শেষ পর্যন্ত আরবাজ চৌধুরীকেই বিয়ে করেছি আমি। সিদ্ধান্তটা নেবার ঠিক পরপরই মনে পড়েছিলো একজন আপুকে। যে আপুটা একবার একি খেলা আপন সনে সিরিজটা লিখবার সময় লেখিকাকে বলেছিলো, আল্লাহর দোহাই লাগে এইবার আরবাজ চৌধুরীর সাথে নায়িকার বিয়ে দিয়ে দাও। তবে হ্যাঁ তখনও পর্যন্ত ইহ জগতের কাউকেই বিয়ের ভাবনাটা মাথায় ছিলো না। বরং আজীবন নিজের মত নিজেই চলবো এমন একটা দৃঢ় কঠিন মানসিক অবস্থার সাথে একাত্মতাটাই ছিলো বেশি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই অনড় অটল সিদ্ধান্তটাকেই বদলে ফেলতে হলো এবং জীবনের এতগুলো দিন কাটিয়ে আসবার পর সেই সিদ্ধান্তটা নিতে আমার সময় লেগেছিলো মাত্র ৬টা দিন । শুধুমাত্র ৬ টা দিন। ৬ দিনের সিদ্ধান্তের পর ২০১৯ এর এক হাঁড় কাঁপানো শীতের রাত্রীতে আমার চির চেনা বাড়ি এবং আমার সারাজীবনের এক মাত্র সুখ ও দুঃখের পথ চলার সাথী ঝুমকী ফুপিকে ছেড়ে আসতে হলো আমাকে। অবশ্য আরবাজ আর আমি দু'জনেই চেয়েছিলাম জীবনের বাকী কটা দিন ফুপি আমাদের সাথেই থাকুক। কিন্তু আমার দৃঢ় ব্যাক্তিত্বের অধিকারিণী নিজের মত নিজে চলতে চাওয়া স্বাধিনচেতা ফুপি কিছুতেই রাজী হননি আমাদের ওমন আবদারে। বরং আমার আরবাজকে বিয়ের পিছে তার চাওয়াটাও প্রবল ছিলো।
তবে আমার নিজের বা আরবাজের কিংবা ফুপি বা আর সবার চাওয়া বা ইচ্ছের চাইতেও দাম দিতে হয়েছিলো আমাকে যার চাওয়াটাকে সেই মানুষটি তখন মৃত্যুশজ্জায়। কেমো দেওয়া কালী মাড়া মুখ, ওমন অঢেল কালো কুঁচকুচে কেশবিহীন শুন্য মাথা ও পৃথিবী থেকে নিশ্চিৎ বিদায় নিতে চলা মানুষটির কথা ফেলতে পারিনি আমি। আমার ভিষন কষ্ট হচ্ছিলো। সেই কষ্টের সাথে মিশে ছিলো আমার ছেলেবেলার অব্যাক্ত কষ্টগুলোও। যা বুকের মধ্যে চেপে রেখে এতটা পথ হেঁটে আমি আজ এইখানে এসে পৌছেছি।
আমার সঙ্গে সেই ছিলো তার প্রথম দেখা। যদিও তার সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই জানতাম আমি। তার ও বাড়িতে আসবার প্রথম দিনটি মানে তার বিয়ের ছবি। প্রথম ও দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের খবর, ওদের পারিবারিক মুহূর্তের সুখ ও দুঃখের সকল ঘটনাই জানা ছিলো আমার কিন্তু আমি এটাই শুধু জানতাম না আরবাজ যে ওকেও আমার সম্পর্কে সবই খুলে বলেছে। আর্শীয়া মানে আরবাজের বউ যখন আমার হাত দুটো ধরে বলে উঠলো, তোমাকে দুচোখের সামনে দেখবার আমার অনেকদিনের ইচ্ছে ছিলো কিন্তু কখনও মুখ ফুটে এ কথা কাউকে বলতে পারিনি। তবে আমি আজ খুশি কারণ জীবনের শেষ দিনগুলোতে এসেও শেষ পর্যন্ত দেখা হলো তোমাকে আমার। আমি জানিনা কেনো যেন এই বয়সে এসেও ওর এই কথাগুলো শুনে আমার খুব লজ্জা লাগছিলো। ভাবছিলাম না জানি এই মেয়েটা আমাকে কি ভেবে এসেছে এতকাল?
