(১)
-তারমানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে প্রতি রাতে ঘুমান কিন্তু সকাল হলেই আর দেখতে পান না তাকে।আর আপনার ভাষ্যমতে আপনার মেয়ে পাচ বছর বয়সে মারা গেছে।
-হুম।
-আপনি নিশ্চই স্বপ্ন দেখেছেন?
-না।প্রতিদিতে রাত এগারোটায় আমি যখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিই ঠিক তখনই আমার মেয়ে আমার কাছে আসে।আমি তাকে নিয়ে একসাথে ঘুমাই।কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি আর তাকে দেখতে পাই না।আমি সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করেও কোথাও খুজে পাই নি।
ডঃ আমিনুল বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন।এরকম রোগী কখনোই তার কাছে আসে নি।অবশ্য ঘটনা বেশ অদ্ভূতই বটে।একটা লোক তার পাঁচ বছর বয়সে মারা যাওয়া মেয়েকে নিয়ে ঘুমাতে যায় কিন্তু সকাল হলেই আর মেয়েকে দেখতে পান না।কিছুক্ষণ ভাবার পর ডঃ আমিনুল তার সামনে বসা লোকটিকে জিজ্ঞেশ করলেন,
-আচ্ছা আপনার মেয়ে কত বছর আগে মারা গেছে?
প্রশ্নটা শুনেই লোকটা মাথা উচু করে ডঃআমিনুলের দিকে তাকালো।হয়তো অবাক হয়েছে এরকম প্রশ্ন শুনে।
-এ প্রশ্ন জিজ্ঞেশ করছেন কেনো?
-আগে উত্তর দিন।
-কণা মারা গেছে আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে।
-আমার মনে হচ্ছে আপনি একটা হেলুসিনেশনের মধ্যে আছেন।
-না।
লোকটার “না” বলাটা বেশ জোড় গলার আওয়াজ হয়ে ডঃ আমিনুলের কানে ভেসে আসলো। আমিনুল আবারো অবাক হলেন।লোকটার রোগ ধরতে পারছেন না তিনি।এরকম কখনোই হয় নি তার জীবনে।মনে হচ্ছে তার এতোদিনের সব সাধনা বিফল হতে চলেছে।কি একটা কথা মনে হতেই ডঃ আমিনুল আচমকা প্রশ্ন করে বসলেন,
-আচ্ছা,আপনার স্ত্রী কি বেচে আছে?
-এ কথা কেনো জিজ্ঞেশ করছেন?
-উত্তরটা দিন।
-নাহ, বেচে নেই।
-মারা গেছেন কিভাবে আপনার স্ত্রী?
-স্বাভাবিক ভাবেই মারা গেছে।
-আপনার স্ত্রী কত বছর আগে মারা গেছেন?
-পাঁচ বছর।
ডঃ আমিনুল ভাবছেন লোকটার স্ত্রী মারা গেছে বচর পাচেক আগে।আর তার মেয়ে মারা গেছে বছর দশেক আগে।কি এমন কারণ থাকতে পারে যার জন্য তার সামনে বসা লোকটার ক্ষেত্রে এরকম একটা ঘটনা ঘটছে।
টেবিলের অপর প্রান্তে বসা লোকটা মনে হয় বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে।
-বুঝেছি আপনি আমার সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না।
কথাটা ডঃ আমিনুলের একেবারে বুকের মধ্যে গিয়ে আঘাত হানলো।মনের মধ্যে একতা জিদ চেপে বসলো তার। সিদ্ধান্ত নিলেন যে করেই হোক এই সমস্যার সমাধান তিনি বের করবেনই।
-ইনশাআল্লাহ পারবো।তবে আমাকে কিছুদিন সময় দিতে হবে।
-ওকে।তবে যত দ্রুত সম্ভব।কারণ আমি স্বস্তিতে থাকতে পারছি না।
-আপনার বাসার ঠিকানা দিয়ে যান।আমি সময় করে আপনার বাসায় যাবো।
লোকটা পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে ডঃ আমিনুলের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।কার্ডটা নিয়ে চোখ বুলালেন একবার।তারপর সেটা পকেটে রেখে দিলেন।
-চিন্তা করবেন না। আমি আপনার এই সমস্যার সমাধান বের করবই।
-তাহলে আমি আপনার নিকট চির কৃতজ্ঞ থাকবো।
(২)
