জাকিউল ইসলাম ফারূকী (Zakiul Faruque) ওরফে সাকী আমার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু; ডাঃ আনিসুর রহমান, এনডক্রিনোলজিস্ট আর ডাঃ শরীফ হাসান, প্লাস্টিক সার্জন এর। ওরা তিনজনই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের একই ব্যাচের ছাত্র (K-32) ছিল। সেই সূত্রে আমি তাকে নামে চিনতাম। তাছাড়া চেনার আরেকটা কারণও ছিল। আমরা একই এলাকার সন্তান। সাকীর বাবা লালমনিরহাট রেলওয়ে হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন। অবসরে প্রাইভেট কলেও আসতেন। শৈশবে আমার নানাবাড়িতে তাকে আসতে দেখেছি, তাদের চিকিৎসার জন্যে। এ ছাড়াও, আত্মীয়তার বন্ধনও ছিল তাদের সাথে।
তবে আমার শৈশব কেটেছে বাবার কর্মস্থল চট্টগ্রাম এবং ঢাকায়। সপ্তম শ্রেণীতে উঠে আমি ক্যাডেট কলেজের নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চলে যাই মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজে (এটা ছিল তখনকার নাম; ১৯৭৮ সাল থেকে ‘মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ’ নামে অভিহিত)। আর সাকী সপ্তম শ্রেণীতে উঠে লালমনিরহাট থেকে চলে যায় রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে। সেজন্য আমাদের কখনো চাক্ষুষ সাক্ষাৎ হয়ে ওঠে নি। তবে বছরে দু’বছরে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে যখন গ্রামের বাড়িতে যেতাম, তখন আমার প্রায় সমবয়সী কাজিনরা আমাকে ওর কথা বলতো।
আমি অবসর জীবনে যাবার পর শুনেছি, সাকীও আমার মত কবিতা লিখে। ডাঃ আনিস ওর কিছু কবিতার বই আমাকে দিয়েছিল পড়তে। পড়েছিলাম কবিতাগুলো, ভালোও লেগেছিল। ভালো লাগার অন্যতম একটি কারণ সরল বর্ণনার ভেতর দিয়ে জীবনের আবেগ, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কথা বলা, কিংবা অভিজ্ঞতার নিরিখে জীবনের কোন দর্শন তুলে ধরা। কালক্রমে একদিন আমরা ফেসবুক ফ্রেন্ডও হয়ে গেলাম। আমি গতমাসে নিউ ইয়র্ক এসেছিলাম, সেটা সে ফেসবুকের মাধ্যমে জেনেছিল। কয়েকদিন মেসেঞ্জারে কথোপকথনের পর সে জানতে পারলো যে আমরা শীঘ্রই কানাডায় আমাদের বড় ছেলের কাছে চলে যাচ্ছি। সে একদিন নিউ জার্সিতে তার বাসায় আসার নেমন্তন্ন জানালো। আমি সানন্দে রাজী হ’লাম এবং কানাডা চলে আসার দু’দিন আগে তার বাসায় উপস্থিত হ’লাম।