আর্শীয়া আমার সাথে খুব একান্তে কিছু সময় কাটাতে চেয়েছিলো। এ কথা আরবাজ যখন আমাকে জানিয়েছিলো তখন আমি দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিলাম। ওর সাথে দেখা করাটা কি আমার ঠিক হবে, কি হবে না এমনই নানা রকম দ্বিধাদ্বন্দের দোলাচলে দুলছিলাম আমি। কিন্তু যখন জানলাম এটা তার জীবনের শেষ কটা দিনের ইচ্ছের মাঝে একটা বিশেষ ইচ্ছে তখন আর না করতে পারলাম না। আর ভীষন অবাকও হয়েছিলাম জেনে যে আর্শীয়া দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে ভুগছে। সে কথাটা আমি এত দিন জানতাম না। অথচ আরবাজের বিয়ের পরেও বহু বহু দিন ওদের সকল খবরাখবরই জানা ছিলো আমার।
তবে আরবাজের সাথে আমার লাস্ট কয়েক বছর যোগাযোগটা কমেই আসছিলো। ঠিক যেমন হয় আর কি জীবনের নিয়মে। আমিও ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম আমার চাকুরী ও নানা রকম কাজও কর্মের মাঝে। আরবাজও তার বিজনেস এবং সংসারের নানা রকম চক্করে পড়ে তরুণ বয়সের সেই অপ্রতিরোধ্য আবেগকেও সংযত করে নিয়েছিলো কিছুটা হয়ত। তাই শেষের দিকে বেশ কিছুদিন যোগাযোগ কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় ঠেকেছিলো । আমিও আগ বাড়িয়ে যোগযোগ করতে যাইনি। কারণ আমার মনে হয়েছিলো আমার সেটা করা একেবারেই ঠিক হবে না বরং আমার এমনটাই করা উচিৎ মানে আরবাজকে পুরো দস্তর সংসারী হয়ে ওঠাতে সাহায্য করা। আর আমাকে ভুলতে পারাটাও।
কিন্তু আমি জানতাম না যে ওর এই হঠাৎ যোগাযোগহীনতার পিছনে যে আর্শীয়ার এই অসুস্থতা কাজ করছে। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত আর্শীয়ার জীবনে ধরা দিয়েছে এই কাল রোগ। আর্শীয়ার পান্ডুর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি মিলাতেই পারিনা ওকে ছবিতে দেখা ওর ঢলঢলে লাবন্যে ভরা মুখটার সাথে। এই কালী বর্ণ শুস্ক চেহারার মাঝেও ওর বড় বড় মায়াময় চোখ দুটোতে বুঝি জমে আছে শত জীবনের কাব্যকথা।
আর্শীয়া আমাকে দু হাত ধরে ওর সামনে বসালো। বললো তোমাকে একটাবার দেখার বড় ইচ্ছে ছিলো। সে সাধ মিটেছে আমার। কিন্তু তোমার কাছে আমি আমার শেষ চাওয়াটা চাইবো। তুমি ফেরাতে পারবেনা আমাকে। এ কথা দাও। কথাগুলো শুনতে প্রায় সিনেমা নাটকের মত ছিলো। কিন্তু আমার শরীর হিম হয়ে উঠলো। কি চায় আর্শীয়া আমার কাছে? ওর যা আছে তার তুলনায় আমার কিছুই নেই, আর ওকেও আমার তো কিছুই দেবার নেই। আমার চেহারা দেখে বুঝি বুঝলো আর্শীয়া। হেসে উঠলো খিলখিল। এত অসুস্থতার মাঝেও আর্শীয়ার হাসি যেন কাঁচভাঙ্গা আয়নার মত ঝরে পড়লো সেই নিস্তব্ধ ঘরের চারিদিকে।
