somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মায়ের সাথে ঈদ শেষে বিষণ্ণ মনে ঘরে ফেরার কড়চা... (২)

০৩ রা আগস্ট, ২০২১ সকাল ১১:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আগের পর্বের লিঙ্কঃ মায়ের সাথে ঈদ শেষে বিষণ্ণ মনে ঘরে ফেরার কড়চা... (১)


বাস ছাড়ার পর থেকেই মনে মনে ভয়ে ছিলাম কখন না যেন কোন বড় যটে আটকা পড়ে যাই। আমি দূরপাল্লার বাসে যাতায়াতের সময় সাধারণতঃ সামনের দু’সারির মধ্যেই বসি এবং প্রথমেই একবার বাস চালকের আকৃতি প্রকৃতি নিরীক্ষণ করে নেই। তার বেশভূষা, মেজাজ মর্জি এবং সহকারীদের সাথে কথোপকথন মনযোগের সাথে খেয়াল করি। সবকিছু ইতিবাচক মনে হলে আমি বেশ রিল্যাক্স করে জার্নি করতে পারি, অন্যথায় টেনশনে ভুগি। এবারে যেহেতু আমি বাঁ দিকের প্রথম সারিতে বসেছিলাম, চালক মহোদয়কে আমি ভালই খেয়াল করতে পারছিলাম। এসি বাসগুলোতে সাধারণতঃ একটু বয়স্ক বা মধ্যবয়স্ক এবং অপেক্ষাকৃত অভিজ্ঞতর ও ভাল ট্র্যাক রেকর্ড সম্পন্ন চালকদেরকে নিয়োগ দেয়া হয়। কারণ দামী বাস, পারতপক্ষে যেন চালকের অসাবধানতা বা অবহেলাজনিত কোন কারণে দুর্ঘটনায় না পড়ে। এজন্য এসি বাসের চালকদের বেতনও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি দেয়া হয়। আমাদের চালককে দেখে প্রথমেই যা মনে হলো, তার বয়স আমার দেখা অন্য এসি বাস চালকদের চেয়ে তুলনায় বেশ কম, ত্রিশ কিংবা তার সামান্য কিছু বেশি হতে পারে, আবার কমও হতে পারে। এটা দেখে একটু চিন্তিত হচ্ছিলাম, কিন্তু যখন দেখলাম বয়স কম হলেও তিনি বেশ অভিজ্ঞ চালকের মতই বাসটি চালাচ্ছিলেন, তখন আশ্বস্ত বোধ করছিলাম। তাকে খুবই ধীর স্থির মনে হলো। মাঝে মাঝে অন্যান্য যানবাহন বা সাইকেল, ভ্যান ইত্যাদির অপ্রত্যাশিত আচরণের কারণে তাকে ব্রেক কষতে হচ্ছিল, কিন্তু এ নিয়ে তিনি অযথা কোন হাউকাউ করছিলেন না, জানালা দিয়ে মুখ বের করে তাদের প্রতি কোন খিস্তি খেউর ছুঁড়ছিলেন না। চালকের এমন শোভন আচরণে আমি মনে মনে বেশ স্বস্তি পাচ্ছিলাম।

পলাশবাড়ীতে ত্রিশ মিনিট আর গোবিন্দগঞ্জে দশ মিনিট- সমগ্র যাত্রাপথে সাকুল্যে এই চল্লিশ মিনিটই বাসটি রাস্তায় থির দাঁড়িয়ে ছিল, তবে এটুকু স্থৈর্য সহনীয় পর্যায়ে ছিল। বাকি পথটাতে যান চলাচলের সংখ্যা যথেষ্ট ছিল, তাই গাড়ীও ধীর গতিতে চলছিল, কিন্তু একেবারে থেমে থাকেনি। পড়ন্ত বিকেলে চলমান বাসের প্রথম আসনটি থেকে দেখা সামনের রাস্তা এবং দক্ষিণের আকাশটাকেও বিষণ্ণ মনে হচ্ছিল। সন্ধ্যার প্রাক্কালে ব্যস্তসমস্ত পথচারিদের মধ্যে একটু তাড়াহুড়ো ছিল। সাইকেল চালক, রিক্সা ও ভ্যান চালক এমনকি পায়ে হাঁটা মানুষদের মধ্যেও একটা দ্রুততা, একটু ব্যস্ততা লক্ষ্য করছিলাম। কিছু কিছু জায়গায় তখনো স্তুপিকৃত পশুর চামড়ার ঢিবি ফেলে রাখায় কয়েক জায়গায় রাস্তাটা একটু সরু হয়ে গিয়েছিল। মাগরিবের ওয়াক্ত হলে আমি নামায পড়ে নিয়ে শ্রান্তি ও স্বস্তির সাথে তন্দ্রাগমন করলাম। রাত ন’টার দিকে ‘ফুড গার্ডেন’ নামক একটি পান্থশালায় যাত্রাবিরতি করা হলে সেখানে নেমে কিছু খেয়ে নিলাম। রাত সোয়া দশটায় যমুনা সেতু অতিক্রম করার সময় এ সেতুটি ঘিরে নানা স্মৃতির কথা মনে পড়লো।

