কোনমতে মুখে খাবার গুজে এপ্রনটা নিয়ে দৌড় লাগালাম হসপিটালের দিকে।ইমার্জেন্সি থেকে ফোন এসেছে একটু আগে।পেশেন্টের অবস্থা নাকি খুবই খারাপ।
ইমার্জেন্সিতে ঢুকলাম হাপাতে হাপাতে।ঢুকতে না ঢুকতেই এক লোক কাঁদতে কাঁদতে দুই হাত চেপে ধরলো জোড়ে।
"ডাক্তার সাহেব,আমার ওয়াইফকে বাচান প্লিজ।"
"আপনি শান্ত হোন,আমি দেখছি।"
লোকটার হাত ছাড়িয়ে পেশেন্টের দিকে এগিয়ে গেলো।প্রথমেই চোখ গেলো বাম হাতের দিকে।রক্তাক্ত একটা কাপড় দিয়ে বেধে রাখা হয়েছে কব্জির কাছের জায়গাটা।সুইসাইড এটেপ্ট নিয়েছে।মাথায় ঢুকলো না একটা বিবাহিত নারী সুইসাইড কেনো করতে গেলো।লোকটাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না তাদের সংসারে কোন প্রকার মনোমালিন্য চলছে।পরে ভাবা যাবে এসব।আগে পেশেন্টের কন্ডিশন দেখে নিই।
পালস চেক করলাম।বেশ দূর্বল।প্রেশার চেক করলাম।প্রেশার লো হয়ে গেছে।ব্লাড লস হলে যা হয় আরকি।
"আপনার ওয়াইফের ব্লাড গ্রুপ কি?"
"O+(ve)"
"ইমার্জেন্সি ২ ব্যাগ ব্লাড ম্যানেজ করুন।পেশেন্টকে ব্লাড দিতে না পারলে বাচানো মুশকিল হয়ে যাবে।"
"আত্মীয় স্বজন তো কেউ নেই আশেপাশে।তারা আসতে অনেক সময় লাগবে।"
বলেই লোকটা আবার কাঁদতে লাগলো।ঘাবড়ালাম না।এরকম প্রায়ই হয়।ইমার্জেন্সি ব্লাড ম্যানেজ করা খুবই কঠিন একটা কাজ।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফাহাদের নাম্বারে ডায়াল করলাম।ব্লাড যদি পাওয়া যায় এই ছেলেটাই সবার আগে ম্যানেজ করতে পারবে।
"ফাহাদ,তুই কই রে?"
"ক্যান্টিনে।নাস্তা করছি।"
"নাস্তা পরে কর।ইমার্জেন্সি দুই ব্যাগ O+(ve) ব্লাড দরকার।ম্যানেজ করতে পারবি এখনই?"
"আমি এক ব্যাগ দিতে পারবো।আরেকটা...একটু লাইনে থাক তো।"
অপেক্ষা করতে লাগলাম।ফাহাদের ওপর আলাদা একটা আস্থা আছে আমার।রক্ত দেয়ার কথা শুনলে নিজেকে থামাতে পারে না।নিজে দিতে না পারলে ব্লাড ম্যানেজ করে দেয়।এই নিয়ে ১২ বার ব্লাড দিয়ে ফেলেছে।
"হ্যা দোস্ত,আনিস ব্লাড দিবে বলছে।"
"গুড।তোরা দুইজন এখনই ইমার্জেন্সিতে চলে আয় এখন।পেশেন্টের অবস্থা খুবই সিরিয়াস।"
"ওকে।আসছি এখনই।"
ফোনটা পকেটে রেখে লোকটার দিকে তাকালাম।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার ওয়াইফের দিকে।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।ডাক দিলাম লোকটাকে।
"আপনি এখনই হসপিটাল থেকে দুইটা ব্লাড ব্যাগ কিনে আনুন।ডোনার ম্যানেজ হয়ে গেছে।"
লোকটার চোখে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠতে দেখলাম।তড়িঘড়ি করে ইমার্জেন্সি থেকে বের হয়ে গেলো।লোকটা চলে যাওয়ার পর নার্সকে পেশেন্টের কাটা জায়গা ওয়াশ করে ড্রেসিং করে দিতে বললাম।এরই মধ্যে ফাহাদ আর আনিস চলে এসেছে।ব্লাড ব্যাগ আনতে আনতে ওদের সাথে কথা বলতে লাগলাম।
"কেস কি রে?"
