(কৈফিয়ৎঃ ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ, তাই একটু বেশী ডিটেইলসে লেখা, শব্দসংখ্যাঃ ২১০৫। ব্যস্ত পাঠকের কাছে অনেক কথা অপ্রাসঙ্গিক, এবং লেখাটা অতি দীর্ঘ মনে হতে পারে।)
ঘরে ফেরার এর আগের পর্বটি দেখতে পাবেন এখানেঃ মেলবোর্নের দিনলিপিঃ ঘরে ফেরা, অনিশ্চিত পথে....(১)
অবশেষে বেলা বারটার কিছু আগে বোর্ডিং এর নির্দেশ এলো। আমরা ঝটপট মুখে মাস্ক লাগিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। আমার বেশ অসুবিধে হচ্ছিল মাস্ক পরে থাকতে। নিজের গরম প্রশ্বাস মুখের উপর ছড়িয়ে পড়াতে অস্বস্তি বোধ করছিলাম, তা ছাড়া প্রশ্বাসের কারণে চশমার কাঁচ ঘোলা হয়ে আসছিল, সেটাও একটা অস্বস্তির কারণ। আমি তাই একটুখানি পর পর মাস্কটাকে নামিয়ে রেখে নির্মল শ্বাস নিচ্ছিলাম, চশমার কাঁচকেও স্বচ্ছ হবার সুযোগ দিচ্ছিলাম। গিন্নী আড়চোখে তাকিয়ে চোখের ইঙ্গিতে এমনটি না করার নির্দেশ দিলেন, আমিও কষ্ট হলেও, সুবোধ বালকের মত তা মেনে চলার চেষ্টা করতে থাকলাম। প্লেনের দরজায় প্রবেশ পথের দু’পাশে দেখি দু’জন একটি ছোট্ট মেশিন হাতে ধরে আছে। অতিক্রম করা প্রতিটি যাত্রীর কানের কাছে সেটা ধরে ক্লিক করছে। অনুমান করলাম, সেটা হয়তো জ্বর মাপার জন্য কোন থার্মাল স্ক্যানার হবে, নয়তো মগজ ধোলাই এর কোন মেশিন! চীনাদের কথা তো, বলা যায় না। নির্বিঘ্নে সে স্ক্যানিং পার হ’লাম। আমি বরাবর জানালার পাশে বসতে ভালবাসি, গিন্নী সেটা জানেন বলে মাঝে মাঝে ছাড় দেন, মাঝে মাঝে দেন না। প্লেনের ভেতরে ঢুকে দেখি আমাদের আসন পড়েছে দু’পাশের জানালার কোন পাশেই নয়, প্লেনের মাঝখানে যে চারটি করে আসনের সারি রয়েছে, সেখানেই পাশাপাশি দু’টি আসনে। জানালার পাশে বসতে পারলাম না বলে মনটা কিছুটা খারাপ হলো, তবে বয়সের সাথে সাথে আমি দিন দিন অদৃষ্টবাদী হয়ে উঠছি বলে সহজেই তা মেনে নিলাম।
প্লেনে আসন গ্রহণ করেই ছেলেকে তা ফোনে জানালাম। জিজ্ঞেস করলাম, সে ঘরে পৌঁছেছে কিনা। সে জানালো সে পথে একটা গ্যাস স্টেশনে (পেট্রোল পাম্পে) গাড়ী পরিস্কার করছে। চোখের পর্দায় তার গাড়ী পরিস্কার করার ছবিটা ভেসে উঠলো। আসার কয়েকদিন আগে আমি ওকে বলেছিলাম, গাড়ীটা ময়লা হয়ে গেছে। গ্যাস স্টেশনে গাড়ী পরিস্কার করার সরঞ্জামাদি থাকে, একটু সময় করে পরিস্কার করে নিও। সে কথাটা মনে রেখে সে কাজটি করছে, একথা ভেবে ভাল লাগলো। আর তাছাড়া একটি কাজে ব্যস্ত রয়েছে বলে মন খারাপের কথাও ভুলে থাকবে, একথা ভেবেও স্বস্তি পেলাম। কাজের ফাঁকে কথার মাঝে বারে বারে সে আমায় স্মরণ করিয়ে দিল, সব সময় যেন মাস্ক আর গ্লোভস পরে থাকি, গুয়াংঝুতে পৌঁছে যেন যেভাবেই হোক, শুধু আমাদের পোঁছানোর এবং সম্ভব হলে পরবর্তী ফ্লাইটে আসন গ্রহণের খবরটা জানানোর পন্থা খুঁজে বের করে খবরটা তাকে জানাই। বলা বাহুল্য, তার এ আকুলতায় আমিও সামান্য বিচলিত হয়ে পড়লাম।
