশ করতো। বেশীরভাগ পথচারীই ছিল সেনাবাহিনীর সদস্য এবং তাদের পরিবারের লোকজন। সেখানে তারা স্টেশন সদর দপ্তরের অনুমতিক্রমে ঘর ভাড়া নিয়ে “আউট লিভিং” থাকতো।

প্রথম প্রথম বেশ কিছুদিন আমি একাই সেই কক্ষটিতে থাকতাম, কারণ কক্ষটি আমার নামেই বরাদ্দ হয়েছিল। আসবাবপত্র বলতে এমইএস এর কাঠের ফ্রেমে বেত লাগানো দুটো ইজি চেয়ার, মাঝখানে একটা সেন্টার টেবল। স্টীল ফ্রেমে ফিতের টাইট গাঁথুনী দেয়া একটি “খাট”, পাশে একটি ছোট বেড সাইড টেবল। আর ছিল একটি কাঠের আলনা এবং কাপড় চোপড় রাখার জন্য তিন ড্রয়ার বিশিষ্ট একটি কাঠের চেস্ট অভ ড্রয়ার্স। ব্যস, এই ছিল আমার একার সংসার। আমি খাওয়া দাওয়া এবং মেস সম্পর্কিত যাবতীয় অনুষ্ঠানাদির জন্য সিগন্যাল্স মেস এর সাথে এটাচড ছিলাম। তখন ছিলাম সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট, তাই মেসের বাকী সবাই আমার সিনিয়র ছিলেন। সদ্য কমিশন পাওয়া আমার মত এরকম একটা “মুরগা” কে (সেনা কথ্যভাষায় সদ্য কমিশন পাওয়া সেকেন্ড লেফটেন্যান্টদেরকে এ নামেই ডাকা হতো) সামনে পেলে সিনিয়ররা পোশাকের “টোকাই” করার জন্য (ভুল ধরা) হামলে পরতেন। সেইফ থাকার জন্য প্রথম প্রথম রাতে স্যুটেড বুটেড হয়েই ডিনারের জন্য রাস্তাটা পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে মেসে যেতাম। দুপুরে অফিস থেকে ফেরার সময় ইউনিফর্ম পরেই লাঞ্চ সেরে আসতাম।

ইউনিটে জয়েন করার প্রথম দিনেই সুবেদার মেজর সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি ব্যাটম্যান (ফুট ফরমায়েশ খাটার জন্য সাহায্যকারী) নিয়ে এসেছি কিনা। আমি না বলাতে তিনি বললেন, ঠিক আছে স্যার, আমি বিকেলের মধ্যে একটা ব্যটম্যান ঠিক করে আপনার রুমে পাঠিয়ে দেব। বেতনের ব্যাপারে কিছু বলতে হবেনা। অন্য সবাই যা দেয়, আপনিও তাই দেবেন। বিকেলে গেমসে যাবার সময় দেখি রুমের সামনে সিঁড়ির উপর একটা ১৫/১৬ বছরের ছেলে বসে আছে। সে জানালো, তাকে সুবেদার মেজর সাহেব আমার কাছে পাঠিয়েছেন। আমি ঘুমুচ্ছিলাম ভেবে সে আমাকে ডাকেনি কিংবা দরজায় করাঘাত করেনি। তার এই সৌজন্যবোধ দেখে চমৎকৃত হ’লাম। তার হাতে রুমের চাবি দিয়ে আমি গেমসে চলে গেলাম। বললাম, ফিরে এসে তার সাথে বাকী কথা বলবো। তখন অপরিচিত ব্যাটমেনদেরকেও সহজে বিশ্বাস করা যেত। গেমস থেকে ফিরে এসে দেখি সে ইতোমধ্যে আমার বুট চমৎকারভাবে ওয়াটার পালিশ করে রেখেছে, ওয়েব বেল্টের পিতলের অংশটুকু সুন্দরভাবে ব্রাসো দিয়ে পালিশ করে রেখেছে, কাঁধের সবেধন নীলমনি ‘পিপস’টিও তার হাতের সযত্ন ছোঁয়ায় চকচক করে হাসছে। পরে ছেলেটির সাথে কথায় কথায় জানলাম, ওর নাম শ্যামল। আমাকে ছোটবেলায় আমার কিছু আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধু বান্ধব ‘সবুজ’ নামে ডাকতো। কালক্রমে অবশ্য সে নামটা আমার হারিয়ে গেছে, তবে শুধু একটি পরিবারের সবাই আমাকে এখনো ঐ নামে ডাকে। ওর নামটা শুনে মনে মনে ভাবলাম, বাহ! ভালই তো নামের মিল। নাম শুনে ওকে প্রথমে আমি হিন্দু ভেবেছিলাম। কিন্তু দু’দিন পর ও জানালো যে ও খৃষ্টান। সামনে বড়দিন, কিন্তু সে আমার কাছে এসেই কি করে ছুটি চাবে, এ কথা ভেবে বিব্রত। ওর বাড়ী কাছেই ছিল, পূবাইলের উলুখোলায়। অনেক সাহস করে সে আমার কাছে শুধু বড়দিনের জন্য ছুটি চাইলো। আমি ওর মনের আশা আঁচ করতে পেরে বড়দিনের আগে পিছে আরো একদিন করে যোগ করে মোট তিন দিনের ছুটি মঞ্জুর করলাম।