সাকী’র স্ত্রী ডাঃ সেলিনাও আমাদের তিন বন্ধুর মত DMC K-32 ব্যাচ এর সহপাঠী ছিল। আমার ছোটভাই একই এলাকার একজন ডাক্তার ছিল বিধায় তারা ওকেও চিনতো, তাই ওকেও সাথে নিয়ে আসতে বললো। আমরা তার বাসায় পৌঁছানোর ঠিক আগে আগে তাকে ফোন দিয়ে জানালাম যে আমরা কাছাকাছি এসে গেছি। একটু এগিয়েই দেখি, সে দুয়ার থেকে নেমে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালো। আমরা একে একে ভেতরে প্রবেশ করলাম। গৃহপ্রবেশের পর থেকে প্রাকসন্ধ্যায় বিদায় নেয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের আলাপ এক মুহূর্তের জন্যেও থামে নাই। বিশেষ করে ভাবী’র (ডাঃ সেলিনা এর) কথা না বললেই নয়। উনিও মেহমানদারির ফাঁকে ফাঁকে অনেক আলাপ করেছেন আমাদের সাথে। ওরা উভয়েই এতটা অমায়িক ও আন্তরিক ছিল যে মনেই হলো না তাদের সাথে সেদিনই প্রথম চাক্ষুষ সাক্ষাৎ হলো।
লাঞ্চের পরে আমি ওদের বুকশেলফের কাছে গেলাম। সেখানে একটি বই এর প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ আটকে গেল। লেখকের নাম দেখে মনে হলো আমি এই লেখককেও নামে চিনি; তিনি আমাদের এই ব্লগেরই একজন পুরনো ব্লগার। আমি সাকীকে জিজ্ঞেস করলাম, সে সেই লেখককে চিনে কি না। সে বললো চিনে মানে, লেখক তার ছোট বোন। লেখকের অন্যান্য লেখা পড়ে আমার ধারণা হয়েছিল যে তিনি উত্তরবঙ্গের মানুষ। কিন্তু সেই ক্ষণে জানলাম তার আরও নিকট পরিচয়। আমার আগ্রহ লক্ষ্য করে সাকী সেই বইটি এবং তার নিজেরও একটি কবিতার বই আমাকে গিফট করলো। আমার ছোটভাইকেও সে তার লেখা কয়েকটি বই গিফট করলো। বই এর কয়েকটি পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আমি নিশ্চিত হ’লাম, আমি এ লেখকের লেখাই ব্লগে পড়েছি।
বইটি সম্পর্কে দু’চারটি কথা না বলে আমার এ লেখাটা শেষ করা অনুচিত হবে। বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ সালে, অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। এর প্রকাশক বাদল সাহা শোভন, পূর্বা প্রকাশনী, ঢাকা। ৬৪ পৃষ্ঠার এই বইটিতে কবিতা রয়েছে মোট ৪৯টি। বইটি সম্পর্কে প্রকাশক লিখেছেনঃ “শিরীন সাজি’র কবিতায় ভালোবাসা ছলকায়, এটা পাঠকদের অনুভূতি। নিজের লেখা নিয়ে তার কথা হলো, জীবনের বেঁচে থাকা ভালোবাসাতেই মূর্ত হয়ে ওঠে। গভীর অন্ধকারে যেমন ছোট জোনাকির দল পথ দেখায় পথিককে, তেমনি ভালোবাসার আলোতেই জীবনের বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়া সম্ভব বলে তার বিশ্বাস। আর ভালোবাসার সেই অমল ধবল বোধ, যার অনুরণন চলে সারা জীবন ধরেই"।
আর স্বয়ং লেখক বইটি সম্পর্কে বলেছেনঃ “মায়া মানেই তো টান। অদ্ভূত অপার্থিব এক টান।… জগতের সবচেয়ে পুরাতন বোধ বুঝি প্রেম! ….ভালোবাসা আমার কাছে সেই ম্যাজিক, যা আছে মনে হলেই ফুলকি ছড়ায়। ….. বেঁচে থাকা ভালো হয়ে যায় এই ফুলঝুরি ভালোবাসায়। ….. আমি ভালোবাসার এই ফুলঝুরিতে ভেসে বেড়াই (বইটির শেষ বাক্য)"। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে মাস্টার্স করার পর সাজি চলে যান কানাডায়। প্রথমে মন্ট্রিয়লে ছিলেন, এখন থাকেন অটাওয়ায়। তবে এর আগে তার শৈশব, কৈশোর কেটেছে লালমনিরহাট সহ অন্যান্য রেলওয়ে শহরে রেলের কোয়ার্টার্সে, বাবা রেলওয়ের ডাক্তার হওয়ার সুবাদে। সে কারণেই বোধহয় তার কবিতায় রেলের কথা ঘুরে ফিরে আসে। যেমনঃ
