somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হেমন্তের কথা

১৬ ই নভেম্বর, ২০২১ রাত ১১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


হাঁটুরেবিহীন ফাঁকা পথ ....
১৬ নভেম্বর ২০২১, ১২ঃ৪৫ অপরাহ্ন

আজ পহেলা অগ্রহায়ণ। আজ থেকে শুরু হলো হেমন্ত ঋতুর দ্বিতীয় মাস। আমার জন্ম-মাস। শৈশবে-কৈশোরে পর পর কয়েকটি শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় বাংলা রচনা লিখার জন্য “তোমার প্রিয় ঋতু” একটি অবধারিত বিষয় ছিল। আমি সাধারণতঃ বাংলা বা ইংরেজী রচনা, কোনটাই মুখস্থ লিখতাম না। কারণ মুখস্থ লিখেছি বুঝতে পারলে শিক্ষক মহোদয় সে রচনায় কম নম্বর দিতেন। নিজে চেষ্টা করে লিখলে, যে রকমই লিখি না কেন, মুখস্থ লেখার চেয়ে ভালো নম্বর পেতাম। সে বয়সটাতে প্রথম প্রথম একমাত্র বসন্ত ঋতু নিয়েই লিখতাম। কারণ এ ঋতুর সৌন্দর্য বাসার সামনের সড়কের সারিবদ্ধ কৃষ্ণচূড়ার শাখা থেকে আমাদের ক্ষুদ্র বাগানের ডালিয়া-সূর্যমুখী-হলিহক-জিনিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ ছাড়াও চোখ খুললেই সর্বব্যাপী এ ঋতুর সৌন্দর্য দেখতে পেতাম, কান পাতলেই কোকিলের কুহু ডাক শুনতে পেতাম। রচনা বানিয়ে লেখার জন্য এসব চাক্ষুষ স্মৃতি অত্যন্ত সহায়ক ছিল। আরেকটু বড় হয়ে শীতকালে যখন ব্যাডমিন্টন খেলতাম, মায়ের, বোনের হাতে বোনা সোয়েটার পরে ঘোরাঘুরি করতাম, তখন নিজের মধ্যে নিজেই একটা স্মার্ট ভাব লক্ষ্য করতাম। এসব কারণে তখন শীতকালটাই প্রিয় হয়ে উঠলো। এ ছাড়া পিঠা-পুলি খাওয়ার আনন্দ তো ছিলই। আরও একটু বড় হলে কেমন করে যেন বর্ষাকালটাও প্রিয় হয়ে উঠলো, যেটাকে আগে খুব অপছন্দ করতাম। তখন একটু একটু করে গান শোনার প্রতিও আগ্রহ জন্মালো। বর্ষা নিয়ে লেখা রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলো খুব ভালো লাগতো। কিছু আধুনিক গানও। এক বর্ষণমুখর দিনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে “এই মেঘলা দিনে একেলা” গানটি শুনে এতই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম যে সারাটা দিন ধরে শুধু ঐ একটি গানই শুনেছিলাম, সাথে গেয়েওছিলাম। আর বর্ষার রবীন্দ্রসঙ্গীত অনেকগুলোই খুব প্রিয় ছিল, তবে “এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়” শুনে বুকে যে শূন্যতা অনুভব করতাম, সেটা প্রকাশ করার ক্ষমতা ঐ বয়সে তো ছিলই না, এমনকি আজও নেই!

