somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি হ্যাটের আত্মকাহিনীঃ

১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গুগল থেকে নেয়া ছবি

আমার নাম হ্যাট। আমার নামটি খুবই ছোট হলেও আমার পরিচিতি বিশাল এবং ব্যাপক, আমার একটি প্রাচীন ঐতিহ্যও রয়েছে। আমি মানুষের শিরস্ত্রাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছি সে আজ থেকে নয়, সেই ব্রোঞ্জ যুগ থেকে। ইতিহাস ঘেঁটে আমার প্রথম পরিচয় হিসেবে জানা যায় যে খৃষ্টপূর্ব ৩৩০০ সালে অস্ট্রিয়া এবং ইটালীর মধ্যবর্তী এক পাহাড়ী অঞ্চলে মাথায় হ্যাট পরিহিত ওজি (Otzi) নামের এক লোককে বরফে হিমায়িত অবস্থায় পাওয়া যায়, যা হ্যাট প্রচলন থাকার প্রথম প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃত। ইতিহাস আরো সাক্ষ্য দেয় যে আমি প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই ছিলাম নরনারীর পরিচ্ছদ ও ভূষণের আভিজাত্যের প্রতীক। প্রাচীন মিসরীয় রাজন্যবর্গ আমাকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে নানা রঙে এবং শৈলীতে তাদের মাথায় স্থান দিতেন। তার পরে রোমানগণ এবং তারও পরে রাশান এবং আমেরিকান অভিজাত রাজন্যবর্গ আমাকে তাদের বেশভূষার অপরিহার্য অংশ হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা শুরু করেন। অভিজাত রমণীগণ মধ্যযুগ হতে আমাকে তাদের মাথায় বসিয়ে গর্ব বোধ করতেন। সেই থেকে আমার পূর্বসূরীরা বিশ্বের নরনারীদের মাথার শোভা হয়ে বিশ্বময় ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন হ্যাট প্রস্তুতকারক হিসেবে আজও লন্ডনের St James’ Street এর James Lock & Co এর নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। উত্তর আমেরিকার Stetson কোম্পানীও বহু বছর ধরে আমেরিকা এবং কানাডার হ্যাটপ্রিয় মানুষদের কাছে খুবই জনপ্রিয় একটি নাম।

যাহোক, এতক্ষণ শুধু অভিজাত শ্রেণীর কথাই বলে গেলাম। কিন্তু আমি জন্মসূত্রে অভিজাত হলেও, আমার জন্ম হয়েছে সাধারণ হ্যাটপ্রেমী মানুষদের জন্য, চীনের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। চীনারা আমাকে ডাকে “নিউ যাই মাউ” (Niu Zai Mao) বলে। চীনারা দেখতে খর্বাকৃ্তির হলেও আমার নামটি ওরা রেখেছে বেশ লম্বাই। জন্মের পর চৈনিক মহিলারা আমাকে অতিশয় যত্ন করে কিছুদিন একটা শো কেসে আটকে রাখে। তারপর সেখান থেকে এক ভুটানী ব্যবসায়ী আমাকে কিনে পারোতে নিয়ে আসে। সেখানেও আমি কিছুদিন প্রদর্শনীর জন্য উন্মুক্ত ছিলাম, সাথে আমার আরো অনেক ভাই বোনও ছিল। একদিন বাংলাদেশ থেকে কয়েকজন পর্যটক ভুটানে বেড়াতে এসে আমাকে দেখলেন। একজন সাথে সাথেই আমাকে পছন্দ করে নিলেন। তার দেখাদেখি তার আরো তিনজন বন্ধুও আমার তিন ভাইকে কিনে নিলেন। সেই থেকে আমি আমার ক্রয়কারী পর্যটককে স্যার বলে ডাকি। তিনি আমাকে কেনার সাথে সাথেই তার মাথায় বসিয়ে দিলেন। তার বন্ধুরাও একই কাজ করলেন। আমরা চার ভাই তাদের চারজনের মাথায় বসে ভুটানের দর্শনীয় স্থানগুলোতে ঘুরাঘুরি করতে লাগলাম। আহা, তখন আমাদের সে কি আনন্দ!

