দারিদ্র ওর শৈশব কেড়ে নিয়েছে, আর প্রকৃতি কেড়ে নিয়েছে ওর ভাষাঃ
২০১৭ সালের শুরুর দিকের কথা। একদিন সকালে আমার এক বন্ধুপত্নী আমার গিন্নীর কাছে প্রস্তাব রাখলেন, “চলো, আজ দুপুরে ‘৩০০ফিট’ এ গিয়ে খেয়ে আসি। শুনেছি ওখানকার ভাজি-ভর্তা-মাছ-ডাল-ভাত এর খাবার নাকি ভারি মজার”। গিন্নী কিছুটা নিমরাজী ছিলেন, তথাপি তিনি কথাটা আমার কাছে পাড়লেন। আমি প্রথমে “৩০০ফিট এ গিয়ে খেয়ে আসি” কথাটা শুনে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। পরে গিন্নী বুঝিয়ে দিলেন, ‘৩০০ফিট’ অবাক হবার মত কিছু নয়। নির্মীয়মান মহাসড়কের প্রস্থ অনুযায়ী এলাকাটার ওরকমই নামকরণ করা হয়েছে। যাহোক, আমি পেটুক মানুষ। ‘ভাজি-ভর্তা-মাছ-ডাল-ভাত’ এর এমন লোভনীয় প্রস্তাবটা আমি ফেলতে পারলাম না, তাই তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গেলাম। সময় ঠিক করে নিয়ে আমরা দুটো পরিবার একসাথে সেখানে গেলাম, এবং অন্ততঃ আমি খুব তৃপ্তির সাথে খেলাম। কিন্তু খাবার বর্ণনা দেয়ার জন্য এ উপক্রমণিকা নয়। খাবার পর দুই গিন্নী সাব্যস্ত করলেন, স্থানীয় বাজার থেকে কিছু টাটকা শাক-সব্জী কিনে নিয়ে যাবেন। এতেও আমার কোন আপত্তি ছিল না, কিন্তু সেখানে গিয়েই একটি মায়াবী মুখের ক্ষণিকের দেখা পেয়ে গেলাম, যে কারণে এ লেখা।
সব্জী বাজারে দুই গিন্নী সব্জী কিনছেন, আমরা দুই বন্ধু পাশে দাঁড়িয়ে আলাপ করছি। হঠাৎ দেখি, নয়-দশ বছরের একটা মিষ্টি মেয়ে আমাদের পাশে ইতস্ততঃ ঘোরাঘুরি করছে। চেহারায় তার একটা দারিদ্রের ছাপ থাকলেও, সে পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিহিত ছিল। পরনে তার একটা সবুজ-সাদা বলপ্রিন্টের ফ্রক। পায়ে তার আকাশী-গোলাপী ফিতেওয়ালা সস্তা স্যান্ডেল। চুলগুলো তার পরিপাটি করে আঁচড়ানো ছিল, মুখে একটা হাল্কা মিষ্টি হাসি তার মুখটাকে উজ্জ্বল করে রেখেছিল। হাতে ধরা ছিল ছোট দুটো পলিথিনের ব্যাগ, তার ভেতরে সবুজ পাতা জাতীয় কিছু দেখা যাচ্ছিল। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই সে হাতে ধরা ব্যাগদুটো সামান্য তুলে ধরে একটু হাসলো। আমি তাকে কাছে ডেকে পলিথিনের ভেতর কী আছে তা জানতে চাইলাম। সে ব্যাগের মুখটা খুলে দেখালো, সেখানে ব্যাগভর্তি কিছু শাক, যেটাকে আমাদের স্থানীয় ভাষায় ‘থানকুনি পাতা’ বলে। ছোটবেলায় দেখতাম, পেটের পীড়া কিংবা আমাশয় হলে এ পাতার রস খাওয়ানো হয়, এবং তা অব্যর্থ ঔষধের কাজ করে। এ ছাড়াও, শাক হিসেবেও পাতাগুলো খাওয়া যায়। শাকগুলোর দাম কত, তা জিজ্ঞেস করে আমি তার কাছ থেকে উত্তর হিসেবে শুধুই একটা নির্বাক হাসি