একটা বিষয় লক্ষ্য করে অবাক হ’লাম যে পায় প্লেনভর্তি যাত্রীদের মাঝে কেবলমাত্র আমরাই বোধহয় ছিলাম অচৈনিক, বাকী সবাই চীনা। এমনকি কাউকে দেখে আমাদের উপমহাদেশের অন্য কোন দেশের যাত্রী বলেও সনাক্ত করতে পারলাম না। সেদিনটি ছিল সোমবার, কমপ্লিট লকডাউন শুরু হবার ঠিক প্রথম দিন। অস্ট্রেলিয়ায় এখন প্রচুর সংখ্যক চীনা বংশোদ্ভুত নাগরিক বাস করে। আমার মনে হয় আর কিছুদিন পর ওরাই সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাবে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর ভয়ে চীনারা দলে দলে দেশে ফিরে যাচ্ছিল। চার আসনের সারিতে আমরা দু’জন বসার পর আর কেউ বসেনি বলে দুটো আসন খালি ছিল। আমরা আমাদের মাঝে একটি আসন ফাঁক রেখে বসলাম, তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখার কথাটা মাথায় রেখে। ঠিক ১২টা ২৫ মিনিটে প্লেনপক্ষীটি একটু নড়ে চড়ে উঠে ডানা মেলে রানওয়েতে বিচরণ শুরু করলো এবং ১২টা ৪৫ মিনিটে ভূমিত্যাগ করে আকাশে উড্ডয়ন করলো। যে ভূমিতে নাড়ির টান রেখে গেলাম, দূরের জানালা দিয়ে দেখছিলাম সে ভূমি ছেড়ে ক্রমান্বয়ে উপরে উঠে যাচ্ছি। এক সময় সে ভূমি অদৃশ্য হয়ে গেল, আমি তখনো বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে ছিলাম।
সম্বিত ফিরে পেলাম বিমানবালার ডাকে। তাকিয়ে দেখি অন্য সময়ের মত তাদের মুখে সেই কৃত্রিম হাসিটি নেই, তাদের অজান্তেই যেন তাদের মুখে একটা সিরিয়াস ভাবের ছাপ লেগে ছিল। তিনি আমাকে জামার আস্তিন গুটিয়ে একটি হাত বের করে দিতে বললেন। আমি তা দিলে তিনি কব্জির একটু ওপরে একটি মেশিন ধরলেন, পাশে দাঁড়ানো অপর বিমানবালা তার হাতে ধরা একটি গ্রাফশীটে কিছু লিখে নিলেন। বুঝতে পারলাম, আবারো জ্বর মাপা হলো, একে একে সব যাত্রীর। একটানা সোয়া নয় ঘন্টার এই বিমান যাত্রায় চায়না সাউদার্নের বিমানবালারা তিন ঘন্টা পরপর মোট তিনবার এসে নিষ্ঠার সাথে এই সুকর্মটি করে গিয়েছিলেন, তাদের ভাষায় যাত্রীদের স্বার্থে, সর্বোপরি মানবতার স্বার্থে। এই তাপমাত্রার রেকর্ড যে সাথে সাথে বিমান থেকেই গুয়াংঝু বিমান বন্দর তথা চীনা স্বাস্থ্য বিভাগে জানিয়ে দেয়া হচ্ছিল, তা তাদের তৎপরতা থেকেই অনুমান করা যাচ্ছিল। একটু পরে দেখলাম, একজন বিমানবালা তার নিজস্ব সেলফোন বের করে দেয়াল ঘড়ির মত একটা কিছুর ছবি বের করে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, আর চীনা যাত্রীরা সেটা থেকে তাদের নিজ নিজ ফোনে সেটার ছবি তুলে রাখছেন। সেটা কী হতে পারে, অবাক বিস্ময়ে তা ভাবতে থাকলাম। কোন কূল কিনারা না পেয়ে আমিও আপাততঃ আমার ফোনে সেটার একটা ছবি তুলে রাখলাম। পরে, বিমানবালাদের মুখের দিকে তাকিয়ে যাকে আমার কাছে সবচেয়ে ফ্রেন্ডলী বলে মনে হলো, অপেক্ষা করতে থাকলাম তিনি কখন আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যান। যখন সুযোগ পেলাম, আমার ফোনের ছবিটা তাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা দিয়ে আমাকে কী করতে হবে! তিনি তার হাতে ধরা একটি কাগজে লেখা তালিকা মিলিয়ে দেখে হেসে আমাকে বল্লেন, “ইউ ডোন্ট নীড ইট”! আমি কম কথা বলা লোক, তাই আর কিছু না বলে অধিকতর বিস্ময়ে সেলফোনটি বন্ধ করে রাখলাম।
