তার আত্মপ্রত্যয়ী অভিব্যক্তিটা আমার খুব ভালো লেগেছে।
১৪ মে ২০২২।
মেলবোর্ন শহরের প্রাণকেন্দ্র সেন্ট্রাল বিজিনেস ডিস্ট্রিক্ট এর আশে পাশে পায়ে হেঁটে কিংবা ট্রামে করে ঘুরে ঘুরে দেখার মত অনেক কিছুই আছে, যা আমাদের তখনো দেখা হয় নাই। দুপুরে একটু আর্লী লাঞ্চ করে আমরা দু’জন ট্রেন করে রওনা হ’লাম Flinders Street স্টেশনের উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর একটা পঞ্চাশ বেজে গেল। তড়িঘড়ি করে স্টেশন থেকে বের হয়ে দেখি রাস্তার অপর পার্শ্বে ট্রাম স্টেশনে কোন ভিড় ভাট্টা নেই, তার বদলে এখানে সেখানে অনেক পুলিশ পায়চারি করছে। তাদের কয়েকটি দল সশস্ত্র, বাকিরা নিরস্ত্র। সামনে পড়া একজন ভলান্টিয়ারকে বললাম, “আমরা একটু ট্রামে করে শহরের আশে পাশের দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার জন্য এসেছি। ট্রাম চলছে না”? উনি জানালেন আপাততঃ চলছে না। কারণ? সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘কারণ বিক্ষোভ চলছে’। অবাক হলাম শুনে। এমন একটা শান্ত, নিরিবিলি শহরেও কিসের বিক্ষোভ? তবে যেহেতু বুঝতে পারলাম, এ নিয়ে ওনার বেশি কিছু বলার ইচ্ছে নেই, হয়তো অনুমতিও নেই, তাই আমি নিজেই একটু এগিয়ে গেলাম কোথায় ‘বিক্ষোভ চলছে’ তা দেখার জন্য।
সামনে এগোতেই দেখি চারিদিক থেকে মানুষ জড়ো হচ্ছে, হয়েছে। রাস্তার এক পাশে একটা ভ্যান দাঁড় করিয়ে সেখান থেকে সাউন্ড সিস্টেমে গণসঙ্গীত বাজানো হচ্ছে। তার সাথে তালে তালে কেউ ঠোঁট মিলিয়ে গান গাইছে, কেউ কেউ নাচছেও। অনেকেই বিচিত্র রঙের রঙিন পোষাকে সজ্জিত। কারও কারও হাতে মেগাফোন ধরা, সেটাতে ক্ষণে ক্ষণে একজন কিছু বলছেন, তার সাথে সাথে জনতা শ্লোগানে শ্লোগানে একই কথা উচ্চারণ করছে। সবার মনোবল খুব উঁচু বলে মনে হলো। উচ্চ ভলিউমে বাজানো গণসঙ্গীতের কারণে, এবং অস্ট্রেলীয় ইংরেজী এখনও ঠিকমত রপ্ত করতে পারিনি বলে মেগাফোনে এবং গণকণ্ঠে কী উচ্চারিত হচ্ছিল, তা প্রথমে বুঝতে পারিনি। তাই বিক্ষোভ প্রদর্শনকারী কয়েকজনের নিকট আমি এগিয়ে গেলাম। একজন বয়স্ক বিক্ষুব্ধকে দেখলাম হাতে একটি প্ল্যাকার্ড ধরা, সেখানে লেখা “The love of power destroys lives. The power of love protects lives. Your Choice.”
এ রকম আরও কয়েকটা লেখা পড়লামঃ
* The further society drifts from the truth, the more it will hate those that speak it.
* Want the Truth? Join TELEGRAM to see what media is hiding. World Doctors Alliance. Frontline workers speak out.
* Rein unvaxed worker now to end the health and jobs. CRISIS.
* এক হাস্যোজ্জ্বল মাঝবয়সীকে দেখলাম ‘Welding for Dummies’ শিরোনামে এক প্ল্যাকার্ড ধরে আছে। সেখানে লেখাঃ Learn to:
Cover Sexual assault to secure election. Get denied handshakes.
Book a trip to Hawai during bushfires.... .
Become a Prime Minister with a child molestation conviction.
How important it is to wear a visor (mask).
উল্লেখ্য যে, ২০১৯-২০ এ অস্ট্রেলিয়ার ভয়াবহ দাবানল বা ‘বুশফায়ার’ এর সময় অস্ট্রেলীয় প্রধানন্ত্রী স্কট মরিসন সস্ত্রীক হাওয়াই এ অবকাশ যাপনে গিয়েছিলেন বলে তিনি স্বদেশে ব্যাপকভাবে নিন্দিত এবং বিদেশি মিডিয়াতেও সমালোচিত হয়েছিলেন। কভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের সময় অত্যন্ত কঠোরভাবে কোয়ারেন্টাইন এবং জনগনের ঘরের বাইরে চলাফেরার উপরে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করে তিনি কিছু কিছু স্বাধীনচেতা জনগোষ্ঠীর নিকট অজনপ্রিয় হয়ে উঠেন।
*Less Government, More Freedom.