পেলাম। একজন দোকানদার বললো, “স্যার, মেয়েটি বোবা”। মেয়েটিও একটু মাথা নেড়ে, মুচকি হেসে সে কথায় সায় দিল। “বোবা” কথাটি আমার প্রাণে যেন আঘাত করে গেল! বোবা, কালা, কানা, ট্যারা ইত্যাদি শব্দ এখনও লোকজন নির্বিচারে ব্যবহার করে থাকে, যার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলা, তার মনের সংবেদনশীলতার প্রতি মোটেই তোয়াক্কা না করে।
প্রয়োজন না থাকলেও, আমি তার কাছ থেকে শাকগুলো কিনে নিলাম। দাম দেয়ার সময় আবার সেই হাসি, একেবারে নিঃশব্দ হাসি। প্রকৃতির বুকে আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা এসব শাক-পাতা কুড়িয়ে মেয়েটির দৈনিক উপার্জন বড় জোর দুই একশত টাকার মত হতে পারে। এটা দিয়েই হয়তো সে ক্ষুধা নিবারণ করে, এবং তার পর হাতে যা থাকে, তা দিয়ে হয়তো সে তার শখের কোন কিছু কিনে থাকে। এত মিষ্টি একটা হাসিমাখা মায়াবী মুখ, অথচ সেই মুখের হাসির পেছনে কত বড় বঞ্চনা ওর ক্ষুদ্র বুকে চিরস্থায়ী বাসা বেঁধে আছে! ভেবে আফসোস হয়, যে দারিদ্র ওর শৈশব কেড়ে নিয়েছে, আর প্রকৃতি কেড়ে নিয়েছে ওর মুখের ভাষা! বাক প্রতিবন্ধী এ শিশুটির নির্মল কিন্তু নিঃশব্দ হাসিটিই যেন এই নির্মম বঞ্চনার নীরব প্রতিবাদ!
দেশের একজন সুনাগরিক তার আচরণ দ্বারা দেশকে প্রমোট করতে পারেঃ
২০১৭ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে পাঁচ দিনের জন্য সস্ত্রীক ভুটান সফর করেছিলাম। ঐ পাঁচ দিনের জন্য আমাদের ট্যুর গাইড-কাম ড্রাইভার ছিল মিগমা শেরিং (MIGMA TSHERING) নামের এক যুবক। অবিবাহিত মিগমা ভারতের দার্জিলিং এ গ্রাজুয়েশন করেছে। তার একজন সহকারীও ছিল, যে বয়সে তার থেকে বড় হলেও তার নির্দেশের প্রতি অনুগত ছিল। তার নাম ছিল ওয়াংচেন টবগিয়েল (WANGCHEN TOBGYEL)। পারো বিমানবন্দর থেকে বাইরে বের হয়ে দেখি একটা সুন্দর দশ সীটের মাইক্রোবাস, তার সামনে অনেকটা সৈনিকদের মত এক সারিতে দাঁড়ানো দু’জন ভুটানী, তাদের জাতীয় পোষাকে, অর্থাৎ হাফ প্যান্ট, হাঁটু মোড়া কালো মোজা আর ওপরে মেয়েদের কাফতান জাতীয় একটা কটিবন্ধনযুক্ত পরিচ্ছদে আবৃত। পরে ওদের সাথে আলাপচারিতায় জেনেছি, অফিসে আদালতে, দাপ্তরিক কাজে কিংবা কোন কর্তব্য পালনের সময় ওদেরকে ঐ পোষাকই পরিধান করতে হয়। অন্যান্য সময় ওরা যখন আড্ডা দেয় কিংবা কোথাও ঘোরাফিরা করে, তখন ওরা জীন্স/ডেনিম এবং পোলো/টী শার্ট পরিধান করতে পারে। ওদেরকে দেখে প্রথম যে চিন্তাটা আমার মাথায় এলো, আমাদের যদি কোন জাতীয় পোষাক থাকতো, তাহলে আমাদেরকে কেউ দৈনন্দিন দাপ্তরিক কাজে কর্মে কি ঐ পোষাকটি পরিধানে বাধ্য করাতে পারতো?