চেম্বার থেকে বের হওয়ার আগে বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিলেন আজকে তিনি আসবেন না।একটা জরুরি কাজ আছে।পকেট থেকে কার্ডটা বের করে ঠিকানা দেখে গাড়ি নিয়ে রওনা হলেন ডঃ আমিনুল।
যেতে যেতে চিন্তা করতে লাগলেন কিভাবে কি করবেন।অনেক্ষণ ভাবার পর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি যে লোকতার বাড়িতে দিচ্ছেন তা ঐ লোকটাকে জানাবেন না।লুকিয়ে দেখবেন কি হয়।
এলাকাটা বেশ নীরব।আশে পাশে তেমন বাড়ি ঘর নেই বলাই ভালো।ডঃ আমিনুল মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন লোকটা এতো নীরব পরিবেশে একা থাকে কি করে!ধীরে ধীরে লোকটার বাড়ির দিকে এগোতে লাগলেন।ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে সময়টা দেখে নিলেন।এগারোটা বাজতে আর দশ মিনিট বাকি।
একটা ঘরের লাইট জলতে দেখে সেদিকে এগোলেন ডঃ আমিনুল।জানালা দিয়ে তাকিয়ে লোকটাকে দেখতে পেলেন।ইজি চেয়ারে বসে লোকটা বই পড়ছে।ডঃ আমিনুল অপেক্ষা করতে লাগলেন।
এগারোটা বাজার সাথে সাথে ডঃ আমিনুল দেখতে পেলেন লোকটা বই রেখে এক গ্লাস পানি খেলেন।এরপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রুমের দড়জার দিকে তাকালেন।লোকটার দৃষ্টি অনুসরণ করে ডঃ আমিনুল দরজার দিকে তাকালেন।আর তাকিয়েই তিনি বরফের মত জমে গেলেন।ছোত একটা মেয়ে ধীরে ধীরে হেটে আসছে।লোকটা যা যা বলেছে ঠিক তাই তাই হচ্ছে।অবাক হয়ে তাকিয়ে প্রত্যেকটা কাজ দেখে যাচ্ছেন।বিশ্বাসই হচ্ছে না তার।এ কিভাবে সম্ভব!একটা মৃত মেয়ে কিভাবে জ্যান্ত হয়ে উঠতে পারে!ডঃ আমিনুল লোকটার কাজ দেখতে লাগলেন।মেয়েটাকে কোলে নিয়ে লোকটা বিছানার দিকে এগোলেন।মেয়েকে শুইয়ে দিয়ে লোকটাও শুয়ে পড়লো।
ডঃ আমিনুল ভেবে পাচ্ছেন না এটা কিভাবে সম্ভব।তাহলে কি লোকতা মিথ্যা বলেছে তার কাছে?আবার ভাবলেন লোকটা মিথ্যা বলবেই বা কেনো?এসব চিন্তা করতে করতেই ডঃ আমিনুলের চোখ আটকে গেলো বিছানার দিকে।লোকটা এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে।মেয়েটা বিছানা থেকে ধীরে ধীরে উঠে পড়লো।মেয়েটা বিছানা থেকে নেমে দড়জার দিকে এগিয়ে যেতেই ডঃ আমিনুল বুঝতে পারলেন মেয়েটা পাশের রুমে যাচ্ছে।মেয়েটা কি করতে যাচ্ছে তা দেখার জন্য পাশের জানালা দিয়ে উকি দিলেন।মেয়েটা রুমের একটা আলমিরার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার দড়জা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো।ডঃ আমিনুল অপেক্ষা করতে লাগলেন এরপরের ঘটনার জন্য।
আধা ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও মেয়েটা আলমিরা থেকে বের না হওয়ায় ডঃ আমিনুলের মনে কেমন যেনো একটা সন্দেহের সৃষ্টি করে।কৌতুহলের বশে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি বাড়ির ভেতরে যাবেন।বাড়ির সদর দড়জায় হালকা চাপ দিতেই খুলে গেলো।লোকটা বোধহয় দড়জা লাগাতে ভুলে গেছে।নিঃশব্দে পা ফেলে রুমের ভেতর ঢুকে পড়লেন।আলমারিটা যে রুমে সে রুমে গিয়ে আলমারিটা খুলে অবাক হয়ে গেলেন ডঃ আমিনুল।মেয়েটা আলমারির তাকে শুয়ে আছে।ব্যাপারটা খটকা লাগলো তার কাছে।ভালো করেই তাকাতে বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা।আর মনে মনে খুশি হয়ে উঠলেন।সমস্যার সমাধান তিনি পেয়ে গেছেন।
(৩)
-বের করতে পেরেছেন?
