বেশ কিছুদিন ধরে, তা মাস ছয়েক তো হবেই, ফ্রোজেন শোল্ডারের ব্যথায় ভুগছি। বাঁ হাতটা উঁচুতে তুলতে, এপাশ-ওপাশ নাড়াচাড়া করতে বেশ অসুবিধে হয়, বেয়াকায়দায় নাড়া পড়লে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠতে হয়। রাতে বাঁ পাশ ফিরে শুতে পারি না। আমার ঘুমানোর স্বাভাবিক যে পজিশন, সে পজিশনেও ঘুমাতে পারি না, তবে তাতেও ঘুমকাতুরে আমার ঘুমের তেমন ব্যাঘাত অবশ্য ঘটেনা। হাত নাড়াচাড়া না করলে কোন সমস্যা হয় না। নাড়াতে গেলেই ঘটে যত বিপত্তি, ওজন বহন করতে গেলেও তাই। নাতি-নাতনিরা কোলে উঠতে চাইলে বাঁ কোলে নিতে পারি না। সবকিছু সয়ে নেয়াতে অভ্যস্ত আমি এভাবেই চলছিলাম গত ছ’টি মাস ধরে, ডাক্তারের কাছে যাব যাব করেও আর যাওয়া হয়নি। কিন্তু তিন দিন আগের রাতে আমার গিন্নী আচমকা তার পায়ে আঘাত পান। আঘাত পাবার পরেও তিনি কিছুক্ষণ স্বাভাবিক হাঁটা-চলা এবং স্বাভাবিক কাজ-কর্ম করে যাচ্ছিলেন, তাই প্রথমে ভেবেছিলাম, আঘাত হয়তো সামান্য ছিল। কিন্তু খানিক পরেই দেখা গেল তিনি পা ফেলতে পারছেন না। শুয়ে থাকলেও পা ব্যথা করছিল এবং ক্রমেই তা তীব্রতর হচ্ছিল। আমি শঙ্কায় পড়ে গেলাম। ভাবতে শুরু করলাম, হয়তো কোন সূক্ষ্ম ফ্র্যাকচার হয়ে থাকতে পারে। আর তা হওয়া মানেই তো পায়ে প্লাস্টার বাঁধা, আর ভাগ্য ভালো হলে যদি ফ্র্যাকচার নাও হয়, অন্ততঃ শক্ত ক্রেপ ব্যান্ডেজ তো বেঁধে রাখতেই হবে। তার মানে বেশ কিছুদিনের জন্য বেড-রেস্টে থাকতে হবে, কোন হাঁটাহাটি বা পায়ে ভর করে অন্য কোন কাজ করা চলবে না। আর এখন তো বেশ বুঝি, ‘হাঁটাহাটি নয়’ মানে রক্তে সুগার বেড়ে যাওয়া, কোলেস্টরেলও বেড়ে যাওয়া।
দুশ্চিন্তা নিয়েই রাতটা কাটলো। পরেরদিন সকালে আমি তাকে নিয়ে রওনা দিলাম নিকটস্থ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। গাড়ি থেকে নেমেই আমি একটা হুইলচেয়ার জোগাড় করলাম। ডাক্তার তাকে দেখে একটা এক্স-রে করাতে বলেন এবং কিছু বেদনানাশক ঔষধ প্রেসক্রাইব করলেন। সেই সাথে দু’সপ্তাহ ধরে দশ মিনিট করে ইলেক্ট্রোথেরাপি নেয়ার পরামর্শ দিলেন। তার এই পরামর্শের কথাটা শুনে আমার নিজের কাঁধ ব্যথাটার কথাও স্মরণে এলো। আমি সেই সুযোগে আমার কাঁধ ব্যথার কথাটা তাকে জানালে উনি শুনেই বললেন, এটা ‘ফ্রোজেন শোল্ডার’। আমাকে দু’হাত একসাথে উঁচু করতে বললেন। ডান হাতের তুলনায় বাঁ হাতের ধীর গতিতে উঠা লক্ষ্য করে উনি আমাকেও ইলেক্ট্রোথেরাপি নেয়ার একই পরামর্শ দিলেন। উনি জানালেন, থেরাপিস্ট আমাদের উভয়কে কিছু এক্সারসাইজ শিখিয়ে দেবে, সেগুলো নিষ্ঠার সাথে প্রতিদিন অনুশীলন করে যেতে হবে।