যাহোক, শীত-বসন্তের সৌন্দর্য দু’চোখ দিয়ে দেখে যতটুকু অনুভব করা যায়, শৈশবে ততটুকুই পরীক্ষার খাতায় লিখতাম। কৈশোরে বাহ্যিক দু’চোখ দিয়ে দেখার সাথে সাথে মনের ‘তৃতীয় নয়ন’ দিয়ে দেখা এবং অনুভব করা কিছু কথাও রচনায় যোগ করে দিতাম। এতে ভালো ফল পেতাম। ফলে, অচিরেই রচনা লেখা আমার একটা প্রিয় বিষয়ে পরিণত হয়ে গেল। কৈশোরের চোখে বর্ষার সাথে সাথে শরতও তার অপার সৌন্দর্য নিয়ে আবির্ভূত হতে লাগলো। শরতের সাদা কাশফুল, ভাসমান নীল-সাদা মেঘের ভেলা, রৌদ্রকরোজ্জ্বল নীলাকাশ ইত্যাদি সবকিছুই দু’চোখ জুড়িয়ে দিত। আর তার সাথে মাঝে মাঝে হয়তো যোগ হতো তৃতীয় নয়নে দেখা মেঘের রঙে নীলাম্বরি সজ্জিতা কোন অদেখা মেঘবালিকার ছবি। এভাবেই এ চারটি ঋতু শৈশবে-কৈশোরে আমার মনে প্রভাব রেখে যেত। তবে বয়স যত বেড়েছে, বর্ষা আর শরতকালের সাথে আমার তৃতীয় নয়নের সখ্যও তত বেড়েছে, একের উপর অপরের অধিকারের ব্যাপ্তিও তত বেড়েছে।

লেখাটার শিরোনাম দিয়েছি ‘হেমন্তের কথা’, কিন্তু এ পর্যন্ত হেমন্তের কথা তো কিছুই বললাম না। কারণ, শুধু শৈশবে-কৈশোরে কেন, যৌবনেও হেমন্তকে আমার সেভাবে দেখা হয়নি। গ্রামীন জীবনে হেমন্তের প্রথমার্ধ দুঃখ কষ্টের মাস, এর কারণ খাদ্যাভাব এবং গেরস্তের ক্রয়ক্ষমতাহীনতা, যাকে আমাদের স্থানীয় ভাষায় ‘মঙ্গা’ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু পরের অর্ধেকে গেরস্তের মুখে হাসি ফোটে, কারণ সেটা ধান কাটার মাস, নবান্নের মাস। গেরস্তের ঘরে তখন নতুন ধান চলে আসে, খাদ্যাভাব দূর হয়, গেরস্তের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। আকাশে বাতাসে নবান্নের সুবাসিত ঘ্রাণ থাকে, মানুষের সাথে সাথে গবাদি পশুরও নতুন ধানের নতুন বিচালি দিয়ে নবান্ন শুরু হয়। প্রকৃতির মাঝে একটা সুখ সুখ অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। আমি শহরে মানুষ হয়েছি, তাই গ্রামীন জীবনের এই হৈমন্তিক সুখগুলোর পরশ আমি গভীরভাবে অনুভব করিনি। কিন্তু এখন এই প্রৌঢ়ত্বে এসে আমি হেমন্তের মায়াবী সৌন্দর্য ঠিকই খুঁজে পাই। সকালে ও সন্ধ্যায় কুয়াশার কুহেলিকা মনকে এক মায়ার ইন্দ্রজালে আচ্ছন্ন করে রাখে। হেমন্তের বৈকালিক রোদের যে একটা আলাদা রং আছে, সেটা আমি এখন ঠিকই দেখতে পাই, যদিও দিনের হ্রস্বতার কারণে বিকেলকে খুঁজে পাওয়াটাই অনেক সময় মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। হেমন্তের আহ্নিক দিনগুলো খুব দ্রুতগামী হয়। জীবনের হেমন্তকালে এসে এখন আমি দেখতে পাই, আমাদের জীবনটাও কত দ্রুতগামী, বিশেষ করে জীবনের হেমন্তকালটা! আমাদের জীবনটাই ‘এই আছি, এই নেই’- পদ্ম পাতায় জল, তার মধ্যে জীবনের হেমন্তকালটা বোধকরি সবচেয়ে দ্রুত এবং আকস্মিক বিদায় নেয়। প্রকৃতিতে যেমন হেমন্তের পরে শীত এসে সবকিছু আড়ষ্ট করে দেয়, জীবন পরিক্রমায়ও তেমনি বয়সের হেমন্তকালের পর শীতকাল এসে জীবনটাকে জ্বরাগ্রস্ত করে দেয়।