মনে পড়লো বহু বছর আগে এমনই এক একাকী ঘরে মুখোমুখি বসা আরেক রমনীর মন ভেঙ্গে দেওয়া দৃঢ় কঠিন কথাগুলি। চলে যাও, সরে যাও দোলনের জীবন থেকে। তবে কি আজও এই পান্ডুর মুখে টলটলে মায়াবী সুন্দর চোখের আর্শীয়াও আমাকে চলে যেতে বলবে ওদের ছা্যা থেকেও বহুদূরে। আমি তো দূরেই আছি। আসিনি একটাবারও ওদের মাঝে। আমি নিশ্চুপ বসে ছিলাম ওর মুখে তাকিয়া। আর্শীয়া বললো,
- দেখো এই পৃথিবীতে আমি আর বেশি দিন থাকবো না। এই সুন্দর সাজানো সংসার। এই রকম অসম্ভব সুন্দর হৃদয়ের একজন স্বামী, এই বিত্ত বৈভব এবং আমার দুটি সন্তানকে ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাকে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় আমার এটা ভাবলে যে এই বয়সে আমার সন্তানেরা তাদের মাকে হারাবে। আমি মানছি ওরা দুধের শিশু নয়। কিন্তু এই বয়সন্ধিক্ষনের ছেলে দুটিরন জন্য যে বন্ধুটির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সে তাদের মা। সেই আমি সেই মাকেই চলে যেতে হচ্ছে যেই পৃথিবী ছেড়ে।
বিশ্বাস করো আমার এই আসন্ন মৃত্যু নিয়ে আমার কোনো দুঃখ নেই। এই সংসারের ইট কাঁঠ পাথর আসবাব বা তৈজসপত্রের উপরেও আমার আর আজ একফোটা মায়াও অবশিষ্ঠ নেই। এমনকি আমার এত বড় মহৎ হৃদয়ের স্বামীর জন্যও কোনো দুঃখ নেই আমার। আমি জানি আমি চলে গেলে হয়ত আমার শূন্যতাও পূর্ণ হবেনা কোথাও কোনোখানে। তবুও আমার কোনো দুঃখ নেই। আসলে কারো শূন্যতাই কেউ কখনও পূর্ণ করতে পারেনা। যে যার স্থান দখল করে থাকে তার জায়গাতেই। যেমন তোমার শূন্যতাটুকুও আমি কখনও পূর্ণ করতে পারিনি আরবাজের জীবনে। তবুও আমার দুঃখ নেই কোনো...
আমি কাঁটা হয়ে বসেছিলাম। খুব ভয় হচ্ছিলো। আর্শীয়া বুঝি মনে মনে আমাকেই দোষারোপ করেছে সারাটাজীবন কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। কিন্তু আর্শীয়া তেমন কিছু বললো না। মৃদুহাস্যে কথাগুলো বলে চলেছিলো সে। কিন্তু এরপর সে খুব ভয়ংকর একটি কথা বললো যেই কথাটাকে কেউ কখনও হয়তো একজন মৃত্যুপথ যাত্রীর অনুরোধ ভেবে কখনই ফেলতেই পারবেনা। সে আমাকে আরবাজকে বিয়ে করতে অনুরোধ করলো। আমি ওর দিকে তাকাতেই পারছিলাম না। কি বলবো ভেবেও পাচ্ছিলাম না।
আর্শীয়া বললো দেখো আরবাজের জীবনে তোমাকে আসতে বলার চাইতেও আমার দুটি সন্তানের জীবনে তোমাকে বড় প্রয়োজন। আমি জানি তোমার কথা। তোমার ছেলেবেলার দুঃসহ সকল ইতিহাসই আমার জানা। যে ভালোবাসা যে মমতা পেলে তুমি তোমার জীবনের গল্প আজ অন্যভাবে লিখতে পারতে সেই মমতা সেই ভালোবাসা তোমার বুকে জমানো আছে ঠিক তোমার মতনই ছেলেবেলায় মা হারানো কোনো সন্তানদের জন্য। আমি চাই তুমি ওদের দায়িত্ব নাও। তোমার সবটুকু অপ্রাপ্তি দিয়ে ভালোবাসায় ভরিয়ে তোলো ওদের জীবন। তুমি আমাকে না করো না। আমাকে এই কথা দাও। আমি হ্যাঁ না কিছুই বলতে পারছিলাম না। নিশ্চুপ বসে ছিলাম অনেকটা সময়।
