বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী আমার ছোটভাই চপলের লাগানো গাছ গাছালি....
(করোনার কারণে এখন ঘরের বাইরে মোটেই বের হওয়া হয় না। আজ একদিনের সফরে রংপুর থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ি বেরিয়ে এলাম। যাওয়া আসার পথে দেখা কিছু দৃশ্য, ঘটনা এবং কিছু পুরাতন স্মৃতি নিয়ে তিন চারটি পর্বে একটা স্মৃতিচারণমূলক লেখা প্রকাশের ইচ্ছে আছে। এটা একটা ব্যক্তিগত দিনপঞ্জী, পারিবারিক বলয়ের বাইরে কারও এসব ঘটনা ও স্মৃতির প্রতি আগ্রহ থাকার কথা নয়। তবে এসব স্মৃতিচারণে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া অতীতের কিছু কথা থাকবে, যা আজকের প্রজন্মের কোন পাঠকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে।)
আজ দশ দিন হয়ে গেল আমি রংপুরে। আম্মার অবস্থা মনে হয় কখনো একটু ভালো, কখনো অপরিবর্তিত। গত শুক্রবারে আমার ছোট ভাই উৎপলের (যার বাসায় আম্মা থাকেন এবং আমিও এখন অবস্থান করছি) আমাদের গ্রামের বাড়ী ‘বিন্যাগাড়ি’ যাবার কথা ছিল, কিন্তু বৃষ্টির কারণে যেতে পারেনি। আজ শুক্রবারে যাবে বলে মনস্থির করেছে। এদিকে মেজ ভাই এর মেয়ে মনিজা যখন জানতে পারলো যে উৎপল বাড়ি যাবে, তখন সে আমাকেও ফোন করে যেতে বললো এবং দুপুরে ওদের তুষভান্ডারের বাসায় মধ্যাহ্নের দাওয়াৎ দিয়ে বসলো। কিছুটা উলটো পথ পাড়ি দিতে হবে, তা সত্ত্বেও দাওয়াৎ কবুল করলাম। উৎপল জিজ্ঞেস করলো, মটর সাইকেলে করে গেলে আমার কোন অসুবিধে হবে কি না। আমি নেই বললে মটর সাইকেলেই যাবার সিদ্ধান্ত হলো।
সোয়া দশটার দিকে আমরা দু’ভাই রওনা হ’লাম। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ পার হবার পর সামান্য কিছুটা পথ খোঁড়াখুড়ির কারণে খারাপ অবস্থায় ছিল, কিন্তু বাকিটা পথে আর কোন অসুবিধে হয়নি। দেড় বছর আগেও সপরিবারে একবার এ পথ মাইক্রোবাসে পাড়ি দিয়েছিলাম, তাই পথটা আমার মোটামুটি চেনাই ছিল। কাকিনা পৌঁছানোর একটু আগে বৃষ্টি পেলাম। অগত্যা পথপাশের একটি ছাউনিতে মটর সাইকেল থামাতে হলো। উল্টো পথগামী সেখানে অপেক্ষমান কিছু মটর সাইকেল যাত্রী ও আরোহী আমাদের পরিহিত বস্ত্র তখনও শুকনো দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন আমাদের ফেলে আসা পথে কোন বৃষ্টি পেয়েছি কিনা। আমরা না বলাতে ওনারা হাল্কা বৃষ্টি মাথায় নিয়েই শুকনো আকাশের প্রত্যাশায় আমাদের উল্টো পথে দিলেন ছুট! চটজলদি বৃষ্টি থেমে গেলে আমরাও আমাদের গন্তব্যের দিকে রওনা হ’লাম। পথে জমে থাকা পানি এবং ভিজে যাওয়া মানুষের পোশাক দেখে বুঝতে পারলাম, একটু আগে এ অঞ্চলে বেশ মুষলধারেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে।