টাঙ্গাইল পার হবার পর থেকে বাসচালক এবং সুপারভাইজার এর মধ্যকার কথোপকথনে একটু চাঞ্চল্য ও অস্থিরতার আভাস পেলাম। আমাদের বাসটা যাবে মহাখালি টার্মিনালে। সেখানে পৌঁছাতে রাত দেড়টা দুটো বাজবে। বাসের সুপারভাইজারের বাড়ি মিরপুরে। এত রাতে মহাখালি থেকে মিরপুরে কিভাবে যাবে, এ নিয়ে সে চিন্তিত ছিল, কারণ পরের দিন ভোর ছ’টা থেকে শুরু হবে ‘কঠোর লকডাউন’। সুপারভাইজার যখন বাস চালকের কাছে এ সমস্যাটার কথা জানালো, তখন চালক একজন মিলিটারি কমান্ডারের মত তাকে নির্দেশ দিতে থাকলো একে ওকে ফোন করে আমাদের বাসের আগে পিছে গাবতলিগামী কোন বাস আছে কি না তা বের করার জন্য। অনেকের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেল যে আমাদের বাসের ঠিক সামনেই একটি বাস আছে যেটা গাবতলি যাবে। আমরা সে বাসটি থেকে আনুমানিক পনের-বিশ মিনিট দূরত্বের পথ পেছনে ছিলাম। সুপারভাইজার সে বাসের চালককে তার সমস্যার কথা জানিয়ে অনুরোধ করলো, সামনে চন্দ্রায় থেমে একটু অপেক্ষা করতে, সেখান থেকে তিনি ঐ বাসে উঠবেন। কিন্তু এত রাতে (রাত প্রায় সাড়ে বারটা) যাত্রী নিয়ে এতক্ষণ অপেক্ষা করতে সে চালক রাজি হচ্ছিল না। আমাদের চালক সাহেব তখন তার হাত থেকে ফোনটি চেয়ে নিয়ে সেই বাসচালককে খুবই জোরালো ভাষায় একটু অপেক্ষা করার অনুরোধ করলেন। তার ওকালতির ভাষায় আমি যেমন মুগ্ধ হ’লাম, সেই চালকও তার অনুরোধ ফেলতে পারলো না বলে মনে হলো। পনের মিনিট পরে চন্দ্রায় পৌঁছে সুপারভাইজার চালককে সালাম জানিয়ে বিদায় নিয়ে সেই বাসটিতে গিয়ে উঠলো। শুধু তাই নয়, মহাখালিতে নেমে যে কর্তার কাছে সুপারভাইজারের টাকা পয়সা ও চালান ইত্যাদি বুঝিয়ে দেয়ার কথা, চালক তাকেও ফোন করে জানিয়ে দিলেন যে সুপারভাইজারকে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে তিনি অন্য বাসে উঠিয়ে দিয়েছেন এবং তার টাকা পয়সা ও কাগজপত্রাদি বাসের দ্বিতীয় সহকারি ‘ঈমন’ তাকে বুঝিয়ে দেবে। এ নিয়ে তিনি যেন কোন হাঙ্গামা না করেন। বুঝলাম, তার কথার ধারে সেই কর্তাও রাজী হয়ে গেলেন।

