
বাসার সামনে ত্রিকোণাকৃতির পুষ্পশয্যার প্রতিটি হাস্যোজ্জ্বল ফুল যেন মাথা উঁচিয়ে বলছে "বিদায়, বিদায়, শুভবিদায়"!
২৭ জুলাই ২০২৩, দুপুর ১৩-৪৫
আজ থেকে আমার ঘরে ফেরার কাউন্টডাউন শুরু হলো। আর মাত্র পনেরটা দিন, তার পরেই শুরু হবে পরিব্রাজক পাখির পূবমুখী আকাশযাত্রা। আপন নীড়ে ফিরতে তো আনন্দ হবার কথা, তবু কেন হৃদয়ে বেদনার সুর বাজে? যেদিকে তাকাই, শুধু তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে। জানালার ভেতর দিয়ে দৃষ্টিটা একটু বাইরে প্রসারিত হলেই দেখি প্রতিদিনের দেখা সেই গাছ, সেই চিরচেনা ল্যাম্প-পোস্ট, সেই নীল-সাদা আকাশ, পার্কিং লটের গাড়িগুলো দেখতে দেখতে প্রায় সবগুলোই চেনা হয়ে গেছে, অনেকগুলোর মালিককেও ইতোমধ্যে চিনে ফেলেছি। ঘর থেকে বের হলেই মনে হয়, লন-মোয়ার দিয়ে মাথা মুড়িয়ে দেয়া সবুজ লনের প্রতিটি তৃণ ফলা, প্রতিটি বৃক্ষপত্র, ত্রিকোণাকৃতির পুষ্পশয্যার প্রতিটি হাস্যোজ্জ্বল ফুল যেন মাথা উঁচিয়ে বলছে "বিদায়, বিদায়, শুভবিদায়"!
ভাবছি, আজ থেকে প্রতিদিন একটু একটু করে ব্যাগেজ গুছিয়ে রাখবো। আমার ব্যাগেজ আমি নিজ হাতেই গুছিয়ে রাখি। যাত্রার তিনদিন আগে ব্যাগেজ লক করে রাখবো, কেননা শেষ মুহূর্তের টেনশন আমার ভালো লাগে না। দীর্ঘ আকাশযাত্রা; প্রায় বিশ ঘণ্টা আকাশে, আরও দশ-বারো ঘণ্টা টার্মিনালের লাউঞ্জে- সব মিলিয়ে প্রায় ত্রিশ ঘণ্টারও ঊর্ধ্বের যাত্রাপথ, এ বয়সে যা খুব একটা উপভোগ্য বা সুখকর হয় না। তার উপর মন খারাপ থাকলে তো ক্লান্তিটা একটু বেশি করেই জেঁকে বসে। ব্যাগেজ নিজ স্পর্শে ঠিকমত গোছানো না থাকলে মন খুঁত খুঁত করে। এখানে আসার সময় যেসব কাপড় চোপড় নিয়ে এসেছিলাম, তার কয়েকটা এখনও পরাই হয় নাই, যাবার আগে আর হবেও না। সেগুলোকে আগে ঢুকিয়ে রাখবো। যেগুলো কয়েকদিন পরা হয়ে গেছে, সেগুলোর কয়েকটা ধুয়ে রেখেছি, বাকিগুলোও কয়েকদিনের মধ্যেই ধুয়ে ফেলবো। আমার পরিধেয় বস্ত্র আমি ওয়াশিং মেশিনে ধুই না, নিজ হাতে ধুই। তাই একসাথে দুই তিনটার বেশি ধোওয়া হয় না।
এখান থেকে চলে যাবার পর যেটা সবচেয়ে বেশি করে মিস করবো তা হলো আনায়ার স্কুলে যাওয়া আসার পথটা। সে পথ দিয়ে স্কুলে যাওয়া আসার সময় আনায়া যেখানে যেখানে থেমে থেমে ফুল, গাছের পাতা ইত্যাদি ধরতো, সেগুলোর প্রতিটি আমার চেনা। একটা বাসার সামনে হয়তো ওরই মত কোন শিশু আমাদের দেশীয় 'এক্কা-দোক্কা' খেলার মত একটা কোর্ট এঁকে রেখেছিল; আনায়া সেই জায়গাটা অতিক্রম করার সময় এক্কা-দোক্কা খেলার স্টাইলেই ঘরগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে পার হতো। ও লাফানোর সময় মাথার পেছনে ওর দিদি'র বেঁধে দেয়া পনিটেইলটাও লাফাতো। রাস্তার মোড়ের সেই বাসাটা, যেটার ব্যাকইয়ার্ডের কিচেন গার্ডেনে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এক ভিয়েতনামি দম্পতি হ্যাট মাথায় কাজ করে সব্জী বাগান করেছে এবং ভুট্টা ফলিয়েছে, সেটার কথা মনে পড়বে। রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থেকে কয়েকদিন ওদের সাথে আলাপও করেছি। ভদ্রলোক খুবই অমায়িক এবং পরিশ্রমী। তার স্ত্রী ইংরেজী জানেননা বলে তার সাথে হ্যালো-হাই ছাড়া আলাপ তেমন জমেনি। ওদের বাগানের লালশাকগুলো আমার চোখের সামনে তরতর করে বেড়ে উঠেছে। যে পথ দিয়ে সচরাচর পদব্রজে এবং গাড়িতে করে চলাফেরা করেছি, সে পথগুলোর আশেপাশের সাইনবোর্ড, সিগনালপোস্ট, ইত্যাদির কথা মনে পড়বে। এ কয়মাসে যাদের যাদের সাথে মিশেছি, দূর দূরান্তে গিয়েছি, তাদের সাথে, তাদের সন্তানদের সাথে একটা ইনফর্মাল সখ্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম। তাদের কথাও বেশ মনে পড়বে।
