মৃত্যু কি কখনো প্রশান্তির হয়, কিংবা হতে পারে? মৃত ব্যক্তি যেহেতু সেটা জানিয়ে যেতে পারে না, জীবিতরা কেবলই অনুমান করতে পারে। আজ আমি আমার একজন শিক্ষকের মৃত্যু সম্বন্ধে সামান্য কিছু কথা বলবো, যার সম্বন্ধে একটি বিশদ ধারণা দিয়ে আমি গত ১২ এপ্রিল তারিখে একটি পোস্ট লিখেছিলাম (এখানে ১৮ এপ্রিলে প্রকাশিত)। সে পোস্টটি দেখা যাবে এখানেঃ একজন শিক্ষকের কথাঃ আমাদের দোহা স্যার
আমার সেই শিক্ষকের নাম মোহাম্মদ শামসুদ্দোহা, বা সংক্ষেপে এম এস দোহা, আরও সংক্ষেপে “দোহা স্যার”। গত ১২ এপ্রিল ২০২১ তারিখে আকস্মিকভাবে তাঁর কাছ থেকে একটি টেলিফোন কল পেয়ে আমি যুগপৎ আনন্দে এবং বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি একনাগাড়ে ৪৫+ মিনিট আমার সাথে কথা বলেছিলেন, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনেছিলাম। এর পর থেকে প্রতিমাসে দুই তিনবার করে তাঁর সাথে আমার টেলিফোনে আলাপ হতো। তিনিও ফোন করতেন, আমিও করতাম, তবে মনে হয় তাঁর কল সংখ্যাই কিছুটা বেশি হবে। গত জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমার মায়ের অসুস্থতার কারণে আমি রংপুরে তাঁর শয্যাপাশে ছিলাম প্রায় মাসাধিক কাল। দোহা স্যার সেই সময়ে খুব ঘন ঘন আমাকে ফোন করে আমার এবং আমার মায়ের খোঁজ খবর নিতেন এবং নানারকমের পরামর্শ দিতেন। রংপুর থেকে ফিরে এসেও ওনার সাথে নিয়মিত কথা হয়েছে, প্রতিবারই তিনি আমার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করেছেন। শেষবারের কথা বলার পর অনেকদিন পার হয়ে গেল, এ কথাটা মাত্র দু’দিন আগেই স্মরণ করেছিলাম এবং তাকে কল করবো বলে মনস্থ করেছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই তা ভুলে গিয়েছিলাম। গতকাল বিকেলে বুকে তিরের মত এসে বিঁধলো তার মৃত্যু সংবাদ!
এ সংবাদটি পেয়ে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে বসে থাকলাম। ফোনের কন্ট্যাক্ট লিস্টে তাঁর নামটাতে এসে চোখ দুটো স্থির হয়ে রইলো। জানি, তাঁর কণ্ঠস্বর এ জীবনে আর কখনো শুনতে পাবো না, তবুও কল করলাম। কেউ একজন কলটা কেটে দিল, এটাই প্রত্যাশিত ছিল। তবে কিছুক্ষণ পরেই সেই ফোনটি থেকে একটা রিটার্ন কল আসলো। আমি সালাম জানিয়ে আমার পরিচয় দিতেই ওপার থেকে এক নারীকণ্ঠ আমাকে জানালেন, “আংকেল, আমি আপনার স্যারের মেয়ে, আপনার নামটি এ ফোনে সেভ করা আছে। শুনেছেন তো বোধহয়, আব্বা আজ সকালে মারা গেছেন”। আমি কী বলবো তা বুঝতে পারছিলাম না। আস্তে করে তাকে বললাম, “আরেকটু কিছু বলতে পারো”? সে যা জানালো, তার সংক্ষিপ্তসার এ রকমঃ
দোহা স্যার আগের রাতে, অর্থাৎ ২৪ অক্টোবর ২০২১ রাতে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় ডিনার করে শয্যা নিয়েছিলেন। তিনি সে রাতে খুব হাসিখুশি ছিলেন এবং সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলেছেন। ফজরের নামাযের সময় তার মা তাঁকে নামায পড়তে দেখেছেন। নামায পড়ে তিনি প্রতিদিনের মত আবার শুয়ে পড়েন। অভ্যেসমত তিনি সকালে একটু দেরিতেই উঠতেন। কিন্তু সেদিন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি ঘুমাচ্ছিলেন। তার মা কয়েকবার তাঁকে ডাকতে গিয়েও ফিরে এসেছেন। শেষেরবার গিয়ে দেখেন, তার কোন সাড়া শব্দ নেই, তিনি ঘুমিয়েই আছেন। পায়ের পাতায় হাত দিয়ে দেখেন, পা ঠাণ্ডা। তাঁর ডাকাডাকিতে বাসার আর সবাই একে একে এসে অস্থির হয়ে ডাকতে ডাকতে কান্নায় ভেংগে পড়ে। ডাক্তার এসে জানালেন, তিনি আর এ জগতে নেই!
আমি স্যারের মেয়েকে বললাম, “স্যার আমাকে জানিয়েছিলেন, তিনি একটি আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথা লিখেছেন, যা পুস্তক আকারে প্রকাশ করার ইচ্ছে তাঁর আছে। পাণ্ডুলিপিটি সম্পাদনার চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। এখন তোমাদের দায়িত্ব হবে স্যারের এ ইচ্ছেটা বাস্তবায়ন করা এবং এ ব্যাপারে প্রুফরীডিং থেকে শুরু করে যে কোন সাহায্যের জন্য আমাকে তোমরা পাশে পাবে”। সে রাজী হলো, এবং আমার সাথে পরে যোগাযোগ করবে বলে জানালো। ফোনে গাড়ীর হর্নের শব্দ পাচ্ছিলাম বলে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি এখন কোথায়”? সে জানালো ওরা সপরিবারে মরদেহ নিয়ে স্যারের পৈতৃক বাড়ি রাজশাহীর পথে। একটু পরে ওর মা অর্থাৎ মিসেস দোহা আমাকে কল করে জানালেন, আগের দিনেও স্যার পান্ডুলিপির কাজ করেছেন এবং সম্পাদনার কাজ আর সামান্যই বাকি আছে বলে তাকে জানিয়েছেন। আমার সাথে স্যারের যতবারই কথা হয়েছে, আমি তাকে সম্পাদনার কাজ দ্রুত সমাপ্ত করার তাগিদ দিয়েছি। কেন, সেটা আমার আগের পোস্টের শেষ অনুচ্ছেদটি পড়লেই বোঝা যাবে।
আগের রাতে সবার সাথে হাসিখুশিতে গল্প করে শয্যা নেয়ার পর ঘুমিয়েছেন, ভোরে ফজরের ওয়াক্তে নামায পড়ে আবার ঘুমিয়েছেন, এবং সে ঘুমটিই ছিল তার চিরনিদ্রা। কোন কাতরতা নেই, কোন আর্ত-চিৎকার নেই, কাউকে ডাকাডাকি নেই, নীরবে নিঃশব্দে শেষ ফরযটুকু আদায় করে তিনি ইহজগতের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে গেলেন লোকান্তরে। এর চেয়ে প্রশান্তির মৃত্যু আর কী হতে পারে?
ঢাকা
২৬ অক্টোবর ২০২১
শব্দ সংখ্যাঃ ৬৩২
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০২১ বিকাল ৪:০২