আদিতমারি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, আদিতমারি সরকারি কলেজ, শাফিয়া খাতুন কলেজ, আদিতমারি পোস্ট অফিস ইত্যাদি অতিক্রম করে প্রাক্তন বিলের উপর গড়ে ওঠা বসতি এবং তখনকার বিলের বুকের উপর দিয়ে এখনকার আঁকাবাঁকা পথ ধরে যাবার সময় আমার আরেক ছোট ভাই চপল ও তার স্ত্রী রুপালির কথা, উৎপল, তার স্ত্রী ও ছেলে, যথাক্রমে মাহমুদা ও সাদমানের কথা মনে হচ্ছিল। এক সময় এসব জায়গাগুলোতে ওদের প্রাত্যহিক পদস্পর্শ পড়তো, আজ কে কোথায় ছড়িয়ে আছে! আমার বাল্যকালে আমি দেখেছি এসব জায়গার উপর দিয়ে একটি বিশাল বিল প্রবহমান ছিল, যা ‘বিন্যাগাড়ি বিল’ নামে পরিচিত ছিল। এ বিলে দলে দলে পানকৌড়ি উড়তো, ডুবতো ও ভাসাভাসি করতো। বিলে ভাসা কচুরিপানার দলে ডাহুক দম্পতি লুকিয়ে থাকতো, বর্ষার সময় বিলটাকে একটা বিরাট নদীর মতই মনে হতো। এ বিলে নানা প্রকারের মাছ যেমন ছিল, মাছ খাবার জন্য পাখিও তেমনি আসতো প্রচুর। তাই এখানে সৌখিন পাখিশিকারিদের আনাগোনাও ছিল নিয়মিত। আমাদের প্রতিবেশী বছির চাচা তার দুই ছেলে রফিক, শফিক কে নিয়ে রাতের বেলা একটি হ্যাযাক বাতি এবং কোঁচ হাতে বেরিয়ে পড়তেন মাছ ধরার উদ্দেশ্যে। সারারাত জেগে প্রচুর মাছ মেরে ওনারা শেষ রাতে বাড়ী ফিরতেন। রোদের তাপে কিছু মাছকে শুঁটকি তে পরিণত করার জন্য টিনের চালে কিংবা উঠোনে চাটাই এর উপর বিছিয়ে রাখতেন। তাদের কোঁচে কখনো কখনো সাপও আটকে যেত। সাপগুলোকে মেরে রাস্তার উপর বিছিয়ে রাখা হতো। সেগুলোর উপর দিয়ে দুরন্ত ছেলের দল সাইকেল চালিয়ে উল্লাস করতো।
বেলা সাড়ে এগারটার দিকে বাড়ী পৌঁছালাম। আসার পথে দেখলাম, আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে রোপিত কাঁঠাল গাছ থেকে আশেপাশের লোকেরা কাঁঠাল পেড়ে খাচ্ছে। বাড়ীতে ঢুকতেই দেখি, প্রায় পরিত্যাক্ত বাড়ীর প্রবেশ প্রাঙ্গণে বড় বড় ঘাস জন্মেছে। আমার মায়ের এক সময়ের সাহায্যকারী ‘অমের মা’ আমাদের আসার খবর পেয়ে আগেই এসেছেন এবং প্রাঙ্গণ কিছুটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করছেন। বয়সের ভারে তিনিও আজ অনেকটা ভারাক্রান্ত। অস্থায়ী কেয়ার টেকার শামছুলও এসে উপস্থিত হলো। শামছুলকে নিয়ে উৎপল রংপুর থেকে আনা সর্প-প্রতিরোধক ‘কার্বোলিক এসিড’ এর কয়েকটা শিশি কয়েকটি জায়গায় ছড়িয়ে রাখলো, সাপের সম্ভাব্য আস্তানা হতে পারে, এমন অনুমান করে। বাড়ীর আনাচে কানাচে কত শত স্মৃতি ছড়িয়ে আছে! ‘অমের মা’ পাকা মেঝেটা ঝাড় দিতে শুরু করলো, উৎপল ঘরের জানালা কয়েকটা খুলে দিল বাতাস প্রবাহের জন্য, ফ্যানও ছেড়ে দিয়ে ফ্যানের নীচে একটা চেয়ার টেনে আমাকে বসে বিশ্রাম নিতে বললো। আমি বিহ্বল হয়ে শুধু এদিক সেদিক তাকাতে থাকলাম, আর প্রতিটি চেনা স্মৃতিচিহ্নের দিকে তাকিয়ে মনে