ডাইনিং টেবিলের যে কোণায় বসে ল্যাপটপ মেলে ধরে এতদিন লেখালেখি করেছি (এখনও করছি), সেটাকে মিস করবো। ঘরের প্রতিটি আসবাবপত্র যেন আমার সাথে কথা বলছে। বাসার সামনেই একটা বাস স্টপেজ রয়েছে, যেটা একটা রুটের স্টার্টিং ও ফিনিশিং পয়েন্ট। ক্ষণে ক্ষণে সেখানে বাস এসে থামে, পিঁপড়ের মত ব্যস্ত মানুষেরা একে একে সেখানে প্রবেশ করে কর্মস্থলে যায়, অথবা কর্মযজ্ঞ সম্পাদন শেষে ফিরে আসে। আমি একদিন অনেকক্ষণ সেখানে বসে রোদ পোহাচ্ছিলাম আর ব্যস্ত মানুষের আসা যাওয়া দেখছিলাম। প্রত্যেকেই যেন একেকটা চাবি দেয়া রোবট! সেখানে একটা সিনেপ্লেক্স, বেশ কয়েকটা বড় বড় সুপার মার্কেট, ফুড কোর্ট এবং একটি গণপাঠাগার রয়েছে। এখানকার পাঠাগারগুলো এত পাঠক-বান্ধব হয়! পাঠকের যে কোন চাহিদা চাহিবামাত্র পূরণ করা হয়। বলাবাহুল্য, বাসার কাছের এই পাঠাগারটি আমার একটি অন্যতম প্রিয় জায়গা ছিল। এখানে বসে আমি কানাডার আদিবাসীদের প্রতি যে অত্যাচার নির্যাতন হয়েছে, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের প্রতি, সে সম্পর্কিত কিছু বই পড়েছি। এসব বই পড়ে সে সময়ের অকুতোভয় আদিবাসী নারীদের সংসার পালন ও লালনে আত্মত্যাগ, সাহস ও সহিষ্ণুতার পরিচয় পেয়ে তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও সমীহ অনেক বেড়ে গেছে।
এখানে চলার পথের বিভিন্ন দৃশ্য আমার সেলফোন ক্যামেরায় বন্দী করে রেখেছি। এ ছাড়া ম্যানিটোবা, এ্যালবার্টা এবং ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রভিন্সের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেড়ানোর সময় অসংখ্য নৈসর্গিক দৃশ্যের ছবি তুলে রেখেছি। এসব ছবি ভবিষ্যতে স্মৃতিচারণে সহায়ক হবে। ক্যামেরার ছবি ছাড়াও, আমাদের সঙ্গী হয়ে যারা এসব স্থানে গিয়েছিলেন, তাদের এবং তাদের সন্তানদের (যারা আমাদের নাতি-নাতনির সমান) বহু স্মৃতি আমার মনে সুখ-স্মৃতি হিসেবে রয়ে যাবে। সবার সাথেই একটা অদৃশ্য মায়ার বাঁধন গড়ে উঠেছিল। আমাদের যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে বলে গতকাল সন্ধ্যায় আমাদের নিকট প্রতিবেশী এক বয়স্ক দম্পতি (স্বদেশীয়) তাদের সন্তান ও নাতনিসহ আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। ওনারা আমাদের তিন সপ্তাহ পরে তাদের ছেলের বাসায় বেড়াতে এসেছেন, এবং দেশে ফিরে যাবেন আমাদের আড়াই সপ্তাহ পরে। এখানকার বাঙালি কমিউনিটি কর্তৃক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে/দাওয়াতে ওনাদের সাথে পরিচিত হয়েছি। যেখানেই দেখা হয়েছে, ভদ্রলোক অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আলাপ করেছেন। একদিন একসাথে জুম্মার নামাযও পড়তে গিয়েছিলাম। এইটুকু পরিচয়েই অনুভব করতে পারি, তিনি আমাদেরকে অনেক মায়ার চোখে দেখেন, এবং সে কারণেই উনি নিজ থেকে পরিবার নিয়ে আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। দেশের দুই প্রান্তের কৌণিক দূরত্বে (চট্টগ্রাম এবং লালমনিরহাট) আমাদের আদি পৈত্রিক নিবাস হওয়া সত্ত্বেও আমরা একে অপরের প্রতি মায়া অনুভব করি। দু'দিনের দুনিয়ায় এ বাঁধন হয়তো ক্ষণিকের তরে, কিন্তু মায়া তো মায়াই! এ মায়া নিয়ে এবং হয়তো কিছু মায়া রেখে চলে যাচ্ছি। জানিনা আবার কখনো এখানে আসা হবে কিনা, কিংবা হলেও, কখন!
"চলেছো পথিক আলোকযানে আঁধারপানে
মনভুলানো মোহনতানে গান গাহিয়া
হে ক্ষণিকের অতিথি!"
https://www.youtube.com/watch?v=GgkzywDPt2M
রিজাইনা, কানাডা
২৭ জুলাই ২০২৩
শব্দ সংখ্যাঃ ৮৩৮