"সুইসাইড করতে গিয়েছে।"
"বলিস কি!অবস্থা কেমন এখন?"
"বেশি একটা ভালো না।ব্লাড ভালোই লস হয়েছে।"
"সুইসাইড করতে গেলো ক্যান?"
"শালা!আমি কি ডাক্তার নাকি জ্যোতিষী?"
আমার কথা শুনে ফাহাদ আর আনিস দুজনেই হেসে দিলো।ইমার্জেন্সির দরজা দিয়ে তাকালাম।লোকটা চলে এসেছে।
"তোরা শুয়ে পড়।"
নার্সকে ব্লাড নেয়ার জন্য বলে পেশেন্টের দিকে ফিরলাম।পালস চেক করতে গিয়ে পেশেন্টের চেহারায় নজর পড়লো।সাথে সাথেই চমকে উঠলাম।একবার লোকটার দিকে আরেকবার পেশেন্টের দিকে তাকালাম।চোখ ফিরিয়ে নিলাম।আমার পক্ষে আর তাকিয়ে থাকা সম্ভব না।
পাচ মিনিটের মধ্যেই ব্লাড নেয়া হয়ে গেলো।ক্রস ম্যাচিং এর জন্য নার্সকে দ্রুত যেতে বললাম।সাথে এও বলে দিলাম।ক্রস ম্যাচিংটা যাতে এখনই করে দেয়।পেশেন্টের অবস্থা খুবই সিরিয়াস।আমার কথা বললে তাড়াতাড়িই করে দেবে।
"দোস্ত,যাই তাইলে।খাওয়াটা শেষ করে আসি।"
"বিল দিস না।আমি দিয়ে দেবো।মামাকে আমার কথা বলিস।"
"তাহলে তো একটু বেশি করেই খেতে হয়।কি বলিস আনিস।"
আনিস হেসে সায় দিলো।ফাহাদ আর আনিসের ৩২ টা দাত বের হয়ে এসেছে ইতোমধ্যে।।শালারা খাওয়ার কথা শুনলেই পাগল হয়ে যায়।পাকস্থলির কোথায় যে এতো জায়গা ওদের!
"পেট ভরেই খাইস।"
ফাহাদ আর আনিসকে বিদায় দিলাম।নার্স আসতেই তাড়াতাড়ি ব্লাড দেয়ার জন্য বললাম।
ব্লাড দেয়ার মাঝে আবার পালস আর প্রেশার চেক করলাম।এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।বেশ ভালো লক্ষণ।
"আপনি আমার সাথে চেম্বারে আসুন।"
লোকটাকে নিয়ে চেম্বারে আসলাম।লোকটাকে বসতে বলে আমি নিজেও বসলাম।
"ডাক্তার,এখন কি অবস্থা?"
"চিন্তার কিছু নেই।ঠিক হয়ে যাবে সব।আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকুন।এরকম কি করে হলো বলবেন?যদি আপনার কোন আপত্তি না থাকে।"
"আমার কোন আপত্তি নেই।বলছি।"
কিছুক্ষণ থেমে লোকটা বলতে শুরু করলো।
"আমার আর দিয়ার বিয়ে হয়েছে ৬ মাস আগে।অ্যারেঞ্জ ম্যারিজ।সমস্যাটা শুরু হয় বিয়ের পরের মাসে।১২ তারিখ রাত ১২.০০ টার দিকে হটাৎ দিয়া ঘুম থেকে উঠে বলতে থাকে "আমাকে ক্ষমা করে দাও সাঈদ।"বলেই নিজের ওপর টর্চার করতে থাকে।অনেক কষ্টে কন্ট্রোল করতে হয় ওকে।পরেরদিন সাঈদ কে সেটা জিজ্ঞেস করেছিলাম।বলেছিলো ও নাকি এই নামে কাউকে চিনে না।আগের রাতের কথা বলার পর ও বলে ওর নাকি এসবের কিছুই মনে নেই।পরের মাসেও একই কাজ করে।১২ তারিখ ঠিক রাত ১২.০০ টার দিকে।ঠিক করলাম দিয়াকে সাইকোলজির ডাক্তার দেখাবো।কিন্তু কোন লাভ হয় নি।প্রতি মাসের ১২ তারিখ একই সময়ে ও একই রকম আচরণ করে।এর কিছুদিন পর আলমারিতে আমার কিছু দরকারি কাগজ খুঁজতে যেয়ে একটা ডায়রি পাই।ঐ ডায়রি থেকেই জানতে পারি সাঈদের কথা।এবং বুঝতে পারি বিয়ের আগে দিয়ার সাঈদ নামের একজনের সাথে রিলেশন ছিলো।ডায়রির প্রথমে ছেলেটার কথা লেখা ছিলো।এক বছর পরের লেখাগুলো আমার ওয়াইফের ছিলো।