somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মায়া .... (১)

০২ রা আগস্ট, ২০১৯ বিকাল ৩:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রেজা আর রানা দুই সহোদর। রেজার বয়স দশ বছর, রানার ছয়। রেজা পড়ে পঞ্চম শ্রেণীতে, গভঃ ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে, আর রানা ওদের মিরপুরের বাসার কাছাকাছি একটি প্রাইমারী স্কুলে। রেজার বাবা সাত্তার সাহেব ব্যাংকে চাকুরী করেন। সকালে বাসা থেকে বের হবার আগে টিফিন বক্সে দুপুরের জন্য হাল্কা লাঞ্চ নিজের হাতব্যাগে ক্যারী করেন। ওদের মা রাহেলা এতদিন গৃহবধুই ছিলেন, কিন্তু একজনের বেতনে সংসার চলে না বিধায় তিনিও একটা অফিসে চাকুরী নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। উভয়ের কর্মস্থল ছিল কর্মব্যস্ত মতিঝিল এলাকায়। ওনারা বাসে করেই যাতায়াত করতেন।

একদিন সকালে রাহেলা ঘুম থেকে উঠে রানার কপালে হাত দিয়ে দেখলেন, তার জ্বর। তাড়াহুড়ো করে নিজের এবং স্বামীর নাস্তা ও লাঞ্চ বানিয়ে তিনি অফিস যাবার জন্য তৈরী হচ্ছিলেন বটে, কিন্তু অসুস্থ ছেলেটাকে বাসায় রেখে যেতে তার মায়া হচ্ছিল। তিনি রেজাকে বললেন, ‘আজ তোমার স্কুলে যাওয়া লাগবে না। ছোট্টভাইটাকে তুমি একটু দেখে রেখো, আমি আজ অন্য দিনের চেয়ে এক ঘন্টা আগেই চলে আসবো। ওর জ্বর এসেছে, ওর সাথে একটুও ঝগড়া করবে না কিন্তু’! এ কথা শুনে রেজা প্রথমে একটু আপত্তি করলো, কারণ ভাল স্কুল, একদিন স্কুল মিস যাওয়া মানে অনেক কিছুই মিস করা। পরক্ষণেই ঘুমন্ত ছোটভাইটার দিকে তাকিয়ে তারও মায়া হলো, তাই সে রাজী হয়ে গেল।

বাবা মা অফিসে রওনা হবার পর রেজা অপেক্ষা করতে লাগলো, রানা কখন ঘুম থেকে উঠবে। ওর উঠতে দেরী হচ্ছে দেখে সে একটা গল্পের বই নিয়ে পড়া শুরু করে দিল। রানা জেগে ওঠার পর সে ওকে আদর করে নাশতা খাওয়ালো, তারপর দুই ভাই মিলে মনোপলী খেলতে বসলো। কিন্তু রানার শরীর ভাল নেই বলে কিছুক্ষণ খেলেই সে আবার বিছানায় গড়িয়ে পড়লো। ওদের দুপুরের খাবার মা টেবিলে বেড়ে রেখে গিয়েছিলেন। দুপুরে রানা ঘুম থেকে ওঠার পর রেজা ওর হাতমুখ ধুইয়ে দিল। তারপর নিজেও গোসল করে এসে দুই ভাই একত্রে খেতে বসলো।

বিকেলের দিকে রানার জ্বর একটু বেড়ে গেল। মা মা বলে ও মাকে ডাকতে থাকলো। রেজা এটা ওটা বলে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে, কিন্তু জ্বরের প্রকোপে রানা এক সময় কান্না শুরু করলো। রেজা রানাকে বলতে থাকলো, ‘তুমি কান্না থামাও, মা এক্ষুনি এসে পড়বে’। কিন্তু রানা তো জানে মা প্রতিদিন কখন বাসায় আসে, তাই সে রেজার কথায় আশ্বস্ত হয় না। সে ভাবতে থাকলো, সে কাঁদতে থাকলে বোধহয় মা এক্ষুনি এসে পড়বে। ওর কান্না দেখে রেজা অস্থির হতে শুরু করলো। একসময় সে তাকে বললো, মা আমাকে বলে গেছে, আজ আগে আগে চলে আসবে। চলো আমরা বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে অপেক্ষা করি। এ কথা শুনে রানা কান্না থামালো।

ওদের বাসা থেকে বাস স্ট্যান্ড আধা কিলোমিটারের মত দূরে। রানা রেজার হাত ধরে হাঁটা শুরু করলো, কিন্তু পঞ্চাশ গজের মত হেঁটে সে আর হাঁটতে পারছিল না। রেজার কাছে কোন টাকাও ছিল না যে সে রিক্সা নেবে। অগত্যা সে ভাইকে বললো তার পিঠে চড়তে। পিঠে বহন করেই সে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছলো, এতে সে একটুও ক্লান্তি বোধ করে নাই। কিন্তু সমস্যা শুরু হল বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছার পর থেকে। ভাইকে পিঠে নিয়ে রেজার হাঁটতে কোন অসুবিধা হয় নাই, কিন্তু তাকে পিঠে রেখে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। অন্যরা এভাবে তাদেরকে দেখে কী ভাববে, সেটা ভেবেও তার খারাপ লাগছিল। এদিকে রানাকে পিঠ থেকে নামতে বললেই সে কান্না শুরু করছিলো, অন্যথায় চুপ!

