আজ মধ্যরাতের 'কিয়ামুলল্লাইল' নামাযই ছিল সম্ভবতঃ এ রমজানের শেষ জামাতবদ্ধ 'কিয়ামুলল্লাইল'। ইমাম সাহেবের চমৎকার ক্বিরাত-তিলাওয়াৎ শুনতে শুনতে মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠেছিল। আট রাকাত নামায পড়াতে ইমাম সাহেব সাধারণতঃ সময় নেন ত্রিশ মিনিট, মুনাজাতে বার থেকে পনের মিনিট, সর্বমোট প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটে 'কিয়ামুলল্লাইল' নামায সমাপ্ত করেন। উনি পবিত্র ক্বুর'আনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহতা'লা মানুষকে যেসব প্রার্থনা শিখিয়ে দিয়েছেন, বেছে বেছে সাধারণতঃ সেসব আয়াত তিলাওয়াৎ করেই নামায পড়িয়েছেন। সেসব আয়াতের অনেকাংশ অর্থসহ আমার জানা আছে। তাই নামাযের মধ্যে প্রায়শঃই শাস্তির ভয়ে শিউরে উঠেছি, সৎ কর্মের পুরস্কারের কথা ভেবে আশান্বিত হয়ে আন্দোলিত হয়েছি, আবার একজন আত্মসমর্পনকারী হিসেবে পরম নির্ভরতায় প্রশান্ত হয়েছি। ইমাম সাহেবের কণ্ঠে শোনা প্রার্থনা ছাড়াও, এই পঁয়তাল্লিশ মিনিট জুড়ে আমার মন নিরন্তর নীরবে আওড়ে চলে আমার নিজস্ব কিছু নিবেদন, যার কোন বাঁধাধরা গতিপথ নেই। যখন শুনি, "প্রত্যেক প্রাণই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে", তখন আমি নিজেকে মৃত্যুশয্যায় দেখতে পাই, যেভাবে অনেক আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে পেটে-বুকে-নাকে নল গোঁজা অবস্থায় হাসপাতালে দেখেছি। নিজেকে ক্ববরে শায়িত দেখতে পাই, যেভাবে শায়িত রেখে এসেছি তাদের অনেককে। আবার যখন শুনি, ‘বরকতময় তিনি, তাঁর হাতে রাজ্যক্ষমতা আর তিনি সব বিষয়ে শক্তিমান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন; যাতে পরীক্ষা করবেন তোমাদের কাদের কাজ ভালো। আর তিনি পরাক্রমশীল ও ক্ষমাশীল’ (সুরা-৬৭ মুলক, আয়াত: ১-২), তখন নিজেকে মুনকার-নাকির এর প্রশ্নের উত্তর দেয়া অবস্থায় দেখতে পাই ঠিক তেমনিভাবে, যেমনটি কর্মজীবনে দেখেছি ছাত্ররা আমার প্রশ্ন শুনে জানা প্রশ্নের উত্তর ভুলে গিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছে। আমার প্রার্থনা তখন হয় এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে নিস্তার লাভ, এবং প্রার্থনাটি নিবেদন করি তাঁর কাছে, যিনি সকল শান্তির আধার ও অধিকারী, আর যার নামেই প্রবাহিত হয় অনন্ত শান্তির নিরন্তর ফল্গুধারা।
আমি প্রভুকে অন্তরে অনুভব করতে ভালোবাসি। কারণ, তিনি আমার স্রষ্টা, তাই নিশ্চয়ই তিনি আমাকে বিপদগ্রস্ত দেখতে চাইবেন না, দেখলেও আমাকে উদ্ধারে অবশ্যই এগিয়ে আসবেন। আর এই অনুভব লাভের জন্য মধ্য রজনীর প্রার্থনাই সবচেয়ে মোক্ষম সময়। এ সময়ে অন্তর সহজে বিগলিত হয়, প্রার্থনা অন্তর থেকে উঠে এসে কণ্ঠে ও জিহ্বায় কেন্দ্রীভূত হয়। তখন ভাবা সহজ হয় যে আমার ভ্রান্তি সসীম, তাঁর ক্ষমতা ও ক্ষমা পরিধিহীন, অসীম। তিনি আমার অভিভাবক, তিনি আমার প্রতিপালক, তিনিই আমার রব্ব। তিনি আমার হায়াত দানকারী, হায়াত দারা'জকারী, রুজি-রোযগার-রিযিক-ইজ্জত এ বরকতদানকারী, রোগ-ব্যাধিতে শিফা দানকারী, জান-মাল-ইজ্জতের হেফাযতকারী, বিপদে নাজাত দানকারী, অন্তরের ব্যক্ত-অব্যক্ত নেক ইচ্ছা পূরণকারী, শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি ও পেরেশানি অবসানকারী, সকল গতির সূচনা, নিয়ন্ত্রণ ও নিশ্চলকারী, সর্বশ্রেষ্ঠ সুরক্ষাকারী এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সকল বিষয়ে অবগত সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রোতা, দ্রষ্টা ও ত্রাতা। এমন একজন সর্বশক্তিমান ক্ষমতাধর নিত্য বিদ্যমান সত্তার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে আমি চিরনিদ্রায় শায়িত হতে চাই, পুনরায় তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে জাগ্রত ও পুনরুল্থিত হবার অপেক্ষায়। মনে বড় আশা, তাঁর প্রেরিত কোন প্রতিনিধি এসে যেন আমায় ডাক দিয়ে যায়, "হে প্রশান্ত আত্মা! তোমার রব-এর দিকে ফিরে এসো সন্তুষ্ট হয়ে এবং (তোমার রব-এর) সন্তুষ্টির পাত্র হয়ে। অতঃপর আমার (নেক) বান্দাদের মধ্যে শামিল হও। আর আমার জান্নাতে প্রবেশ কর"। (সুরাহ ফাজর, আয়াত ২৭-৩০)
ঢাকা
২১ এপ্রিল ২০২৩
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০২৩ সকাল ৮:১৪