যদিও তার আগেই রিলেশিন ভেঙে গিয়েছিলো ওদের।দিয়ার লেখা থেকেই জানতে পারি ও নাকি বিনা কারণেই রিলেশন ব্রেক আপ করে।মাস খানেক পর ও সাঈদের সাথে যোগাযোগ করে মাফ চায় আর রিলেশন আবার শুরু করার কথা বলে।কিন্তু সাঈদ মানা করে দেয় এই বলে যে, 'যে মেয়ে বিনা কারণে রিলেশন ভাঙতে গিয়ে বলে এক বছরের রিলেশনে তাকে কোনদিন ভালোবাসে নি,শুধু অভিনয় করেছে।সেই মেয়ে আবার যে অভিনয় করবে না তার নিশ্চয়তা কি?"দিয়া প্রমিজ করেছিলো আর কখনো নাকি সে এমন করবে না।কিন্তু সাঈদ সে কথা শুনে নি।সব ধরনের যোগাযোগ অফ করে দেয়।"
এটুকু বলে লোকটা থামলো।এতক্ষণ কথা বলে লোকটার গলা শুকিয়ে গেছে।পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলাম।এই নিঃশ্বাসে পুরো পানি খেয়ে ফেললো লোকটা।
"হুম।চিন্তা করবেন না।সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি কিছু কথা বলবো আপনাকে।সে অনুযায়ী কাজ করলে আপনার ওয়াইফ ভবিষ্যতে এরকম কিছু করবে না।"
"কি কাজ?"
"বলছি।"
প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বললাম,
"আপনার ওয়াইফকে বলবেন সাঈদ নামের ছেলেটা অনেক আগেই তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে।সাঈদের কথা ভেবে কষ্ট না পেয়ে যাতে সব ভুলে যায়।সাঈদ ভালো আছে।"
"আপনি সাঈদকে চিনেন?তার ঠিকানা দিতে পারবেন?"
"হুম চিনি।বাট ঠিকানা দিতে পারবো না।তবে আপনি একটা কাজ করতে পারেন।"
মানিব্যাগ থেকে ছোট্ট খামটা বের করে দুটো ছবি খামের ভেতর ভরে খামের মুখ পিন আপ করে লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।
"এই জিনিসটা আপনার ওয়াইফকে দিবেন সুস্থ হওয়ার পর।এর আগে এটা খুলবেন না।"
"এটা কি?"
"সময় হলেই বুঝবেন।"
"বুঝলাম না।"
মুচকি হাসলাম লোকটার দিকে তাকিয়ে।
"চলুন, আপনার ওয়াইফের অবস্থা দেখে আসি।"
ইমার্জেন্সিতে এসে পেশেন্টের পালস চেক করলাম আবার।এখন বেশ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।আল্লাহর রহমতে চিন্তার কোন কারণ নেই আর।নার্সকে ব্লাড দেয়ার পর স্যলাইন দিতে বলে লোকটার দিকে ফিরলাম।
"সন্ধ্যায় আপনার ওয়াইফকে রিলিজ করে দিবো।বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন।"
"অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।"
মানিব্যাগ বের করতে করতে লোকটা বলতে লাগলো,
"আপনার ফিসটা?"
"লাগবে না।"
"এটা কেমন কথা বললেন!ফিস নিবেন না কেনো আপনি।"
"সেটা না হয় নাই জানলেন।আমি এখন আসি।বাসায় যাওয়ার আগে আমাকে একবার ফোন করবেন।নাম্বারটা নিন।"
লোকটাকে নাম্বার দিয়ে হিসপিটাল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসলাম।আজ বহুদিন পর অনেক খারাপ লাগছে।পরিবেশটা কেমন যেনো গুমোট লাগছে।
আমি আমার দিয়াকে তো এমন অবস্থায় দেখতে চাই নি কখনো।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:১৩