প্লেনে তৈয়ম্মুম করে নামায পড়ার জন্য সাথে একটি মাটির ঢেলা বহন করছিলাম, আপাততঃ তা দিয়েই তৈয়ম্মুম করে আমরা উভয়ে যোহরের নামায পড়ে নিলাম। এরই মধ্যে একটি মুখ বাঁধা মোটা পলিথিন ব্যাগে (কোন বক্সে নয়) বিমানবালারা লাঞ্চ সরবরাহ করে গিয়েছিলেন। সবার জন্য একই ব্যাগ, কোন ‘মুসলিম ফুড’ (চীনারা হালাল খাবারকে এ নামেই ডাকে), ইংলিশ ফুড, কন্টিনেন্টাল ফুড ইত্যাদির বালাই নেই। বিমানবালারা বলে গিয়েছিল, ওরা কোন ওয়েস্ট কালেক্ট করবে না, লাঞ্চ শেষে আমরা যেন খালি পাত্রগুলো ঐ ব্যাগেই রেখে মুখ বেঁধে ব্যাগটি যার যার আসনের নীচে রেখে দেই। খুলে দেখি, ব্যাগের মধ্যে আস্ত কমলা, আপেল, কাপ কেক, টিনড বীনস, বিস্কুট ইত্যাদির একটি এ্যাসোর্টেড প্যাক। ইতোমধ্যে বিমানবালা দুটো ফর্ম দিয়ে গিয়েছিল, যা প্লেন থেকে বের হবার আগেই পূরণ করে রাখতে হবে। সেসব ফর্মে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন ছাড়াও গত ১৪ দিনে আমাদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছিল। আমরা ফর্ম দুটো পূরণ ও স্বাক্ষর করে পাসপোর্টের ভেতর ঢুকিয়ে রাখলাম। চীনে অবতরণের পর সামনের কয়েকটি ঘন্টা অতিরিক্ত উদ্বেগজনক এবং উত্তেজনাকর হতে পারে, এই ভেবে চেষ্টা করতে থাকলাম একটা লম্বা ঘুম দিতে। একাধিকবার বিমানবালাদের জ্বর মাপার তাগিদে সে ঘুমে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটলেও, প্লেন যখন অবতরণ করা শুরু করলো, তখন নিজেকে বেশ ফ্রেশ অনুভব করছিলাম। অবতরণ শুরু হবার আগেই বিমানবালারা এসে যাত্রীদের পাসপোর্টের পেছনে একটি করে গোল স্টিকার লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, কারোটায় লাল রঙের, কারোটায় হলুদ। আমাদেরটায় হলুদ স্টিকার লাগিয়ে দিয়েছিল।
স্থানীয় সময় সন্ধ্যে পৌনে সাতটায়, পুনঃনির্ধারিত সময়ের দশ মিনিট আগে প্লেনটি গুয়াংঝু বিমান বন্দরের বোর্ডিং ব্রীজে এসে থামলো। প্লেনের অভ্যন্তরীন মাইকে চীনা ভাষায় কিছু ঘোষণা করা হচ্ছিল। আমি অপেক্ষা করছিলাম ইংরেজী ঘোষণার জন্য। লক্ষ্য করলাম, লম্বা চীনা ঘোষণার পর মাত্র একটি ইংরেজী বাক্যে ঘোষণাটি সমাপ্ত হলো, আর তা হচ্ছে, বিমানবালার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত যেন কেউ কেবিন থেকে হ্যান্ডলাগেজ নামানোর জন্য আসন ছেড়ে উঠে না দাঁড়াই। বুঝলাম, ইংরেজীতে অনেক কিছুই বলা হলো না, যা চীনাদের জন্য বলা হয়েছে। প্লেন বোর্ডিং ব্রীজে থেমে আছে, যাত্রীরা সবাই