আগের পর্ব
মামাবাড়ী, ইশকুল ... ১৬
শিরোটীকা: আমার শৈশব কৈশোরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০১১ এর এপ্রিল মে মাসে কয়েকটি পর্ব পোস্ট করেছিলাম। ২০১২ এর জানুয়ারীতে ১৬শ পর্ব পোস্ট করে থেমে গিয়েছিলাম। এতদিন পরে ইচ্ছে হলো আরো কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করার। তা হলে শুরু করা যাক।
শোভা ভাই
হাতিয়ায় থাকার সময় চরইশ্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদুল হক খান ওরফে খোকা মিয়া আমার আম্মাকে বোন ডেকেছিলেন। তখন থেকে তিনি আমার মামার দলে ঢুকে পড়েছেন। তাঁর ছেলে শোভা খান একদিন আমাদের বাড়িতে এসে উঠলেন। প্রথমে ভেবেছিলাম বেড়াতে এসেছেন। যখন দেখি তাঁর নড়ার কোন লক্ষণ নেই তখন আম্মার কাছে বললাম বিষয়টা। আম্মা জানালেন, শোভা ভাই আমাদের বাড়ীতে থেকে লেখাপড়া করবেন। ক'দিন পরে তিনি কবির হাট কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হলেন। এটা ১৯৭০ খিস্টাব্দের কথা। কলেজটি চালু হয় ১৯৬৭তে। শোভা ভাই নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি লজিং মাস্টারের স্টাইলে আমাকে পড়াতে শুরু করলেন। তবে পড়ার চেয়ে শোভা ভাইয়ের আড্ডা আর গানবাজনায় বেশি আগ্রহ দেখা গেলো। আমার এক জ্যেঠাতো ভাই আবুল হোসেন ওরফে আবু ভাই জুটলেন তাঁর সাথে। আবু ভাই তবলা বাজান, শোভা ভাই গান করেন। আমাদের বাপচাচারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। তবে শোভা ভাইয়ের গানবাজনা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করতেন না। কিন্তু দাদাদাদী সেটা পছন্দ করতেন না। দাদী প্রকাশ্যে কিছু বলতেন না। গান শুরু হলে আসতাগফিরুল্লাহ পড়তে পড়তে দূরে চলে যেতেন। দাদা বলতেন, ইবলিশগুন কি শুরু কইচ্ছে ? (ইবলিশগুলো কি শুরু করেছে) দাদা খুব রেগে গেলে মূলতঃ দুটি শব্দ ব্যবহার করতেন-ইবলিশ আর হার্মাদ। আর কোনো কথা তাঁকে কখনো বলতে শুনি নাই। দাদা আবার কট্টর ছিলেন না। আমাদের গ্রামের বাজারের মসজিদের জমি তিনি ওয়াকফ করেছেন,আবার ১৯৪৪ সালে প্রাইমারী স্কুলের জন্যও জমি দিয়েছেন। শোভা ভাই যখন দেখলেন, গানের সমঝদার নেই, তখন বাইরে গান গাইতে চলে যেতেন। আড্ডা মেরে অনেক রাতে ফিরতেন। তখন তো গ্রামে বিদ্যুৎ ছিলো না। (আমাদের গ্রামে ১৯৮০তে বিদ্যুৎ চালু হয়েছে) সাপখোপের রাজত্বে সেটা অনেক সাহসের ব্যাপার ছিলো। আরেকটা বিপদ ছিলো কুকুর। আমাদের বাড়িতে লেজকাটা একটা কুকুর ছিলো। সে আবার ভীষণ মেজাজী। কতোবার যে শোভা ভাই আর আবু ভাই রাতের বেলা সেই কুকুরের তাড়া খেয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। একবার শীতের রাতে কুকুরের তাড়া খেয়ে পুকুরে নেমে প্রাণ বাঁচাতে হয়েছে।
ছোট্ট নতুন বোন, বোয়াল মাছের ডিম
এক বর্ষার দিনে সকাল বেলা চাঁদি-ফাটা রোদ উঠেছে। নাস্তা সেরে উঠানে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি। বাড়ির ভেতরের বিরাট উঠানটি ভীষণ পিচ্ছিল। কতোবার যে কতোজন আছাড় খেয়েছে, প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে তার হিসাব নেই। আমি ছিলাম আছাড়-মাস্টার। প্রায় দৈনিকভিত্তিতে আছাড় খেতাম। সেদিনও ব্যতিক্রম হলো না। বাড়ির পূব দিক থেকে হৈচৈ কানে আসতেই সব ভুলে দৌড়। যথারীতি ধপ করে পড়ে পিছলে চলে গেলাম অনেক দূর। জামাকাপড় মায় চুলের পেছন পর্যন্ত কর্দমাক্ত। তাতে একবিন্দু দমলাম না। ছুটলাম হৈচৈ লক্ষ করে। গিয়ে দেখি এলাহী কারবার। বাড়ির পাশের বিশাল দীঘির যে নালা দিয়ে মাঠের সাথে যুক্ত (নোয়াখালীর ভাষায় দীঘির জান) তাতে সেজ জ্যেঠা জালের ফাঁদ পেতেছিলেন। তাতে বিশাল এক বোয়াল মাছ আটকেছে। সবাই বছলে তার ওজন হবে কমসে কম ১৫ সের। (তখনো কেজির কোন নাম নিশানা ছিলো না।) আমাদের ভাইবোন বাহিনীর বিশাল মিছিলের আগে আগে বোয়াল চললো বাড়ীর পথে। মাছ কাটার পর যে ডিম বের হলো তার ওজনই ৫ সের ! সবার চোখ ছানাবড়া। এই হৈচৈয়ের মদ্যে সেজ জ্যেঠা দেখি আজান দিচ্ছেন। ঘটনা কি ? শোনা গেলো ছোট চাচী একটি ফুটফুটে কন্যার জন্ম দিয়েছে। ভাইবোন বাহিনীর মধ্যে ভাইয়ের সংখ্যা একটু বেশি ছিলো বলে ফুটফুটে বোন পেয়ে আমাদের খুশি দেখে কে !
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:০১