আমি জানি, আমার স্যার আমাকে তার মাথায় পরিধান করতে খুব ভালবাসেন। কারণ উনি যখনই সবান্ধবে কোথাও বেড়াতে বের হন, তখনই তিনি আমাকে ভালোমত পরিচর্যা করে তার মাথায় বসিয়ে নেন। কখনো সখনো মাথা থেকে নামালেও, ছবি তোলার সময় তিনি আমাকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে পুনরায় তার মাথায় স্থাপন করতেন। আমিও সগৌরবে তার মাথায় বসে অন্যদের (যাদেরকে তাদের স্যার রা ভুলক্রমে গাড়ীতে ফেলে যেতেন) ঈর্ষার কারণ হতাম। আমাকে মাথায় রেখে আমার স্যার যেমন সমীহ প্রাপ্ত হন, তেমনি স্যার যখন কারও প্রতি শ্রদ্ধা জানান তখনও তিনি আমাকেই মাথা থেকে একটু নামিয়ে রাখেন। আপাতত দৃষ্টিতে পরস্পর-বিরোধী হলেও, আদতে সেটি ঘনিষ্টভাবে পরস্পর-সম্পর্কযুক্ত। আমি তাতে গর্বিত হই, কারণ সকল অবস্থায় আমিই থাকি শ্রদ্ধার উৎস এবং গন্তব্য। স্যার আমাকে কেনার পর থেকে আমি তার মাথায় বসে কতই না দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ালাম! কোথাও পিকনিক হলেই কিংবা বহিরাঙ্গণে কোন ভ্রমণসূচী থাকলেই আমার ডাক পড়তো। ভুটান থেকে ফিরে আসার পর আমি সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডেও স্যারের সফরসঙ্গী হয়েছিলাম। দেশের কক্সবাজার, ইনানী সৈকত, এমনকি এইতো সেদিন মৈনটেও, যা বাংলাদেশের ‘মিনি কক্সবাজার’ নামে ইতোমধ্যে পরিচিত হয়েছে, আমাকে তিনি সাথে নিয়েছিলেন। কিন্তু হায়, কে জানতো ওটাই হবে আমার অগস্ত্য যাত্রা, মৈনটের পদ্মার বুকেই রচিত হবে আমার সলিল সমাধি!

সেদিন, গত ১১ই জানুয়ারী ২০১৮ তারিখে আমার স্যার ও সাথে তার দুই বন্ধুর সস্ত্রীক বাংলাদেশের ‘মিনি কক্সবাজার’ নামে খ্যাত “মৈনটে” যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একজনের সর্দিজ্বর হবার কারণে তিনি ও তার স্ত্রী যেতে পারেন নি। অপর বন্ধুসহ স্যার মৈনটে যাবার পথে সর্ষে ক্ষেতে নেমে গিয়েছিলেন মনের আনন্দে, সেখানেও আমি কখনো তার মাথায় বসা, কখনো হাতে ধরা ছিলাম। তারপর মৈনটে পৌঁছে স্যার এবং ওনার সফরসঙ্গীরা ইঞ্জিন চালিত নৌকোয় চড়ে পদ্মার বুকে ঘুরে বেড়ান এবং একটি চরে সদলবলে নেমে পড়েন। সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে চরের ঠান্ডা বাতাসের কারণে বেশীক্ষণ না থেকে পুনরায় ইঞ্জিন নৌকোয় করে মৈনট ঘাটে ফিরে আসার জন্য রওনা হন। নৌকোয় উঠে স্যার এবং তার বন্ধু নানারকমের ঠাট্টা মস্করায় মেতে ওঠেন। এক সময় স্যার নৌকোর এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাল্কা বাতাসে চলমান নৌকোয় আমার অবস্থান একটু শিথিল হয়েছিল, স্যার সেটা মোটেই খেয়াল করেন নি। ঐ অবস্থায় স্যার একবার মাথা ঘুড়িয়ে নৌকোর ছই এ বসে থাকা তার বন্ধুর কি একটা কথার জবাব দিচ্ছিলেন, এমন সময় একটা হাল্কা কিন্তু আচমকা বাতাস এসে আমাকে স্যারের মাথা থেকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। আমি পড়ে গেলাম একেবারে মাঝনদীতে। আমি একবার চিৎকার করারও সময় পেলাম না। নিমেষেই একটা ঢেউ এসে আমাকে নদীর অতলে নিয়ে গেল! সেখানেই, পদ্মার বুকে রচিত হলো আমার সলিল সমাধি। আমার খুব দুঃখ হচ্ছে, পড়ার সময় আমি একটিবারও স্যারের মুখের দিকে তাকাবার সময় পাই নি, স্যারও সুযোগ পাননি আমার মুখের দিকে তাকাতে। এভাবেই আমার এবং স্যারের মধ্যে চিরবিচ্ছেদ রচিত হয়ে গেল!

(হ্যাটের ছবি ও তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া/গুগল। পোস্টের কয়েকটা লাইনের জন্য ব্লগার মাঈনুদ্দিন মইনুল এর নিকট ১১ নং মন্তব্যসূত্রে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।)



পারো বিমান বন্দরে, প্রত্যুষের আলো তখন কেবল ফোটা শুরু করেছে.... আমরা চার ভাই চার স্যারের মাথায় শোভা পাচ্ছি।
স্যারদের নম্র ভদ্র ট্যুর গাইড মিগমা শেরিং এবং গাড়ীচালক ওয়াং চেন টোবগিয়েলকে শুভবিদায় জানাতে ওনারা একসাথে ছবি তুলেছেন, তাদের উভয়ের ভব্যতা ও শিষ্টাচার স্যারদেরকে মুগ্ধ করেছিল....


গত ১১ জানুয়ারী ২০১৮ তারিখে মৈনটের পদ্মার বুকে স্যারের সাথে এটাই আমার শেষ ছবি। এর পরেই একটা আচমকা বাতাস এসে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে নদীতে ফেলে দেয় এবং পদ্মার বুকে আমি সলিল সমাধি লাভ করি!


ঢাকা
১৪ জানুয়ারী ২০১৮
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:১১
৩৮টি মন্তব্য ৩৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×