* প্ল্যাকার্ডে একজনের একটা ছবি দিয়ে তাতে লেখা আছেঃ Vote #1 MFER.
* SACK THEM.
* BORN FREE
আমি বিক্ষোভে অংশ নেয়া দুই একজনের সাথে কথা বলে যা বুঝতে পারলাম, এরা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তার প্রশাসনের উপর চরম নাখোশ, মূলতঃ জোর করে জনগনের উপর প্রত্যক্ষভাবে না হলেও, পরোক্ষভাবে কভিড-১৯ এর টিকা গ্রহণ বাধ্যতামূলক ভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য। ফেডারেল সরকারের চাপ ছাড়াও, ভিক্টোরিয়ার প্রাদেশিক সরকারও দীর্ঘদিন ধরে জনগণকে ঘরের ভেতর আটকে রেখেছিল। হোম কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক করেছিল। কিছুদিনের জন্য সন্ধ্যার পর জনগণের চলাচল রুখতে সান্ধ্য আইনও জারি করেছিল। মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছিল, এর ব্যত্যয় করলে উচ্চহারে জরিমানা ধার্য করেছিল। ইত্যাদি কারণে জনগণ অতিষ্ঠ হয়েছিল।
এই বিক্ষোভ সমাবেশ চলেছিল (আমি উপস্থিত হবার পর যেটুকু দেখেছি) প্রায় ৩০ মিনিটের মত। কিছু গরম গরম কথাবার্তা আর হাসিঠাট্টার পর সবাই যেমন সুশৃঙ্খলভাবে জড়ো হয়েছিল, তেমনি সুশৃঙ্খলভাবেই গান গাইতে গাইতে, হাততালি দিতে দিতে স্থান ত্যাগ করেছিল। কোন মঞ্চ ছিল না, ছিলনা রাস্তার কোণে কোণে বসানো মাইক। মেগাফোন দিয়ে যতটা জোরে কথা বলা যায়, ততটুকুই সই ছিল। ওরা চলে যাবার পর যথারীতি ট্রাম চলাচল শুরু হলো। আমরাও একটা ট্রামে চেপে ইউনিভার্সিটি অভ মেলবোর্ন ঘুরে দেখতে রওনা হ’লাম।
এই ঘটনার মাত্র দশ দিনের মাথায় অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল হয়। লিবারেল পার্টির স্কট মরিসন কে হারিয়ে লেবার পার্টির এ্যান্থনি আলবানিজ (৫৯) ২৩ মে ২০২২ তারিখে আস্ট্রেলিয়ার ৩১তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসীন হন। এ্যান্থনি আদি ইতালীয় এবং ২০০০ সালে তিনি আইরিশ বংশোদ্ভূত কার্মেল টিব্বাট্ট এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু ২০১৯ সালে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর তিনি জোডি হেডন (Jodie Haydon) কে ‘পার্টনার’ হিসেবে গ্রহণ করেন। সেই সুবাদে জোডি হেডনই এখন অস্ট্রেলিয়ার ‘ফার্স্ট লেডী'। আর এ্যান্থনি আলবানিজই অস্ট্রেলিয়ার প্রথম একজন তালাকপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী (ডিভোর্সী প্রাইম মিনিস্টার)।
ঢাকা
০৪ অগাস্ট ২০২২
শব্দসংখ্যাঃ ৭১৩
Flinders Street স্টেশনের সম্মুখ প্রাঙ্গণ
Flinders Street স্টেশনের সম্মুখ প্রাঙ্গণে বিক্ষুব্ধ জনগণ সমবেত হচ্ছে।
ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ
ওয়াও, এটাও সম্ভব?
তার প্রাণোচ্ছ্বল হাসিটা ভালো লেগেছে। যুম করে দেখুন তিনি কী বলতে চাচ্ছেন ! সে বিষয়গুলো অবশ্য হাসির নয়!
তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছে, অবশ্য হাসিখুশি মুখেই!
টিকাবিরোধীদের স্পষ্ট বাণী
যে যার মত কথা বলছে, নীরবে প্ল্যাকার্ড ধরে বক্তব্য প্রকাশ করছে। কেউ শুনছে, কেউ ছবি তুলছে।
141422 May 2022
আমার আবার চয়েস কী? এত সুন্দর কথার সাথে কি দ্বিমত প্রকাশ করা যায়?
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ
আমরা এ কথাটা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করি।
জনতা জমায়েত হচ্ছে।
নীরব, কিন্তু নজরকাড়া।
বিক্ষোভ প্রদর্শন শেষে যে যার মত চলে যাচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০২২ দুপুর ১২:০৬