আগের পর্ব-
মামাবাড়ী, ইশকুল ... ১৯
খেজুর গাছ কাটা
এখানে খেজুর গাছ কাটা বলতে গোড়া থেকে গাছ কাটা বোঝানো হয়নি। শীতকালে খেজুর রস সংগ্রহ করার জন্য গাছের ওপরের অংশে দা দিয়ে চামড়া তুলে খেজুর রস সংগ্রহ করাকে বুঝিয়েছি। আমাদের বাড়ীর চারপাশে রাস্তা এবং উঁচু জমির আইলে সারবাঁধা খেজুর গাছ ছিলো। এখনো কিছু আছে। শীতের শুরুতে সব গাছের ওপরের অংশে পাতার নীচে সাফ করা হতো। এই কাজের জন্য স্পেশাল কিছু দক্ষ লোক ছিলেন। তাঁদেরকে নিয়ে আসা হতো এই কাজের জন্য। সেজন্য তাঁদেরকে টাকা দেয়া হতো। নেট থেকে এর একটা ছবি দিলাম বোঝার সুবিধার্থে।
এরপর প্রতিদিন বিকালে গাছের সে অংশের হালকা একটা অংশ কেটে ফেলে রসের খালি হাঁড়ি ঝুলিয়ে দেয়া হতো। দু'পাশ থেকে খাঁজ কেটে মাঝ বরাবর বাঁশের চোঙ্গা কেটে গাছের গায়ে আটকে দেয়া হতো। সেই চোঙ্গার নীচে হাঁড়িটি ঝোলানো হতো। ফজরের নামাজ পড়ে সব গাছ থেকে রসে ভরা হাঁড়ি নামিয়ে আনা হতো। এই গাছ কাটার কাজ করতেন আমার সেজ জ্যাঠা সিদ্দিকুল্লাহ সাহেব। গাছ কাটার সময় হাঁড়িটা পেছনে ঝুলিয়ে নিতেন। গাছ কেটে সেটা গাছে ঝুলিয়ে নেমে পড়তেন। এর জন্য কিছু সাজ সরঞ্জাম লাগতো। একটা বাঁশের লম্ব ঝুড়ির মধ্যে ধারালো রাম দা ধরনে লম্বা দা আর কাঠ বা বাঁশের একটা ভারী টুকরা থাকতো। একটা মোট দড়ি থাকতো গাছ কাটার সময় গাছের সাথে কোমর পেঁচিয়ে বাঁধার জন্য। ফলে দুই হাত ব্যবহার করে গাছ কাটা সহজ হতো। জ্যেঠা সবক'টি গাছে একটা করে বাঁশের টুকরা বেঁধে নিতেন দাঁড়ানোর সুবিধার জন্য। ধারালো দা গাছের সাথে লাগিয়ে কাঠ বা বাঁশের ভারী টুকরাটি দিয়ে দায়ের পেছনে ঠুক ঠুক করে হালকা বাড়ি দিয়ে গাছ কাটা হতো। শেষ ফিনিশিং দেয়া হতো দুই হাত দিয়ে টেনে টেনে। এরও একটা ছবি দিলাম নেট থেকে।
আমার সেই জ্যেঠা মারা গেছেন বছর দশেক আগে। তিনি বৃদ্ধ হয়ে যাবার পর বাইরের লোক দিয়ে আমাদের গাছগুলো কাটা হতো। গত সা আট বছর আর সেটাও হচ্ছে না। কারণ গাছ পরিষ্কার করা বা গাছ কাটা জানের এমন কেউ নাকি আমাদের এলাকায় নেই। তবে সুখের কথা দেশের কিছু অঞ্চলে বিশেষ করে যশোহর, ফরিদপুর, নওগাঁ, বগুড়ায় এখনো গাছ কাটা হং বলে আমরা খেজুর রস পাই আর খেজুরে গুড়্ও পাই। যাঁরা এখনো কাজটা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা জানাই।
রস চোরের দল
কষ্ট করে গাছ কাটার পর সকাল বেলা যে পুরো রস পাওয়া যাবে তার নিশ্চয়তা ছিলো না। চোরের দলের তালিকাটি অনেক লম্বা। প্রথমত বাদুড়, নিশাচর পাখির দল বাঁশের নলের সাথে মুখ লাগিয়ে পেট ভরে রস খেয়ে যায়। ফলে হাঁড়িতে কিছু রস কম পড়ে। পোকামাকড়ের দলেরও যে মিস্টি খেজুর রসের প্রতি লোভ আছে সেটা লেখাই বাহুল্য। সেই দলের শিরোমনি হলেন পিঁপড়ার দল। এর পরে আসে দ্বিপদের দল। কিছু আছে হাঁড়িসহ রস চুরি করা আদি ও আসল চোরের দল। আর আছে ভদ্রবিশী চোরের দল। সেই দলের লোক ছিলাম আমরাও। শোভা ভাই আর আবু ভাইয়ের নেতৃত্বে গভীর রাতে গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামিয়ে পাতিলে জমানো হতো। কষ্ট করে আবার হাঁড়িটা গাছে ঝোলানো হতো। বাকি রাতের রসটুকু যেনো মূল মালিকের ভাগে যায়। জমানো রস দিয়ে রান্রা করা হতো রসের সিন্নি। মোটা চালের সেই সিন্নি গরম গরম খাওয়া হতো। মা চাচীরা এই সব অপকর্ম টের পেতেন। জ্যেঠা বা দাদা টের পেতেন না। টের পেলে যে খবর ছিলো সেটা বলাই বাহুল্য।
ভোর বেলা রস নামিয়ে বাড়ীর পথে
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০২০ বিকাল ৫:৫০