কমলার সেই বিচি!
আমার একমাত্র নাতিটা ওর মা সহ কয়েকদিন বেড়িয়ে গেল আমাদের বাসায়। এ কয়দিন নীরব বাসাটা বেশ সরগরম ছিল। শুনেছি তিন বছরের আরহাম নাকি দিনে ঘুমাতে চায় না। কিন্তু শিশুদেরকে ঘুম পাড়ানোর কিছু টেকনিক আমার জানা আছে। খালি কোনরকমে ভুলিয়ে ভালিয়ে একবার বিছানায় তুলতে পারলেই হলো। যতই আপত্তি জানিয়ে হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করুক না কেন, একসময় ঠিকই নিদ্রা দেবীর কোলে ঢ়লে পড়ে। ওর বড় বোন আনায়াকেও আমি এভাবেই বহুদিন ঘুম পাড়িয়েছিলাম। অবশ্য গতকাল সে খুব দ্রুতই ঘুমিয়েছিল, কারণ ওকে দুপুর বেলায় আমাদের এলাকার শিশুপার্কে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে সে খুবই ছোটাছুটি করে বেশ ক্লান্ত হয়েছিল। একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম যে সে খুব তাড়াতাড়ি অন্যান্য শিশুদের সাথে বন্ধু্ত্ব পাতাতে পারে এবং আলাপ জুড়ে দিতে পারে। শিশুদের মধ্যে মনে হয় কমন একটা lingua franca রয়েছে, যার ফলে পৃথক মাতৃভাষার কারণে ওদের একে অপরের সাথে কমিউনিকেট করতে অসুবিধে হয় না। নিমেষেই সে উপস্থিত কয়েকজন ভিন্নভাষী শিশুর সাথে খেলা জুড়ে দেয় এবং ওদের সাথে সাথে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। ওর এই দৌড়াদৌড়িজনিত ক্লান্তির দুটো ইতিবাচক ফল আমরা পেয়েছিঃ এক, ওকে দুপুরে খাওয়াতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। দুই, খাওয়ার পর ঘুম পাড়াতেও বেশি বেগ পেতে হয়নি।
ওকে বিছানায় নিয়ে শোয়ার পর পরই ও খেলনা (একটা বাস, একটা জিপ আর একটা কার) নিয়ে সক্রিয় থাকলেও ওর দিদি ঘুমে চোখ বুঁজেছিল। সেটা লক্ষ্য করে সে দিদির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে উঠলো, Didi, wake up! এর আগের দিনও সে একই কাজ করছিল। কিন্তু সেদিন তার দিদি কেবল ঘুমের ভান করছিল। তাই সে ওয়েক আপ বলার সাথে সাথে দিদি চোখ খুলতো, আর তা দেখে সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তো। গতকাল যেহেতু তার দিদি সত্য সত্যই ঘুমিয়ে পড়েছিল, সেহেতু তার চোখ মেলতে একটু দেরি হয় এবং তাকে তার কমাণ্ডটা কয়েকবার রিপীট করতে হয়। কষ্টের সাথে তার দিদি যখন চোখ মেলে, তখন সে আবার হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। আমাদের উভয়কে চুপ করে থাকতে দেখে সে একসময় একদৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে থেকে (জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে পাখির ওড়াউড়ি দেখা যায়) আস্তে করে ঘুমিয়ে পড়ে। হাতে ধরে থাকা গাড়িগুলো একসময় হাত থেকে পড়ে যায়। আমি জানি ও ঘুম শেষে চোখ মেলেই গাড়িগুলো খুঁজবে। তাই আমি সেগুলো তুলে নিয়ে সযত্নে ওর বালিশের পাশে রেখে দেই।
সন্ধ্যার পর ওর দিদি কমলালেবুর খোসা ছাড়িয়ে কোষগুলোকে আলাদা করে একটা প্লেটে তুলে দিয়ে ওকে বললো, যাও দাদার সাথে বসে খাও। আমি জানি, কমলা ওর খুব পছন্দের একটা ফল। প্লেটটা পেয়ে সে খুশি হলো এবং প্লেট হাতে নিয়ে এ ঘরে ও ঘরে হেঁটে বেড়িয়ে খেতে থাকলো। ওর মা অফিস থেকে আসার পর মাকে দেখে কিছুক্ষণ সে মায়ের পিছে পিছে ঘুরে বেড়ালো। রাতে খেয়ে দেয়ে ওরা দুজনেই ওদের বাসায় চলে গেল। আমাদের ঘরটা আবার নীরব হয়ে গেল!
সকালে ফজর নামাযের পর হাঁটুর নীচে শক্ত কিছু একটা অনুভব করলাম। জায়নামায উল্টিয়ে দেখি, একটা কমলালেবুর বিচি! বুঝতে বাকি রইলো না, বিচিটা কোথা থেকে এসেছে। মনটা হু হু করে উঠলো। চোখের পর্দায় ভাসতে থাকলো গতকাল পার্কে ওর ছোটাছুটির দৃশ্যাবলী। ওকে সামলানোর আমার প্রাণান্ত চেষ্টা। গোসল ও খাবারের সময় পার হয়ে যাচ্ছিল বলে কিছুটা ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ঘরে ফিরিয়ে আনা। মন খারাপ করে ওর চেয়ারের পেছনে লুকিয়ে থাকা। সযত্নে রক্ষিত ওর গাড়িগুলোকে ওর কাছে হস্তান্তর করা, ওর মোজা খাঁজে দেয়া। যাবার সময় ওর স্বভাবসুলভ দুষ্টুমিতে লিফটের বাটন টেপাটিপি করা, উচ্ছ্বাসে হাত নেড়ে বাই বাই বলা, ইত্যাদি। কি যে গভীর মায়ায় আবদ্ধ করে ও চলে গেল! সব মায়া, সব দৃশ্য, সব স্মৃতি যেন ঘনিভূত হয়ে ঠাঁই নিল একটিমাত্র কমলালেবুর বিচির ভেতর! বিচিটাকে আঙুলে ধরে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম আর বাসার আনাচে কানাচে, আসবাবে শয্যায়, বাসায় রেখে যাওয়া পরিধেয় বস্ত্রে লেগে থাকা ওর স্পর্শ অনুভব করতে লাগলাম। আপাতঃ দৃষ্টিতে খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার, কিন্তু এটাই আমাকে আজ সকাল থেকে অনেকক্ষণ বাক-বিহ্বল করে রাখলো। এসব বেদনা অনির্বচনীয়। যুক্তি দিয়ে কাউকে বোঝানো যাবে না। তাই এ স্মৃতিটা আজকের দিনলিপি হিসেবেই এখানে রক্ষিত থাকুক!
ঢাকা
২৪ জানুয়ারী ২০২৩
শব্দসংখ্যাঃ ৫৯৫
খুশির হাসি
লাঞ্চের সময় পার হয়ে যাচ্ছিল বলে অনেকটা জোর করেই তাকে ঘরে ফিরিয়ে আনা হচ্ছিল। তাই মন খারাপের হাসি
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:০০