আমি এখানে শুধু আমাদের ট্যুর গাইড MIGMA TSHERING সম্বন্ধেই কিছু কথা বলবো। বয়স ২৭/২৮ বছর হবে, অত্যন্ত মায়াবী চেহারা। সে এগিয়ে এসে শুদ্ধ ইংরেজীতে প্রথমে নিজেকে, পরে WANGCHEN TOBGYEL কে পরিচয় করিয়ে দিল। ওরা উভয়েই ছিল বয়সে প্রায় আমাদের সন্তানসম। প্রথম কয়েক ঘন্টা অত্যন্ত মিতবাক ছিল। তারপরে আস্তে আস্তে চলার পথে আলাপচারিতায় সুযোগ পেলেই ওরা হাল্কা হিউমার যোগ করে আমাদের সাথে বেশ হাসি ঠাট্টা করে চলছিলো। কিন্তু সেটা ছিল খুবই শোভন এবং শিষ্টাচারসম্মত। দুই দিন পর ওরা কিছুটা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক তথ্যও শেয়ার করেছিল। নিরীহ প্রকৃতির মিগমা জানাল, জন্মের পর পরই সে তার মাকে হারায়, পরে তার বাবা আবার বিয়ে করে। ফলে সে কিছুকাল সৎ মায়ের আশ্রয়ে এবং পরে নেপালী বংশোদ্ভূত তার বড় ভাবীর সংসারে বড় হয়। অত্যন্ত ভাল লেগেছে যে সে আমাদের সাথে আলাপচারিতায় তার বাবা, সৎ মা, বড় ভাই এবং বড় ভাবী, সবার সম্বন্ধে খুব প্রশংসা করেছে এবং কারো সম্বন্ধে একটাও বদনাম করে নাই। সে আরও জানাল, কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে এখনও গ্রামে গিয়ে তার বাবাকে কৃষিকাজে সাহায্য করে। দারুচিনি তাদের প্রধান অর্থকরী ফসল বলে সে জানায়।
মিগমা যখন কথা বলতো, তখন তার কথায় ও চোখেমুখে সমীহ প্রকাশ পেত। তার ড্রাইভিং ত্রুটিহীন ছিল, সড়ক শৃঙ্খলা মেনে চলার ব্যাপারে সে একশ’তে একশ’ পাবে। বিদায় ক্ষণে সে স্মিত হেসে আমাদেরকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছিল, দীর্ঘক্ষণ করমর্দন করেছিল এবং মস্তক অবনত করে আমাদেরকে শুভকামনা জানিয়েছিল। প্লেনে বসে আমি তার সেই স্মিতমুখ স্মরণ করছিলাম এবং ভাবছিলাম, দেশের একজন সুনাগরিক তার আচরণ দ্বারা দেশকে কতটা প্রমোট করতে পারে!