পথিমধ্যে সুপারভাইজার ও চালকের মধ্যকার গল্প শুনে আমি তার বেশ কয়েকটি গুণের পরিচয় পেলাম। তিনি সুপারভাইজারকে বললেন তিনি যেন গাবতলিগামী বাসচালকের হাতে পাঁচশত টাকা দিয়ে দেন। উনি বললেন, সেই চালক কিছু চায় নাই, তবে সে যে তার অনুরোধকে সম্মান করে থেমেছে এবং একজন বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করেছে, সেজন্য এটা তার প্রাপ্য। আমাদের দু’জনের মত (আমি ও আমার সহকারী) এবং আরও কয়েকজন অতিরিক্ত যাত্রির কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে তারা যে লাভের ভাগ বাটোয়ারা করেছিল, সেখান থেকে চালক সাহেব নিজে দুইশত টাকা বের করে দিলেন এবং বাকি দু’জনের লাভের টাকা থেকে তিনশত দিয়ে মোট পাঁচশত টাকা সেই চালকের হাতে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। আমরা অনেকেই “নেতৃত্বের গুণাবলী” সম্পর্কে জানি এবং এ নিয়ে পড়াশোনাও করি। চালক সাহেবের এই কাজটিও নিঃসন্দেহে নেতৃত্বের পরিচায়ক। তিনি সুপারভাইজারকে বলতে পারতেন সেই বাস চালককে তিনি নিজেই যেন পাঁচশত টাকা দিয়ে দেন, কারণ ‘ঠ্যাকা’টা তারই ছিল। কিন্তু তিনি সেটা না করে পাঁচশত টাকার মধ্যে বৃহদাংশটা তিনি নিজেই দিলেন এবং কম অংশটা বাকি দু’জনকে সমভাবে ভাগ করে নিতে বললেন। একেই বলে কমরেডশিপ, এবং এটা যারা আত্মস্থ করতে পারেন, তারাই হতে পারেন নেতা। তাদের আলাপ থেকে আরও জানতে পারি যে যাত্রাবিরতির সময় কোন একটি হোটেলে চালকের জন্য এক ধরণের মেন্যু এবং সুপারভাইজার ও অন্যান্য স্টাফের জন্য ভিন্ন মেন্যু (একটু নিম্ন মানের) রাখার কারণে তিনি মালিকপক্ষকে বাধ্য করেছিলেন যাত্রাবিরতির সেই হোটেলটিকে পরিবর্তন করে অন্য একটি হোটেলের সাথে চুক্তি করার জন্য। “আমি খামু গরু, আর আমার স্টাফ খাইবো মাছ আর ডাইল, আমি এইডা ক্যামনে মানি”? – ঠিক এটাই ছিল তার সংলাপ, যা শুনে আমি খুবই মুগ্ধ হয়েছিলাম।

অন্যান্য সময় বাসে চলাচল করার সময় দেখেছি, পথিমধ্যে সহকারীগণ খিলি পান, সিগ্রেট ইত্যাদি কিনে এনে চালকের সামনে রাখে। তার আদেশ পেলে সহকারী কাগজে মোড়ানো পানের প্যাকেট থেকে একটা খুলে তার হাতে ধরিয়ে দেয়। কখনো ধুমপায়ী চালকের আদেশ পেলে সে নিজে একটা সিগ্রেট ধরিয়ে দুটো টান দিয়ে তার হাতে ধরিয়ে দেয়। কিন্তু এবারে আমি এ চালককে এ দুটো বদ অভ্যাস থেকেই মুক্ত দেখতে পেলাম। সারাটা পথে শুধুমাত্র বিরতির জায়গা ছাড়া তিনি এ দুটো কাজে ব্রতী হন নাই। আমার বিশ্বাস, তিনি যেখানে যে কাজই করুন না কেন, তার কর্মক্ষেত্রে তিনি নেতৃত্বের নিদর্শন রাখবেনই, এবং আমি অবাক হবো না, যদি কোনদিন তাকে বড় কোন নেতৃত্বের পদে দেখতে পাই। তাই নামার সময় আমি চালক সাহেবকে কোন কারণ উল্লেখ না করে একটা ধন্যবাদ জানালাম, যা শুনে তিনি একটু অবাকই হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বাসে বসে থেকে বিভিন্ন পর্বে ওনার কথোপকথন শুনে আমি তার নামটাও জেনে গিয়েছিলাম – ‘পলাশ’। আমার আসন থেকে তোলা তার একটা ছবিও দিলাম, যেটা ইচ্ছাকৃতভাবে তুলিনি, সামনের দৃশ্য ধারণ করতে গিয়ে ফ্রেমে চলে এসেছে। অবশেষে রাত সোয়া একটায় বাস থেকে নেমে আবার তাকে এবং তার সহকারীকে (চালকের আদেশে সে সহকারী আমার হাতের ব্যাগটা ধরে আমাকে বাস থেকে নামতে সহায়তা করেছিল) হাতের ইশারায় ‘বাই বাই’ বলে খোদা হাফেজ জানালাম। এবারে চালক সাহেব একটু মুচকি হেসে আমার শুভেচ্ছাটুকু একনলেজ করে কপালে হাত তুলে সেলাম জানালেন।


(দুই পর্বের এ কড়চা এখানেই সমাপ্ত হলো)

ঢাকা
২৪ জুলাই ২০২১
শব্দ সংখ্যাঃ ১১২০
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১১:৩২
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×