সুশৃঙ্খলভাবে যার যার আসনে বসে আছে- এমন দৃশ্য আমি জীবনে আর কখনো কোথাও দেখি নাই। আমেরিকায়ও দেখেছি প্লেন রানওয়ে টাচ করার সাথে সাথে যাত্রীরা সবাই একত্রে করতালি দিয়ে পাইলটকে অভিনন্দন জানায় এবং প্লেনের গতি শূন্যে নামার আগেই যাত্রীরা কেবিন লাগেজ নামাতে উঠে দাঁড়ায়। আমরা সবাই বসেই থাকলাম। কিছুক্ষণ পর পর একেকবার একেক ধরণের পোষাকে সজ্জিত লোকজন এসে কেবিন ক্রুদেরকে কি যেন নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিল এবং তাদের কাছ থেকে কাগজপত্র সংগ্রহ করে যাচ্ছিল। প্রায় দশ বার মিনিট ঠায় বসে থাকার পর আবার মাইকে চীনা ভাষায় কিছু বলা হলো। তার পরে পরেই দেখি, সিরিয়ালী নয়, বিক্ষিপ্ত কিছু আসন থেকে লোকজন উঠে তাদের কেবিন লাগেজ নামিয়ে দরজার দিকে অগ্রসর হতে থাকলো। এবারে ইংরেজী ভাষায় ঘোষণার কোন তরজমা শোনানো হলোনা বলে আমি কনফিউজড হয়ে বসেই থাকলাম।
প্লেনে আবার নিস্তব্ধতা, একটি ছোট্ট দল নেমে যাবার পর সবাই যার যার আসনে নিশ্চুপ বসে আছে। আবার একটি ঘোষণা, শুধু চীনা ভাষায়, আবার আরেকটি চীনা দলের স্বয়ংক্রিয় পুতুলের মত উঠে দাঁড়ানো, লাগেজ নামানো এবং দরজার দিকে অগ্রসর হওয়া। কী হচ্ছে, চিন্তা করতে করতে আমি অস্থির। একেতো প্লেন এক ঘন্টা বিলম্বে ছেড়েছে, তার উপর থামার পরেও প্লেনের ভেতরে বসেই আছি আধ ঘন্টা ধরে- এতে যে কানেক্টিং ফ্লাইট ধরতে পারার সম্ভাবনা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, সে চিন্তাটাই ছিল অস্থিরতার কারণ। এবারে নভোচারীদের মত কিছু সাদা পোষাকধারীদের প্রবেশ, বিমানবালাদের কাছ থেকে কাগজপত্র সংগ্রহ এবং তারা নেমে যাবার পর আবার চীনা ভাষায় ঘোষোণা। ঘোষণার পর নামার জন্য অগ্রসরমান এই তৃতীয় দলটির শেষ ব্যক্তির পিছু পিছু আমিও বোর্ডিং পাস, পাসপোর্ট আর সেই পূরণকৃত ফর্মদুটো হাতে ধরে অগ্রসর হতে থাকলাম। দরজার কাছে পোঁছেই পেলাম সেই ‘ফ্রেন্ডলী’ বিমানবালাকে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা চীনা ভাষায় ঘোষণায় কী বলছো, আমি তো তার কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার কানেক্টিং ফ্লাইট নং CZ391। এভাবে এখানে বসে থাকলে তো আমি ফ্লাইট মিস করবো। উনি আমার পাসপোর্টটি উল্টিয়ে তার লাগিয়ে দেয়া সেই স্টিকারটি দেখে বললেন, দয়া করে আসন গ্রহণ করুন। এটা একটা স্পেশাল সিচুয়েশন, আপনাদের অসুবিধার জন্য আমরা দুঃখিত। তবে যা কিছু করা হচ্ছে, তা আপনাদের স্বার্থেই। আমি বললাম, আমি চীনা ভাষায় ঘোষণা বুঝতে পারছিনা, আমার যখন নামার ডাক আসবে, দয়া করে আমার আসনের কাছে এসে তা আমাকে জানিয়ে যাবেন। উনি রাজী হলেন এবং আমি ফিরে এসে আসন গ্রহণ করলাম।