সেই “রূপসা” বিওকিউ এর কক্ষটিতে ভালই চলছিল আমার একার সংসার। কিছু নেই, তবুও কেন যেন সেই একলা কক্ষটিতে নিজেকে একটু রাজা রাজাই মনে হতো। কিন্তু আমার সে সার্বভৌমত্ব বেশীদিন টিকলোনা। ইতোমধ্যে তৎকালীন জাতীয় রক্ষী বাহিনীর অফিসারগণ সেনাবাহিনীর সাথে ‘আত্মীকৃত’ (absorbed) হয়েছেন। তাদের জন্যেও আবাসনের ব্যবস্থা করতে গিয়ে একজন অফিসারকে আমার কক্ষটিতে সহাবস্থানের জন্য কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিলেন। তিনি উত্তরবঙ্গের লোক, আমার চেয়ে সামান্য সিনিয়র। কিন্তু তখনও সেনাবাহিনীতে জুনিয়রদের উপর সিনিয়রদের প্রিভিলেজগুলো কী কী, সে ব্যাপারে তিনি সম্যক অবহিত ছিলেন না। তাছাড়া, কক্ষটির প্রাথমিক বরাদ্দ ছিল আমার, উনি পরে এসেছেন। তাই শুরু থেকেই উনি আমার সাথে একটু বুঝে শুনেই কথা বলতেন। কিন্তু তার সরলতার কারণে আমরা অচিরেই খুব ফ্রেন্ডলী হয়ে গেলাম। তখন তিনি অবসর সময়ে তার নিজস্ব স্টাইলে তৎকালীন হিন্দী সিনেমার জনপ্রিয় সব গান গাইতেন (তার কন্ঠ মোটেই শ্রুতিমধুর ছিলনা, কিন্তু গানের কথাগুলো তিনি নিখুঁতভাবেই মুখস্থ করেছিলেন)। তিনি প্রায় প্রতিদিনই আমাকে বলতেন, ভারতে প্রশিক্ষণকালীন সময়ে তিনি প্রতি সপ্তাহান্তে হিন্দী “বই” দেখতে যেতেন। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল হেমামালিনী অভিনীত ‘শোলে’ এবং জয়া ভাদুরী অভিনীত ‘কোরা কাগজ’ ছবিদুটো, যা তিনি হলে গিয়ে বহুবার দেখেছেন। প্রায় প্রতিদিন আমাকে ঐ দুটো ছবির মধ্যে যেকোন একটির কাহিনী সবিস্তারে শুনতে হতো। পরের ছবিটির কাহিনী বলার সময় তিনি অবশ্যই প্রতিবার বেসুরো গলায় ‘মেরা জীবন কোরা কাগজ কোরা হি রেহ গ্যায়া’ গানটি গাইতেন এবং গানের শেষাংশে জয়া ভাদুড়ী আর বিজয় আনন্দের মধ্যকার সেই বিখ্যাত কথোপকথন- “কামিজ কা বাটন টুঁটেঁ হ্যায়ঃ বাটন কিঁউ, সব কুছ ভি টুঁট গ্যায়া” (স্মৃতি থেকে, উদ্ধৃতি হুবহু ঠিক নাও হতে পারে) আবেগভরে এককাভিনয়ের মাধ্যমে আমাকে বুঝাতেন। আমি তখনো একটিও হিন্দী ছবি দেখিনি, আমাদের দেশে ভিসিআর/ভিসিপি এসেছিল আরো পরে। তবে, রেডিওতে ‘আকাশবাণী কার্সিয়াং’, ‘আকাশবাণী বিবিধ ভারতী’ আর ‘রেডিও সীলন’ (বর্তমানে শ্রীলঙ্কা রেডিও) শুনে শুনে হিন্দী গান সম্পর্কে আমি সম্যক অবহিত ছিলাম। বিশেষ করে ‘বিনাকা গীতমালা’ (অনুরোধের আসর) অনুষ্ঠানটি শোনার জন্য রেডিওর সামনে লাইন পড়ে যেত। তাই মেরা জীবন কোরা কাগজ গানটি আমারও পরিচিত, প্রিয় এবং মুখস্থ ছিল। তবে সিনেমার কাহিনী আমি জানতাম না, তাই ওনার মুখে আমি সে কাহিনী মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে যেতাম এবং নানাকিছু নিজের মত করে ভাবতাম। হায়রে, কোথায় গেল সেই সোনালী দিনগুলো!

এতক্ষণ ধান ভানতে শীবের গীত গাইলাম, কারণ আজ সকালে কিছু লেখাযোখার সময় ইউ টিউবে গান শুনতে শুনতে কোন একটা ক্রমিকে এসে ঐ গানটা কানে এলো। লেখা বন্ধ করে ইউ টিউবে মনোনিবেশ করলাম। বিস্তীর্ণ মাঠের সুদূর প্রান্ত দিয়ে কালো কয়লার ইঞ্জিনে টানা রেলগাড়ী দেখে সাদা শাড়ী পরিহিতা জয়া ভাদুড়ীর উক্তি ‘এই গাড়ী প্রতিদিন এই সময়ে না জানি কত মুসাফিরকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়! একইভাবে এটা আমাকেও একদিন আমার দুঃখকে সাথে করে এখানে নিয়ে এসেছে!’- শুনে সব লেখালেখি থামিয়ে গানটাকে আবার নতুন করে দেখা ও শোনার ইচ্ছে হলো। সাথে মনে পড়লো আমার সেই সিনিয়র কাম বন্ধুর আবেগমাখা অভিনয় এবং বেসুরো গানের স্মৃতি...‘মেরা জীবন কোরা কাগজ কোরা হি রেহ গ্যায়া’।

এবং আরও কত কিছু….


মেরা জীবন কোরা কাগজ......

ঢাকা
১৪ আগস্ট ২০১৭
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

(লেখাটি ইতোপূর্বে অন্যত্র প্রকাশিত হয়েছিল)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০২০ সকাল ৯:১৩
৩৩টি মন্তব্য ৩৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×