কর্তব্যরত তরুণ মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্টকে ডাক্তারের কাগজ দেখালাম। সে আমাকে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে বসতে বললো। আমি বসার পর সে একটা সাদা তোয়ালে দিয়ে আমার ডান কাঁধটা ঢেকে দিয়ে একটা মেশিন টেনে এনে সেখানে ফিট করতে যাচ্ছিল। আমি তাকে বললাম, আমার ব্যথা তো বাঁ কাঁধে, তুমি ডান কাঁধে মেশিন বসাচ্ছো কেন? সে দ্রুত ত্রুটিস্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করলো এবং বললো, “স্যরি স্যার, আপনি প্লীজ আবার একটু দাঁড়ান”। আমি দাঁড়ালে সে চেয়ারটাতে বসার দিক পরিবর্তন করে দিয়ে পুনরায় বসতে বললো। আমি বসার পর সে একটা নির্দিষ্ট উত্তাপে মেশিন সেট করে বললো, “আমি পর্দার পাশেই থাকবো। যদি মনে করেন তাপ বেশি বা কম হচ্ছে, আমাকে ডাকবেন, আমি এসে এ্যাডজাস্ট করে দিব”। এই বলে সে কাপড়ের পর্দাটা টেনে পাশের রোগীর কাছে গেল। তাপ সঞ্চালন শুরু হবার পর বেশ আরাম পাচ্ছিলাম। কিন্তু খানিক পরেই তাপমাত্রাটাকে অসহনীয় মনে হওয়াতে তাকে ডাকলাম। সে এসে তাপমাত্রা এ্যাডজাস্ট করে দিয়ে আবার পর্দার বাইরে চলে গেল। বাইরে থেকেই সে কয়েকবার জিজ্ঞেস করলো, তাপ সঠিক (আরামদায়ক) মাত্রায় পাচ্ছি কিনা। একটা নির্দিষ্ট সময় পর মেশিনে এলার্ম বেজে উঠলে সে এসে আমার কাঁধ থেকে তোয়ালে এবং মেশিন, দুটোই সরিয়ে নিয়ে জানালো, থেরাপি শেষ হয়েছে। এখন এক্সারসাইজের জন্য অন্য একটি কক্ষে যেতে হবে।
বহুদিন আগে একবার সংবাদপত্রে পড়েছিলাম, ঢাকার বাইরের কোন একটি জেলার মেডিক্যাল কলেজে সার্জন মহোদয় কোন এক রোগীর ডান দিকের পা এর বদলে বাঁ দিকের ভালো পা টি কেটে ফেলেছিলেন। খবরটিকে তখন আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি, কারণ এত বড় একটা ভুল হওয়াটা সহজ কথা নয়। সার্জন ছাড়াও তো স্তরে স্তরে অনেকেরই রোগীকে পরীক্ষা করে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করার কথা। আবার সম্প্রতি একটা খবরে দেখলাম, একজন রোগীর বাম কানে সমস্যা থাকলেও ইম্পালস হাসপাতালের জনৈক চিকিৎসক তার ডান কানে অপারেশন করেছেন, রোগীর স্বামীর কাছ থেকে এমন অভিযোগ পেয়ে চিকিৎসকের নিবন্ধন এক বছরের জন্য স্থগিত করেছে BMDC। এ সময়টাতে তিনি নিজেকে চিকিৎসক হিসেবে পরিচয় দিতে পারবেন না। আমার ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রো-থেরাপিস্ট যে ভুলটা করতে যাচ্ছিল, সেটা ঐ দুটো ঘটনার তুলনায় কিছুই নয়। তবুও, ভুল তো ভুলই। কর্তব্যে সাবধান ও মনযোগী না হলে এরকম ছোট ছোট ভুল থেকেই অনেক সময় বড় ভুলও হয়ে যেতে পারে। তবে ছেলেটির ত্রুটিস্বীকার, দুঃখ প্রকাশ এবং সু-আচরণ দেখে আমার মনে হলো, নেহায়েৎ ভুলক্রমেই এ ভুলটা হতে যাচ্ছিল। তবুও নিজের ভুলের জন্য তাকে অনুতপ্ত মনে হওয়াতে আমিও এ ভুলটার কথা ভুলে যেতে মনস্থ করলাম।
ঢাকা
১১ ডিসেম্বর ২০২২
শব্দসংখ্যাঃ ৭০৭
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ৮:৩৭