পার্কিং লটের গাড়িগুলো
২৭ জুলাই ২০২৩, দুপুর ১৩-৩৬

সিনেপ্লেক্সের সামনেই একটা বাস স্টপেজ রয়েছে, যেটা একটা রুটের স্টার্টিং ও ফিনিশিং পয়েন্ট। ক্ষণে ক্ষণে সেখানে বাস এসে থামে, পিঁপড়ের মত ব্যস্ত মানুষেরা একে একে সেখানে প্রবেশ করে কর্মস্থলে যায়, অথবা কর্মযজ্ঞ সম্পাদন শেষে ফিরে আসে।
২৭ জুলাই ২০২৩, দুপুর ১৩-৩৪

২৭ জুলাই ২০২৩, দুপুর ১৩-৩৩

প্রতিটি বৃক্ষপত্র যেন বলছে "বিদায়, বিদায়, শুভবিদায়"!
২৭ জুলাই ২০২৩, দুপুর ১৩-৩৩

পার্কিং লটের গাড়িগুলো দেখতে দেখতে প্রায় সবগুলোই চেনা হয়ে গেছে, অনেকগুলোর মালিককেও ইতোমধ্যে চিনে ফেলেছি।
২৭ জুলাই ২০২৩, দুপুর ১৩-৩০

ভিয়েতনামি দম্পতি হ্যাট মাথায় কাজ করে সব্জী বাগান করেছে এবং ভুট্টা ফলিয়েছে,
২৭ জুলাই ২০২৩, দুপুর ১৩-৩৮

ভিয়েতনামি দম্পতি হ্যাট মাথায় কাজ করে সব্জী বাগান করেছে
২৭ জুলাই ২০২৩, দুপুর ১৩-৩৯

ভিয়েতনামি দম্পতির সব্জী বাগান
২৭ জুলাই ২০২৩, দুপুর ১৩-৩৯

২৭ জুলাই ২০২৩, দুপুর ১৩-৪৩

জানালার ভেতর দিয়ে দৃষ্টিটা একটু বাইরে প্রসারিত হলেই দেখি প্রতিদিনের দেখা সেই গাছ
২৪ জুলাই ২০২৩, ভোর ০৪-৩৭

সেই ভিয়েতনামির সব্জী বাগানের পাশে আনায়ার সাইকেল
১৪ জুন ২০২৩, সকাল ০৯-২৮
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:৫৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