মনে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করা শুরু করলাম। জগতটা একটা মায়ার সংসার, মায়ার ইন্দ্রজালে আমরা এ জগত সংসারে আবদ্ধ থাকি। একদিন সব বাঁধন ছিন্ন করে একেকজনকে ছিটকে পড়তে হয় জগতের একেক প্রান্তে! ডাইনিং টেবিলটার কাছে এসে বুক ভার হয়ে এলো। আমার জন্য অলিখিতভাবে একটা চেয়ার নির্দিষ্ট ছিল। আমি সেখানেই বসে খেতাম। তখন ছয়টা চেয়ার ছিল। এখনো শূন্য টেবিলের পাশে চারটা চেয়ার বেশ শৃঙ্খলার সাথে রাখা আছে। ডাইনিং টেবিলের পাশে এখনো শো-কেসটাতে কিছু ক্রোকারিজ শোভা পাচ্ছে। এগুলোর সাথে আম্মার, রুপালীর (ভ্রাতৃবধু, মরহুম) এবং মাহমুদার হাতের স্পর্শ জড়িয়ে আছে। ভবিষ্যতে আবার হয়তো এগুলো কোনদিন শুধু মাহমুদারই স্পর্শ পেতে পারে, বাকি দু’জনের স্পর্শ পাবার আর কোন সম্ভাবনা নেই। রান্নাঘরে প্রবেশ করে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সেই চুলো, সেই সিঙ্ক, সেই জানালা। ছাদের ট্যাঙ্কে পানি তোলার জন্য সেই মটর সুইচ! পাশের স্টোর রুমটাতে সেই ডালাসমূহ, সেই চৌকি-বেঞ্চি, সবই আছে, কিন্তু মনুষ্য স্পর্শহীন বলে ধুলোবালি জমে থাকা অবস্থায়! বেডরুমে ফিরে এলাম। খাটগুলোতে এখনো ম্যাটরেস বিছানো রয়েছে। ওয়ারড্রোব, স্টীল ক্যাবিনেট, সবই আছে, বন্ধ অবস্থায়। ড্রেসিং টেবিলের পাশের টেবিলটার উপর একটা ধূলিমাখা, অতি পুরাতন পবিত্র ক্বুর’আন শরীফ দেখতে পেলাম।
আমার মন যখন ভারী হয়, তখন আমি কিছুটা লঘু অনুভব করি কয়েকটা কাজ করে। তার মধ্যে ক্বুর’আন পাঠ অন্যতম। টেবিলে রাখা পবিত্র ক্বুর’আন শরীফটা দেখতে পেয়ে তাই আমি মনে মনে খুশি হ’লাম, আমার ভারাক্রান্ত মন কিছুটা হাল্কা হবে, এই প্রত্যাশায়। বাসা থেকেই আমি গোসল এবং ওযু করে রওনা হয়েছিলাম। ওযু ছিল বিধায় আমি ক্বুর’আন শরীফটা মুছে কিছুটা পরিস্কার করে পড়া শুরু করলাম। কিন্তু দুই রুকু পড়ার পর বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় লক্ষ্য করলাম, আমার কপাল থেকে ঘামের ফোঁটা পড়ে মলিন পাতাগুলো আর্দ্র হয়ে ছিন্ন হবার উপক্রম। তিন রুকু পড়ে আমি আপাততঃ পড়া বন্ধ করে ক্বুর’আন শরীফটিকে আবার যথাস্থানে রেখে দিলাম। রাতে বাসায় ফিরে ডিনারের সময় মাহমুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, সবকিছু তালাবদ্ধ রেখে এই পবিত্র পুস্তকটিকে কেন সে টেবিলের উপর অনাবৃত অবস্থায় রেখে এসেছে। সে উত্তর দিল, আল্লাহ তা’লার বাণী পবিত্র ক্বুর’আন শরীফকে নাকি কখনো তালাবদ্ধ অবস্থায় রাখতে হয় না। সে তৃতীয় শ্রেণীতে পাঠ্যরত অবস্থায় এই ক্বুর’আন শরীফটি দিয়েই তার ক্বুর’আন পাঠ শুরু করেছিল। এ কথা শুনে আমি ভাবলাম, তাই তো! ও সেটা টেবিলের উপর রেখে এসেছিল বলেই না আমি আজ তা পাঠ করে কিছুটা শান্তি অনুভব করতে পারলাম!