সেই অশীতিপর বৃদ্ধাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করিঃ
বছর চারেক আগের কথা। থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই এর Doi Inthanan National Park ঘুরে ফিরে দেখছিলাম। কিছুক্ষণ হাল্কা ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, ক্ষুধাও পেয়েছিল। ট্যুর গাইডের বেঁধে দেওয়া সময় অনুযায়ী আবার সবাই একত্রিত হ’লাম, আমরা সাকুল্যে ছিলাম দশ জন। মাথা গোণার পর গাড়ীতে বসেই সাব্যস্ত হলো, লাঞ্চের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার আগেই পথে তাজা ফলমূল ও সব্জীর জন্য বিখ্যাত বাজার মং মার্কেট (Hmong Market) পড়বে, আমরা সেখানে দশ মিনিটের একটা যাত্রাবিরতি করে কিছু তাজা ফলমূল খাবো/কিনে নিব।
সেই অনুযায়ী আমরা সেখানে নেমে আমি ও আমার স্ত্রী কিছু গার্ডেন ফ্রেশ স্ট্র’বেরী খেলাম। খাওয়া শেষ করে আমি পথের পাশে গাড়ীর কাছে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ খেয়াল করলাম, কয়েকজন বয়স্কা রমণী পিঠে ঝুড়ি বেঁধে তাজা ফলমূল ও শাকসব্জী বয়ে নিয়ে মাথা নীচু করে আনমনে হেঁটে আসছেন। আমার একেবারে কাছে আসার পর আমি একজন অশীতিপর, অতীব সুন্দরী রমণীকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। আমাদের দেশে ঐ বয়সী নারীদেরকে সাধারণতঃ কারো না কারো সাহায্য নিয়ে পথ চলতে হয়। অথচ উনি পায়ে বুট পরে, পিঠে আমাদের অনেকটা সিলেটী চা শ্রমিকদের মত করে ঝুড়ি বেঁধে পাহাড়ী উপত্যকা থেকে বয়ে আনা শাক সব্জী, ফলমূল ইত্যাদি নিয়ে আপন মনে হেঁটে চলেছেন তার নির্দিষ্ট গন্তব্যপানে। মং মার্কেটে এসে তিনি তার পিঠ থেকে ঝাঁপি নামিয়ে রুমাল দিয়ে চোখমুখ মুছলেন। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তার সাথে কিছুটা আলাপ করার। আমাদের ট্যুর গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম, তার সাথে কিছুটা আলাপ করা যাবে কিনা। ট্যুর গাইড আমাকে নিয়ে তার কাছে গেলেন এবং তার সাথে স্থানীয় ভাষায় কিছু কথা বললেন। উনি হাসিমুখে আমার দিকে তাকালেন। ট্যুর গাইড এর মধ্যস্থতায় সামান্য কিছু আলাপ হলো। তিনি জানালেন, তিনি নীরোগ এবং প্রতিদিন তিনি এ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তার ছেলেমেয়ে, নাতি পুতি সবই আছে, কিন্তু তিনি তাদের কারও উপর নির্ভরশীল নন। আমি তার সাথে একটা ছবি তুলতে পারি কিনা জিজ্ঞেস করলে উনি এক গাল হেসে তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গেলেন। তার চেহারা দ্যূতিময় ছিল, বিশেষ করে তার চোখ দুটো দেখে তাকে একজন অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয়ী এবং গর্বিতা রমণী বলে মনে হলো। উনি উজ্জ্বল বর্ণের নানারকম সাজসজ্জা বিশিষ্ট পোষাক পরিহিতা ছিলেন, মাথায় এক ধরণের মস্তকাবরণীও পরেছিলেন। উজ্জ্বল ফর্সা তার রেখাঙ্কিত মুখ দেখে মনে হয়েছিল যেন তার মুখে কালের রোজনামচা লেখা আছে। বেশ হাসিখুশী মুখে তিনি ছবি তুলে বিনয়ের সাথে আবার তার পথযাত্রার অনুমতি চাইলেন। আমি তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিদায় জানালাম, এরই মধ্যে বাকী যাত্রীরা এসে পড়ায় আমাদেরও যাত্রা শুরু হলো।
একটি ছোট্ট স্মৃতি, কিন্তু মনে অনেক মায়ার সাথে আমি সেই অশীতিপর বৃদ্ধাকে স্মরণ করি। যারা তাদের নিজেদের জীবন ও জীবিকাকে ভালবাসে এবং তা যতই নগন্য হোক না কেন, তা নিয়ে গর্ববোধ করে, তাদের চেহারাতেও সে গৌরবপ্রভা দীপ্যমান হয়।
ঢাকা
১০ নভেম্বর ২০২১
শব্দসংখ্যাঃ ১৩২০
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২২ সকাল ১১:৩৪