একেকটি বাস আসে, আর রেজা ও রানা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে সেটির দিকে। মাকে বাস থেকে নামতে না দেখে বারে বারেই ওরা হতাশ হয়। রেজা অনেক বুঝিয়ে রানাকে পিঠ থেকে নামতে রাজী করায়। বলে, তোমার পা ব্যথা করলে আমাকে বলো, আবার পিঠে নেব। এভাবে পিঠে ওঠানো নামানো করতে করতে রেজার ধৈর্যের বাধ ভেঙে যাচ্ছিল, তবুও মা আসছিল না। এক সময় হাতঘড়ি পড়া একটা লোকের কাছ থেকে সময় জেনে নিয়ে রেজা বুঝতে পারলো, মা তার কথা রাখেনি। সে মনে মনে ঠিক করলো, সে আর মাত্র তিনটা বাস দেখবে। এর মধ্যে মা না আসলে সে বাড়ী ফিরে যাবে। একথা রানাকে বলতেই ও ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না শুরু করলো। রেজা ওকে থামানোর জন্য বললো, ঠিক আছে, যাব না। কিন্তু মনে মনে সে তার সিদ্ধান্তে অটল রইলো।

ঠিকই তৃতীয় বাসটি থেকে রাহেলাকে নামতে দেখে ওরা নিমেষেই সব দুঃখ কষ্টের কথা ভুলে গেল। রানাকে পিঠে নিয়ে রেজা দৌড়ে গেল বাসটির দিকে। মাকে দেখে এক গাল হেসে বললো, ‘মা তুমি এসেছো’? ওদেরকে এভাবে দেখে রাহেলা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি তাড়াতাড়ি সামনে যে রিক্সাটা ছিল, কোন দর দাম না করে ওদেরকে নিয়ে সেটাতেই উঠে রিক্সাওয়ালাকে বললেন, ‘বড় মাসজিদের কাছে চলুন’। তারপর দু’জনকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে রানার কপালে হাত দিয়ে দেখলেন, জ্বর তখন খুব বেশী নেই। রেজার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'খুব কষ্ট হয়েছে, বাবা সোনা'? তার এই আদর পেয়ে রেজা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললো, ‘মা তুমি তোমার কথা রাখো নাই। তোমার না আজ এক ঘন্টা আগে ফেরার কথা ছিল’? রাহেলা নিজেই ছিল আজন্ম ছিঁচকাদুনী। ছেলের কাছ থেকে এ অভিযোগ পেয়ে তিনি ছেলের চেয়েও জোরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, 'কি করবো বাবা সোনা, বাসটা সেই মতিঝিল থেকে সারা রাস্তা প্যাসেঞ্জার তুলতে তুলতে এসেছে। আমার একার কথা কি শয়তান ড্রাইভারটা শুনে? আমি অনেক বলেছি, কিন্তু ড্রাইভার আমার কথা শোনে নাই’। তাদের এই কান্নার রোল শুনে বুড়ো রিক্সাওয়ালা সামনে না তাকিয়ে বারবার পেছন ফিরে ওদের দিকে তাকাচ্ছিল আর আহ, উহ করছিল। মাসজিদের কাছে আসার পর রাহেলা রিক্সাওয়ালাকে পরবর্তী নির্দেশ দিয়ে একেবারে ওদের বাসার সামনে নিয়ে আসলেন।

এটা সেই আমলের কথা, যখন মাত্র দু’টাকা দিয়ে রিক্সায় এক কিলোমিটার পথ যাওয়া যেত। দেশে মোবাইল ফোন এসেছে তারও বহু বছর পর। রাহেলা তার ব্যাগ থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে রিক্সাওয়ালাকে দিয়ে বললেন, ‘বাকীটা আপনি রাখুন’। তার ছেলে দুটোকে আল্লাহ সহি সালামতে রেখেছে, এই ভেবে আল্লাহ তা’লার প্রতি রাহেলার মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠেছিল। এই বুড়ো রিক্সাওয়ালার আহ উহ শুনে রাহেলার তাকে একজন ভাল মানুষ মনে হয়েছিল। ছেলেপেলেদের অসুখ বিসুখে মায়েদের মন খুব দুর্বল হয়ে যায়। এই গরীব রিক্সাওয়ালাকে কিছুটা বেশী পারিশ্রমিক দিলে আল্লাহ তা’লা তার উপর খুশী হয়ে তার অসুস্থ সন্তানকে দ্রুত সুস্থ করে দেবেন, অনেকটা এই বিশ্বাসে রাহেলা পুরো দশটি টাকাই রিক্সাওয়ালাকে দিয়েছিলেন, যা ছিল তার প্রাপ্যের চেয়ে অনেক বেশী। কিন্তু রিক্সাওয়ালার কথা শুনে রাহেলা একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন! বুড়ো চাচা রাহেলাকে বললো, আফা, আফনের বড় ব্যাডা বহুত কষ্ট করছুইন। আমি হেই তখন থাইক্যা দেখতে আছি, হ্যায় একবার ছুডোডারে পিডোত ন্যায়, একবার নামায়, আবার কান্দোত ন্যায়, আবার নামায়। হ্যায় বহুত মেহনত করছুইন। আইজ আমার ভাড়া লাগতো না। আপনি এই ট্যাকাটা দিয়া বাবাজানরে একটা কিছু কিনা দিতুইন’! এই বলে টাকাটা রেজার পকেটে গুঁজে দিয়ে বুড়ো চাচা রিক্সা ঘুরিয়ে দ্রুত প্রস্থান করলেন।

ঢাকা
০২ আগস্ট ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৯ বিকাল ৩:৫৩
১৭টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×