একজন ইংরেজী জানা চীনা মহিলা আমার অস্থিরতা লক্ষ্য করেছিলেন। চতুর্থ ঘোষণার পর তিনিও উঠে দাঁড়ালেন এবং আমাকে বললেন, এবারে আপনি নামতে পারবেন, আপনি আসুন। আমি তার কথা শুনে বিমানবালার জন্য অপেক্ষা না করে তার পিছু নিলাম। পিছে পিছে গিন্নী। ঠিকই এবারে বের হতে পারলাম। বের হবার পর একজন স্বাস্থ্যকর্মী আমাদের পাসপোর্টের সেই হলুদ স্টিকারে দুটো ক্রমিক নং বসিয়ে দিলেন। আরেকটু অগ্রসর হতে আরেকজন স্টাফ হাতে একটা ফরম ধরিয়ে দিয়ে চীনা ভাষায় এবং সেই সাথে ফিতে দিয়ে ঘেরা একটা এলাকা দেখিয়ে ইশারায় বললেন, সেখানে সবাই বসে যেভাবে ফর্ম পূরণ করছে, আমাকেও তা করতে। আমি ফর্মটার দিকে তাকিয়ে দেখি, সেটা শুধু চীনা ভাষায় লেখা। ইংরেজীতে কোন কিছু লেখা নেই। আমি সেই ইংরেজী জানা চীনা মহিলাকে অনতিদূরে দেখতে পেয়ে তার কাছে গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করলাম। উনি ফর্মটি নিয়ে যিনি ফরমটি হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন, তার কাছে গিয়ে কিছু বলছিলেন। তাদের কথোপকথন এর ভাবভঙ্গী এবং বডি ল্যাঙ্গুয়েজ লক্ষ্য করে বুঝলাম, লোকটি কোন ছাড় না দিতে অনড়। উনি ম্লানমুখে ফিরে এলেন, ওনার পেছনে তখন বয়স্ক তিনজন চীনা দাঁড়িয়ে, সম্ভবতঃ অশিক্ষিত, নিজেরা ফর্ম পূরণ করতে অক্ষম। উনি বললেন, ঐ তিনজনকে সাহায্য করার পর তিনি আমাকে সাহায্য করবেন।
এদিকে কানেক্টিং ফ্লাইট মিস করার সম্ভাবনায় আমার ঘাম ছোটা শুরু হয়েছে। আমি উপায়ান্তর না দেখে সাহায্যের আশায় কাছে থাকা এক চীনা তরুণীর সাথে ইংরেজীতে আলাপচারিতা শুরু করলাম। উনি মেলবোর্নের মনাশ ইউনিভার্সিটির ছাত্রী, লকডাউনের কারণে দেশে ফিরে এসেছেন। সারারাত লাউঞ্জে কাটিয়ে পরেরদিন ফ্লাইট ধরে নিজ শহরে যাবেন। উনি প্রথমেই আমাকে বললেন, আপনি এ ফ্লাইট ধরতে পারবেন না, কারণ এখনো অনেক প্রক্রিয়া বাকী আছে। এখানকার কেউই তাদের নির্ধারিত ফ্লাইট ধরতে পারবে না, যদিনা কানেক্টিং ফ্লাইটের ব্যবধান ৭/৮ ঘন্টার বেশী হয়। উনি আমাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে স্বেচ্ছায় রাজী হলেন চীনা ফর্ম পূরণে আমাকে সাহায্য করতে। তবে উনি সঙ্গত কারণেই বললেন, উনি নিজ হাতে কিছু লিখবেন না, উনি শুধু অনুবাদ করে বলে দিবেন কোথায় কী লিখতে হবে। ওনার নির্দেশনা অনুযায়ী আমি দুটো ফর্মই দ্রুত পূরণ করে ফেললাম। উনি বললেন, ফর্ম জমা দেয়ার সময় আমি যেন অবশ্যই উল্লেখ করি যে আমি চীনা ভাষা জানি না এবং ফর্ম পূরণে অন্যের সাহায্য নিয়েছি। কর্তৃপক্ষ যদি জিজ্ঞেস করে আমি কার সাহায্য নিয়েছি, তবে আমি যেন তাকে দেখিয়ে দেই, এবং এজন্য উনি লাইনে আমাদের সামনে ওনার অবস্থান ছেড়ে দিয়ে আমার ঠিক পেছনে এসে দাঁড়ালেন।