যখনই আমি বাড়ীতে যাই, যত অল্প সময়ের জন্যই হোক, ‘পাগলি’র মা’ এর সাথে আমার দেখা হবেই, অবধারিতভাবে। আজও তিনি এসেছিলেন তার একটা শিশু নাতনি কে নিয়ে। তিনি এখনো পুরোপুরি সচল, চেহারায় অশীতিপর বয়সের ছাপ থাকলেও বয়সের ভারে মোটেও ন্যুব্জ নন। আমাকে দেখতে এলে তার কাজ হয় শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা, আর আমি কী করি, কী বলি, তা দেখা ও শোনা। ‘পাগলি’র মা’ নিজে পাগলি নয়। হয়তো তারও একটা সুন্দর নাম ছিল। কিন্তু একটি প্রতিবন্ধী শিশুকে জন্ম দেয়ার অপরাধে আমাদের বিচারিক সমাজ তার সেই নামটাকে চিরতরে মুছে দিয়েছিল। আজ ‘পাগলি’র মা’ এর প্রকৃত নাম কী, তা কেউ জানে না। প্রথম প্রথম কেউ তাকে এ নামে ডাকলে সে প্রতিবাদ করতো। ধীরে ধীরে মুখে মুখে প্রচলিত হওয়া এ নামটাকে সে নিজেও যেন নিজের অজান্তেই মেনে নিয়েছে। পরিচিত কেউ তাকে চিনতে না পারলে সে নিজেই এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দেয় এভাবেঃ ‘মোক চেনেন নাই, মুই ‘পাগলি’র মা’ও’!
উৎপল লোক ডেকে গাছ থেকে কয়েকটা ডাব পাড়ালো। একটা ডাবের মিষ্টি পানি পান করে পেট ভরে গেল। বেলা একটার দিকে আমরা ঘর দোরে তালা লাগিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। আমি উৎপলকে অনুরোধ করলাম, আমাদের এক সময়ের প্রতিবেশি এবং আত্মীয় মোস্তফা ভাই এর বাসায় দুই মিনিটের জন্য থামার জন্য। মোস্তফা ভাই আমার চেয়েও অন্ততঃ আট-দশ বছরের মত বয়োজ্যেষ্ঠ হবেন। আমরা এখন গাছের পাকাফল। কোন ঝড় বাতাস ছাড়াই কে কবে কোনদিন টুপ করে ঝরে যাবো তার ঠিক নেই। সেজন্যেই ইচ্ছে হলো, একবার অন্ততঃ শুধু দেখাটা করে যাই। দেখা হলো না, কারণ উনি নামাযের জন্য ততক্ষণে মাসজিদে প্রবেশ করেছেন। ভাবীর সাথে দেখা হলো, ওনার চেহারাতেও বয়সের ছাপ স্পষ্ট; এতটা স্পষ্ট এর আগে আর কখনো দেখিনি। পাশেই ওনার ছেলে জাহাঙ্গীর পাকা বাড়ী করেছে। জাহাঙ্গীরও নামাযে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ও দুয়ারে এসে শুধু একটু দেখা দিল, ওর সাথেও তেমন কথা হলো না। উৎপলকে বললাম, আদিতমারি’র মজিবর ফুফা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন শুনেছিলাম। চলো, ওনাকে আর টুনি ফুফুকে একটু দেখেই যাই। আবার কবে দেখা হবে, কিংবা আদৌ হবে কিনা, কে জানে!
রংপুর
২৫ জুন ২০২১
শব্দ সংখ্যাঃ ১৩৩৮
মানুষ নেই, তবুও প্রাকৃতিক নিয়মে ফুলগুলো ফুটে স্মিত হাসি হাসে, মানুষের স্পর্শের প্রতীক্ষায় থাকে!
‘নিসর্গ’ – নামটাও চপলেরই দেয়া। এখন আছে একা পড়ে, মানুষবিহীন!
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০২১ সকাল ৯:১৭