আমাদের দেশে হেমন্তকাল থেকেই গাছের পাতা ঝরা শুরু হয়। শীতকালে সব গাছপালা নাঙ্গা হয়ে যায়। হেমন্তের ঝরা পাতায় আমরা শুধু কান্নার ধ্বনি শুনতে পাই, বিদায়ের বারতা পাই। তাই তো মৃত্যুর মাত্র দশ বছর পূর্বে বয়স্ক কবিগুরু লিখেছিলেন এবং গেয়েছিলেনঃ “ঝরা পাতা গো, আমি তোমারই দলে, অনেক হাসি, অনেক অশ্রুজলে..... অস্তরবি লাগাক পরশমনি, প্রাণের মম শেষের সম্বলে”! পদতলে ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনি মনকে বিষণ্ণ করে তোলে, মনটা কেমন করে ওঠে! যান্ত্রিক এ যুগে ইন্টারনেট এর মাধ্যমে সামাজিক মিডিয়ায় আমরা আমাদের দেশের পাশাপাশি বিদেশের হেমন্ত বা “ফল” এর সময় ধারণকৃত প্রকৃতির রঙিন চিত্র দেখতে পাই। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কানাডা, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার “ফল” এর সুদৃশ্য চিত্র ফেসবুকের মাধ্যমে ক্রমাগত দেখতে পাচ্ছি। কি অপরূপ, মনোহর দৃশ্য! কত বিচিত্র রঙের সমারোহ! লাল-নীল-হলুদ-সবুজ-বেগুনি-সোনালি রঙের ফুলে ও পাতায় পাতায় শোভিত থাকে চারিপাশ! পথের পাশে পড়ে থাকা ঝরা পাতাদের মুখেও থাকে কত উজ্জ্বল হাসি, যেন ওরা প্রকৃতির শোভা বর্ধন করার কর্তব্য পালন শেষে হাসিমুখে বিদায় নিচ্ছে। বিদায়ের সময়ও ওরা কত রঙিন, মোটেই ধূসর নয়!

গত তিনটে দিন, অর্থাৎ কার্ত্তিকের শেষ তিনটে দিন ঢাকাবাসীরা চমৎকার আবহাওয়া উপভোগ করেছেন। প্রভাতে এবং অপরাহ্নে হাল্কা কুয়াশাবৃত চারিপাশ, দিনের বাকিটা সময় মেঘে ঢাকা ধূসর আকাশ। হাল্কা হাল্কা শীতের আমেজ গৃহিনীদেরকে লেপ-কাঁথা-কম্বল বের করার বারতা দিয়ে গেছে। সাথে মাঝে মাঝে ঝিরঝিরে বৃষ্টি ভাবুক মানুষের মনে দোলা দিয়ে গেছে। আজ একটু তাও রোদের হাসি দেখা গেছে। ভরদুপুরে হাঁটতে বের হয়েছিলাম। হাঁটার পথটা অন্যান্য সময়ের চেয়ে ফাঁকা ছিল। গল্প করে হাঁটার মত কাউকে পাইনি। ফাঁকা পথে শীতের আমেজ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছু ছবিও তুললাম। তখন মেঘ কেটে গেছে, গোমরামুখি আকাশে রোদের ঝিলিক ফুটেছে।

যাক, হেমন্তের কথা বলতে গিয়ে সব ঋতুর কথাই তো বলা হলো, শুধু গ্রীষ্মকাল ছাড়া। গ্রীষ্মের নিদাঘ দুপুরে উদাসী ঘুঘুর ডাক শোনা আর মধুমাসে ফলফলাদি খাওয়া ছাড়া এ ঋতুর আর কোন আকর্ষণ আমি এখনো পর্যন্ত অনুভব করিনি। কে জানে, হয়তো আগামীতে গ্রীষ্মও ভাললাগার কোন বদ্ধ দুয়ার খুলে দিতে পারে!



ঢাকা
পহেলা অগ্রহায়ণ
১৬ নভেম্বর ২০২১
শব্দ সংখ্যাঃ ৯১৫

(নীচের ছবিগুলো আমার আই-ফোনে তোলা। সময় ও তারিখ ছবির নীচে উল্লেখিত হয়েছে)


পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদের ঝিলিক.....
১৬ নভেম্বর ২০২১, ১২ঃ৩৮ অপরাহ্ন


রোদের হাসি.....
১৬ নভেম্বর ২০২১, ১২ঃ৩৮ অপরাহ্ন


রৌদ্রছায়া....
১৬ নভেম্বর ২০২১, ১২ঃ৩৪ অপরাহ্ন
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০২২ সকাল ১১:৪৯
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×