আমার যখন ফর্ম জমা দেয়ার পালা এলো, আমি আর গিন্নী একসাথেই এগিয়ে গেলাম এবং এক সাথেই দুটো পাসপোর্ট জমা দিলাম। কর্তৃপক্ষ কিছু জিজ্ঞেস করলো না, তবুও আমি নিজ থেকে তাকে জানালাম যে চীনা ভাষা না জানার কারণে ফর্মগুলো পূরণে আমি অন্যের সাহায্য নিয়েছি। প্লেনে বসে যে ফর্ম দুটো পূরণ করেছিলাম, তার সাথে চীনা ভাষার ফর্মটি উনি মিলিয়ে নিয়ে বোর্ডিং পাস দেখতে চাইলেন। আমি কানেক্টিং ফ্লাইটের বোর্ডিং পাস এগিয়ে দিলে উনি বললেন, মেলবোর্ন থেকে যে ফ্লাইটে এসেছেন, সেটার বোর্ডিং পাস দেখান। আমি তটস্থ হয়ে এ পকেট ও পকেট, ব্যাগপকেট, পাসপোর্টের প্রতিটি পৃষ্ঠার ফাঁক হাতড়েও আর সে বোর্ডিং পাস খুঁজে পাচ্ছিলাম না। উনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কাছে বোর্ডিং পাস নেই? আমি বললাম, আছে তো অবশ্যই, তবে এ মুহূর্তে খুঁজে পাচ্ছিনা। উনি জানতে চাইলেন, আমাদের আসন নং কত ছিল। ভাগ্য ভাল যে ফর্ম পূরণ করতে করতে পাসপোর্ট নম্বর, আসন নম্বর, ফ্লাইট নম্বর ইত্যাদি সব মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ঝটপট বলে ফেল্লাম। উনি আমাদের পূরণকৃত ফর্মের ফটোকপি করে তা পাসপোর্টের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে ইশারায় আরেকটি ফিতে দিয়ে ঘেরা এলাকা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ওখানে গিয়ে অপেক্ষা করুন, স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য। আপাততঃ আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
এতক্ষণ অন্যকিছু ভাবার সময় পাই নি। এখন মনে হলো, ছেলে বার বার করে বলেছিল, যে করেই হোক, গুয়াংঝু থেকে যেন একটা বার্তা দেই। অনেক সংকোচ নিয়ে সেই মায়াবতী তরুণীটিকে জানালাম, মেলবোর্নে আমার ছেলে ও বৌমা থাকে, ওরা সারারাত আমার কাছ থেকে একটি বার্তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে জানার জন্য, যে গুয়াংঝুতে আমরা কী অবস্থায় আছি। উনি সাথে সাথে সেলফোন বের করে আমার কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে ছেলেকে মিলিয়ে দিলেন। কখন লাইন কেটে যায়, এই ভয়ে আমি নাকে মুখে সংক্ষেপে ছেলেকে চলমান ঘটনাবলী সম্পর্কে অবহিত করে বললাম, সে যেন ঢাকায় তার ছোট ভাইকে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে আমরা ফ্লাইট মিস করবো, সুতরাং সে যেন আমাদেরকে নিতে এই মধ্যরাতে বিমান বন্দরে না আসে। আমি এই কথাটুকু বলার পর যেন আমার বুকের উপর থেকে হিমালয় পাহাড় সরে গেল। এখন স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ফলাফল কী আসবে, সে ব্যাপারে মোটেই আমার কোন মাথাব্যথা থাকলো না। আমি নিয়তির উপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে হৃষ্টচিত্তে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।
ঢাকা
০৩ এপ্রিল ২০২০
শব্দসংখ্যাঃ ২১০৫
বিমান বালার হাতে ধরা সেলফোনে এই সেই রহস্যময় ছবি, যার মর্মার্থ তখন নয়, পরে উদ্ধার করতে পেরেছিলাম। সময়টা তার ফোনেই দেখা যাচ্ছে, দুপুর বারটা দশ (২৩ মার্চ ২০২০)।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০২০ সকাল ৭:১১