হুম।তার আগে আমি আপনাকে একটা জিনিশ দেখাবো।
-কি জিনিশ?
-আপনার বামে তাকান।দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা?
লোকটা বামে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো।একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মায়া ভরা মুখ।লোকটা অবাক হয়ে একবার ডঃ আমিনুলের দিকে আরেকবার মেয়ের দিকে তাকাচ্ছে।কাপা কাপা গলায় বলে উঠলেন,
-এটা তো আমার মেয়ে!
-হুম আপনারই মেয়ে।
-আপনার কাছে এলো কিভাবে?
-আমার কাছে আসে নি।আমিই নিয়ে এসেছি।
-মানে?
-গতকাল রাতে আমি আপনার বাড়িতে গিয়েছিলাম।আপনার ঘটনা চাক্ষুষ দেখার জন্য।এবং আমি আপনার সমস্যাটাও ধরতে পেরেছি।
-কি সমস্যা?
ডঃ আমিনুল কিছুক্ষণ কথা না বলে লোকটার দিকে তাকালেন।লোকটার মধ্যে একটা উত্তেজনা খেয়াল করলেন তিনি।
-বলছেন না কেনো?
-বলছি।প্রথম কথা হলো এই মেয়েটা আপনার মেয়ের মত দেখতে মনে হলেও আপনার মেয়ে না।
-কি বলতে চাচ্ছেন?
-আমি বলতে চাচ্ছি এই মেয়েটা আপনার আসল মেয়ে না।এটা একটা রোবট।যেটা আপনি বানিয়েছেন।আপনি একজন সাইন্টিস্ট।আপনি মানুষের মত দেখতে অবিকল মানুষ বানানোর এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন আপনার মেয়ে মারা যাওয়ার বছর দুয়েক আগে।আপনি সফলও হয়েছিলেন।আপনি আপনার মেয়েকে অনেক ভালোবাসতেন।মেয়ে মারা যাওয়ার পর আপনি মানষিক ভাবে অনেক ভেঙ্গে পড়েন।তখনই আপনি আপনার গবেষণাকে কাজে লাগান।নিজের মেয়ের মত দেখতে একটা মেয়ে তৈরি করেন।আপনি বেশ রাত করে বাড়ি ফিরতেন।এসে মেয়েকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পেতেন।আপনি রাতের খাবার খেয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ঘুমাতেন।কিন্তু মেয়ে মারা যাওয়ার পর আপনি মেয়েকে নিয়ে ঘুমাতে পারতেন না। মানষিক ভাবে আপনি অনেক ভেঙ্গে পড়েছিলেন।এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আপনি একটা রোবট বানান।যেটা দেখতে আপনার মেয়ের মত।এবং তার কাজ কর্মও একটা জীবন্ত মানুষের মত।আপনি তার মধ্যে প্রোগ্রাম করে রেখেছিলেন।রাত এগারোটা বাজইলেই মেয়েটা আপনার সামনে আসতো।এরপর আপনি মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন।আর আপনি ঘুমিয়ে পড়ার পর মেয়েটা তার জায়গামত চলে যেতো।
-আপনি সত্যিই ব্লছে ন এটা আমার মেয়ে না?
-অবশ্যই না।আসলে আপনি এতো বছর ধরে এইভাবে থাকতে থাকতে আপনার মস্তিষ্কে এটা গেথে গিয়েছিলো যে আপনার মেয়ে জীবিত আছে।
-আপনি এতো কিছু জানলেন কিভাবে?
-আপনার আলমারিতে আমি একটা ডায়রি পাই। আর আপনার কার্ডে আপনি যেখানে কাজ করেন সেখানের ঠিকানা হচ্ছে একটা ল্যাবের।যেখানে আপনি কাজ করেন।
লোকটা অবাক হয়ে তার মেয় সদৃশ রোবটটার দিকে তাকালেন। ডঃ আমিনুল লক্ষ্য করলেন লোকটার দু চোখ বেয়ে ধীরে ধীরে অশ্রু বইছে।লোকটার হয়তো স্মৃতি মনে পড়েছে।তার একমাত্র মেয়ের স্মৃতি।
(সমাপ্ত)