আর্শীয়া বললো তুমি কি ভাবছো আমি জানি। যে স্বাধীন জীবনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছো জীবনের এতটা কাল ধরে। সেই জীবনটাকে পরাধীনতার শিকলে বাঁধবে কিভাবে তাই না? আমি তোমাকে একটা কথা বলি। মন দিয়ে শোনো। সকল জীবন পূর্নতা পায় না। জীবনের নিয়মগুলি মেনে না নিয়ে অন্যরকম নিয়মে মানাতে চাইলে আসলে সে জীবনটা অপূর্নই রয়ে যায়। এই আমাকে দেখো পরিপূর্ণ জীবন নিয়ে চলে যাচ্ছি আমি। আমি পরাধীন নই, ছিলামও না। কোনো কিছুই অপূর্ণ রাখিনি আমার জীবনে। কোনো দুঃখ নেই, আফসোস নেই, হতাশা নেই। শুধু আমি চাই আমার অবর্তমানে এই পরিবারে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে সেই শূন্যতা তুমি তোমার ভালোবাসা আর মমতা দিয়ে পূর্ণ করে দাও। মুছে ফেলো আমার অভাবটুকু ওদের জীবন থেকে। নিজেও পূর্ণ হয়ে ওঠো। আমি চাইনা আমার জন্য কষ্ট পাক ওরা। জানো যদি যাবার আগে আমার স্মৃতিটুকু মুছে দিয়ে যেতে পারতাম ওদের বুক থেকে তবে তাই করতাম। তবে আমি চাই তুমি এই দায়িত্বটুকু নাও। ভরিয়ে দাও এ সংসার। এ সংসারের মানুষগুলোকে । আমি জানি তুমি পারবে। একমাত্র তুমিই পারবে। আমি এটাও চাই তুমিও ভালো থাকো।
এরপর আর্শীয়া যে কটা দিন বেঁচেছিলো উঠে পড়েই লেগেছিলো আমার পেছনে। এই মেয়েটার জন্য আমার খুব কষ্ট হত। জীবনে আর কিছু চাইবার ছিলো না যার, সেই মেয়েটাই আজ আকুল হয়ে চাইছে আমার কাছে। এমন কিছুই সে চায় তা নিয়ে আমার মনে নানা রকম দ্বিধা ও দ্বন্দের ঝড়।
আর্শীয়ার মত ওমন অপরূপা সুন্দরী মেয়ে যে পড়ালেখায় এত ভালো হতে পারে আমার এমন কখনও দেখা ছিলো না। ফিজিক্সে পি এইচ ডি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছিলো সে । আরবাজের মতন এমন স্বামী এবং দুটি রাজপুত্রের মত ছেলে নিয়ে সুখী ও সমৃদ্ধ এক জীবনে নেমে আসা হঠাৎ ঝড়ে বিপর্যস্থ হয়ে গেলো ওদের সাজানো সংসার। তবুও ভেঙ্গে পড়বার আগেই খুঁটি বেঁধে দিতে চাইছিলো বুঝি আর্শীয়া। যে খুঁটি ধরবার সাহস আমার ঠিকই ছিলো কিন্তু সাধ্য বা ইচ্ছেটা হয়ত ছিলো না। অথবা ছিলো কোনো এক অজ্ঞাত দ্বিধা দ্বন্দ অথবা কোনো অজানা ভয়।
তবুও আর্শীয়ার প্রস্তাবে শেষ পর্যন্ত রাজী হলাম আমি। কি ভেবে হলাম আর কি না ভেবে হলাম জানিনা। তবে আমার জীবনে হুট করে আমি কোনো ডিসিশান নেই না। তবে মনে হয় এই ডিসিশানটা হুট করেই নিতে হলো আমাকে। আর্শীয়ার মৃত্যুর মাস চারেক বাদে আরবাজের ছোট ছেলেটা যখন বললো, মা বলেছিলো মা যখন থাকবে না তুমি তখন আমাদের সাথে থাকবে। মা চলে গেলে আমাদের অনেক কষ্ট হবে কিন্তু তুমি তখন আমাদের সকল কষ্ট ভুলিয়ে দেবে। কিন্তু তুমি কি মায়ের কথা রাখবে না? ওর কথাগুলো আমার বুকে গিয়ে বিঁধলো। আমি ঠিক করলাম এই চ্যালেঞ্জ নেবো আমি এবং ৬ দিনের মাঝেই শুরু হলো আমার জীবনের নতুন অধ্যায়......
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০২১ রাত ৯:০৩