“একদিন এক রেলগাড়ির কামরায় কবির সাথে আমার দেখা হয় - (‘কবির জন্য কবিতা’, ব্লগে প্রকাশিত)
"কবিরা সবাই গাছের মতন। ওদের শেকড় বাকড়ে চলতে থাকে স্মৃতির রেলগাড়ি।" (ঐ)
*শেষরাতের ট্রেন চলে গেলে ওদের নিঃশ্বাস আরো ভারী হয়” (‘স্বপ্ন, শিউলিফুল……’)
*ট্রেনটা চলে যাচ্ছিল যখন, সিগন্যালে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম আলোর শেষ রেখাটুকু” (আত্মার টান)
*শেষরাতের ট্রেন চলে গেলে সিগন্যালে জমে থাকে জোনাকি” (‘তুমি’)
*ঝিকঝিক রেলগাড়ি চলে, ইটের ভাটার বুকে ধিকিধিকি আগুন জ্বলে, তোমাকে মনে পড়ে খুব। শুধু তোমাকেই। (‘অভিমান’)
* কোনদিন দেখা হবে না জেনেও মন ঘুরে বেড়ায় কত রেলস্টেশন (‘মায়া’)
*ইচ্ছে ছিল, দূর থেকে আসা ট্রেনের ৩৩৯ নং কামরা থেকে নেমে আসবে কেউ। পিঠে ব্যাকপ্যাক।
*দূর থেকে দূরে বয়ে যাওয়া সেই রেলগাড়ি। কে যেন হাত নেড়ে বিদায় বলে যায় কাকে!
বইটির প্রুফরীডিং সন্তোষজনকভাবে সম্পন্ন হয় নাই। অনেক শব্দের মাথায় অনাবশ্যক ভাবে চন্দ্রবিন্দু বসেছে, আবার যেখানে আবশ্যক ছিল, সেখানে বসে নাই। যেমনঃ
ছাঁয়া (একাধিক কবিতায়), মাঁচা, ছুঁটতে, কুঁড়িয়ে, কুঁড়ানো, কৌঁটা (অনাবশ্যক ভাবে চন্দ্রবিন্দু বসেছে)।
পাজর (চন্দ্রবিন্দু আবশ্যক ছিল, কিন্তু বসে নাই)।
আবার দুটো শব্দের মাঝে যেখানে স্পেস থাকা আবশ্যক ছিল, সেখানে তা নেই; ফলে দুটো শব্দ জোড়া লেগে গেছে। যেমনঃ
বইএর, রেশছিল, ঘুমনা, সকালভাসে।
যাহোক, এ বইয়ের ৪৯টি কবিতাই আমি পড়েছি। কবিতাগুলোতে মনুষ্য প্রেম, প্রাকৃতিক প্রেম, পাখি প্রেম, স্মৃতিকাতরতা, প্রবাসী জীবনের বৈরী শীতার্ততা (“বাইরে রোদের সাঁতার অথচ বাতাসে ভিড় করে আছে বাঘের নখ” – ‘শীত’) ইত্যাদি বিষয়ে কবি সাবলীল ভাষায় তার মনের ভাবাবেগ ও অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। তবে কবি’র ব্লগ পাতায় আরও অনেক ভালো ভালো কবিতা রয়েছে, যেগুলোর সুচয়িত শিরোনামই পাঠককে কবিতায় টেনে নিয়ে আসে। সেগুলো হয়তো ইতোমধ্যে কবি’র অন্যান্য কবিতার বইয়ে ঠাঁই পেয়েছে। না পেয়ে থাকলে আশাকরি, কবি সেগুলোকেও মলাটবদ্ধ করতে প্রয়াসী হবেন।
রিজাইনা, কানাডা
১৪ জুন ২০২৪
শব্দ সংখ্যাঃ ৯৬৫
লাঞ্চের পর টেবিলে বসেই আড্ডা....
অনেক গল্পের পর, বিদায় নেয়ার আগে.....