কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনলে ভালো শোনা যায় বলে জানি। তবুও আমি হেডফোন ব্যবহার করি না, শ্রবণশক্তি নষ্ট হবার ভয়ে। আগে আমার শ্রবণশক্তি খুবই প্রখর ছিল; কিন্তু ২০২১ সালে কভিডে আক্রান্ত হবার পরে সেটার অবনতি ঘটেছে বলে নিজেই টের পাই। আর আমি সাধারণতঃ সেলফোনে গান শুনি না। কিন্তু যখনই ল্যাপটপ খুলি, এক নাগাড়ে ইউটিউবে গান বাজতে থাকে। অন্য কিছুতে মনোনিবেশ করতে গান কখনও আমাকে বাধ সাধে না, বরং সহায়ক হয়। যাহোক, ঘরে তো আর শুধু আমি একা থাকি না, আরও অনেকেই থাকে। অনেক সময় আমার বাজানো গান তাদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই ছেলেকে এবারে বললাম একটা ভালো হেডফোন সেট কিনে আনতে। আশা করছি, দেশে ফিরে গিয়ে ওটার সদ্ব্যবহার করবো, যেন গান শোনা নিয়ে কারও বিরক্তির কারণ না হই।
আমার শৈশবে গান শোনার একমাত্র উপকরণ ছিল একটা তিন ব্যান্ডের রেডিও। বাসার বড়দের পছন্দ ছিল রেডিওর নাটক; আমার ও আমার বড় বোনের ছিল অনুরোধের আসর। দুটো সাংঘর্ষিক হলে আমরা দু'জনাই অন্য পথ খুঁজতাম, বড়দের কথাই ধোপে টিকতো। আরেকটু বড় হয়ে টু-ইন-ওয়ান এবং ফিতের ক্যাসেটে গান শোনা শুরু করি। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বরে দেশে টেলিভিশন চালু হলেও আমাদের বাসায় টেলিভিশন প্রথম আসে ১৯৬৮-৬৯ সালে। তখন 'ত্রিরত্ন' নামে একটি হাসির নাটকের সিরিজ দেশে তুমুল আলোড়ন তুলেছিল।
আমরা তখন থাকতাম শেরে বাংলা নগরে একটি দোতলা বাসায়। বাসাটির দোতলায় সামনে ও পেছনে ব্যালকনি ছিল। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর কিছুক্ষণ সামনের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াতাম। দূর থেকে মাইকে ভেসে আসতো তখনকার দিনের কিছু জনপ্রিয় গানের সুর। বিশেষ করে শীতকালে যখন বিয়ের মওশুম, তখন অনেক রাত পর্যন্ত গান শোনা যেত। সে সময়ে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল বর্তমান সময়ের এক পঞ্চমাংশ, বাড়িঘরের সংখ্যাও ছিল একই অনুপাতে। তাই রাতের বেলা অনেক দূর দূরান্ত থেকেও মাইকে বাজানো গান শোনা যেত দীর্ঘ সময় ধরে তখন আবালবৃদ্ধ্বনিতার অসম্ভব জনপ্রিয় গান ছিল "হাওয়া মে উড়তা যায়ে" (পরবর্তীতে বাকের ভাই এর সেই বিখ্যাত গান), রূপবান ও রহিম বাদশা ছায়াছবির গান "দাইমা গো" এবং সাত ভাই চম্পা ছায়াছবির বৃন্দসঙ্গীত "শোনেন শোনেন জাঁহাপনা শোনেন রাণী ছয়জনা"। স্মৃতি হাতড়ে মনে করতে পারছি, নিম্নোক্ত গানের সুরগুলোও তখন মাইকে ভেসে এসে আমার মনটাকেও তাদের সাথে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। একেকটা গানের সাথে একেক রকমের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এখনও এসব গান শুনলে সেসব স্মৃতির কথা মনে হয়ঃ
প্রেম একবার এসেছিল নীরবে
একটা গান লিখো ও আমার জন্য
ভুল সবই ভুল
সাত ভাই চম্পা জাগোরে জাগো
আষাঢ় শ্রাবন মানে না তো মন
মন যদি ভেঙে যায়, যাও কিছু বলবো না
অনেক সাধের ময়না আমার
অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান যেন ভুলে যেও না
গল্প যদি শুনতে চাও, তবে চুপটি করে বসো
সোনার ময়না পাখি
মাঝি বাইয়া যাও রে
আজি ভাহাহাল করিয়া বাজান রে দোতরা
পদ্মার ঢেউ রে
ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে
তু যাঁহা কাভি ভি যায়ে
একেলে না যানা
কো কো করোনা
যাব কয়ি পেয়ারসে বুলায়ে গা
কিয়া হ্যায় যো পিয়ার তো পাড়েগা নিভানা
হ্যায় আপনা দিল
রঙ্গিলা রে......
এসব গান ছাড়াও, শীতের মাসগুলোতে মাঝে মাঝে দূরের কোন ওয়াজ মাহফিল থেকে হামদ ও নাতের সুরও ভেসে আসতো। বিশেষ করে ইয়া নবী সালাম আলাইকা, এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি, ইত্যাদি। সেগুলোও ভালো লাগতো।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সাধারণতঃ পেছনের ব্যালকনিতে কিছুক্ষণ দাঁড়াতাম। সে সময়ে দুপুর আড়াইটার দিকে তেজগাঁ বিমান বন্দর থেকে একটা প্লেন বিকট শব্দ করে আকাশে উড়তো, যেত সম্ভবতঃ লাহোর কিংবা করাচী। আমাদের বাসার পেছনের ব্যালকনি থেকে বিমান বন্দরের রানওয়ে দেখা যেত, তাই সেখানে দাঁড়িয়ে আমি অনেক সময় প্লেনের ওঠানামা দেখতাম। একবার আমাদের এক প্রতিবেশী পরিবার ঐ প্লেন ধরে কোথায় যেন গিয়েছিলেন। তাই ঐ প্লেনটার ওড়া দেখলেই ওদের কথা মনে পড়তো।
মানুষের কথা, কান্না, গান ইত্যাদি নাকি অনন্তকাল ধরে ইথারে ভেসে বেড়ায়। মানুষের স্মৃতির ইতি কি তার মৃত্যুর সাথে সাথেই কিংবা তারও আগে ঘটে থাকে, নাকি সেগুলোও অনন্তকাল ধরে কোথাও ভেসে বেড়ায়; তার আত্মাকে পুনরায় জাগ্রত করা হলে সেগুলো আবার ফিরে এসে তার মনে ঠাঁই নেবে? কে জানে!
রিজাইনা, কানাডা
০৮ অগাস্ট ২০২৩
শব্দ সংখ্যাঃ ৬১১
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ১১:৩০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





