নগদ টাকার অভাব : হাজার হাজার আমানতকারী বাইরে অপেক্ষমাণ। ভেতরে একটি ঘরে পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষার্থী মাত্র একজন, প্রশ্নও মাত্র একটি। উত্তর কী হবে? কী সে প্রশ্ন এবং কে সেই পরীক্ষার্থী? বলাই বাহুল্য, এ মুহূর্তে পরীক্ষার্থী স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, যিনি একজন পণ্ডিত অর্থনীতিবিদ এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রিয় ব্যক্তি। যে প্রশ্নটি করা হয়েছে, তা করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা। তিনি দুবার এফবিসিসিআইর সভাপতি ছিলেন। অনেক ধরনের ব্যবসা তার। তার অনেক বইও আছে। তার প্রশ্ন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি নগদ অর্থ সহায়তা না দেয়, তাহলে যেসব ব্যাংকে নগদ অর্থের অভাব রয়েছে, তারা কীভাবে চলবে? সেসব ব্যাংকের ব্যবসায়ী ও উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত গ্রাহকদের কী হবে?...এ পরিস্থিতিতে হয় নগদ অর্থ দিতে হবে কিংবা তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংক বন্ধ করে দিতে হবে। নয়তো এসব ব্যাংকের গ্রাহকরা সমস্যায় পড়বে। সংকটে পড়া বেশিরভাগ ব্যাংকই দেশের বড় ব্যাংক।’ কী নাম তার? তিনি আর কেউ নন, আব্দুল আউয়াল মিন্টু। এক নামে সবাই তাকে চেনে। কেন তিনি এ প্রশ্ন তুলেছেন? গভর্নর কিছুদিন আগে বলেছেন, টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে আর সহায়তা দেওয়া হবে না। এর সোজা অর্থ-নিজের সমস্যা নিজেকেই সামলাতে হবে। এর আরও অর্থ-লাভ-লোকসান ব্যবসায়ীর, ব্যবসা তার। সেখানে সরকারের কিছু করার নেই।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এসব কথা হচ্ছে কিছুসংখ্যক ব্যাংকের দুর্দশা দেখে। দেশের কয়েকটি ব্যাংক থেকে প্রভাবশালী একজন ব্যবসায়ী সব টাকা তুলে নিয়েছেন। তিনি পলাতক। ওইসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক রদবদল এনেছে। নতুন বোর্ড হয়েছে, নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োজিত হয়েছেন। এসব ব্যাংকে কর্মচারী-কর্মকর্তাদের মধ্যে মারামারি চলছে। রীতিমতো চর দখলের মতো। বঞ্চিত কর্মচারীরা আন্দোলন শুরু করেছেন। এদিকে ব্যাংকে ব্যাংকে তারল্য সংকট। মানে টাকার অভাব। আমানতের প্রবৃদ্ধি ঘটছে না। ওইসব ব্যাংকে আগে ভালো ‘রেমিট্যান্স’ আসত, যা এখন কমে গেছে। ফলে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না তারা। তাদের ‘পে-অর্ডার’, ‘চেক অনার’ হচ্ছে না। গ্রাহকরা পড়েছেন বিপাকে। এদিকে ব্যাংকে ব্যাংকে চলছে নগদ অর্থের টানাটানি। ‘কল মানি মার্কেটে’ টাকার অভাব। অথচ দৈনন্দিন লেনদেনের জন্য মানুষের টাকা দরকার। ব্যবসায়ীদের টাকা দরকার। কিন্তু টাকা তোলার ওপর নিষাধাজ্ঞা জারি হয়েছে। দুই লাখ, তিন লাখ, পাঁচ লাখ পর্যন্ত তোলা যাবে (০৪.০৯.২৪) বলে জানানো হচ্ছে। জনমনে ভীতির সঞ্চার হয়েছে ব্যাংক সম্পর্কে। ব্যাংকে ব্যাংকে লুটপাটের খবর বের হচ্ছে অনেকদিন যাবৎ। তারপরও ব্যাংক চলছিল। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নানা গুজব ছড়ানো হচ্ছে। কে বা কারা এসব করছে, তা অবিলম্বে তলিয়ে দেখা দরকার। হাজার টাকার নোট বাতিল করা হবে বলে আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছিল। আরও নোট বাতিল/বদল হবে বলে নানা খবর চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে। এ সবই অশুভ সংবাদ। এদিকে কোনো একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান একটি খবরের কাগজকে বলেছেন, ব্যাংকে লুটপাট হয়েছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা দিয়েছে। পর্ষদ পুনর্গঠন করায় লুটপাট এখন বন্ধ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তারল্য সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। টাকার সংকটে অনেক শাখা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ সম্পর্কে নানা খবর চাউর হচ্ছে। ছোট, মাঝারি গ্রামীণ ব্যবসায়ীদের দুঃখ-কষ্টের কথা এসবে তুলে ধরা হচ্ছে। চেক অনার হয় না, পে-অর্ডার অনার হয় না, এলসি করা যাচ্ছে না। অথচ নগদ টাকাও নেই। বেচাকেনা স্থবির। এমনকি অনেক ছোট-মাঝারি প্রতিষ্ঠান মাসের প্রথমে কর্মীদের বেতন-ভাতাও দিতে পারছে না।
এই যে চিত্রটি উপরে দিলাম, তার ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ কী? ব্যাকগ্রাউন্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নীতিগত অবস্থান। তার যে অবস্থান, সেটা সঠিক। আমরা বইপত্রে এমনই পড়েছি। ব্যবসা ব্যবসায়ীর, লাভ-লোকসান তার নিজের। এটা এমন নয় যে, লাভ ব্যবসায়ীর আর লোকসান সরকারের। ব্যাংকের ব্যবসাও তাই। ব্যাংক খুলেছে ব্যবসায়ীরা। তাদের কেউ কেউ আমানতকারীদের টাকা নিয়ে নিয়েছে (এমন ঘটনা ১৯৮৫-৯০ সালেও ঘটেছিল, যা বিনা বিচারে শেষ হয়)। গভর্নর সাহেব বলেছেন, এটা ব্যাংক ও আমানতকারীদের বিষয়। যারা ওইসব ব্যাংকে টাকা রেখেছেন, তারা জেনে-বুঝেই রেখেছেন। কেউ কেউ হয়তো বেশি লাভের আশায় রেখেছেন। এখন ব্যাংক টাকা দিতে পারে না। মালিক উধাও। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু করার নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে তাদের সহায়তা করা হবে ক্ষতিকর। মূল্যস্ফীতি ঘটবে। অতএব কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো টাকা-পয়সা দেবে না। আমানত বৃদ্ধি করে অবস্থার উন্নতি করতে হবে। গভর্নর সাহেবের এ অবস্থানকে সমর্থন করা ছাড়া কি গত্যন্তর আছে? পুস্তকি বিদ্যার কোনো বিকল্প নেই। ব্যাংক চলে যেতে পারে ‘অবসায়নে’ (লিকুইডেশনে)। বাকিটা আমানতকারীদের কপাল। তাহলে এখন করণীয়? বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের আবদারের মুখে? মিন্টু সাহেব অন্তত তাই বলছেন যে, সহায়তা দিয়ে ব্যাংকগুলোকে বাঁচানো হোক। এই যে প্রশ্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সামনে, এর উত্তর কী লিখবেন তিনি? আমানতকারীরা বাইরে অপেক্ষমাণ।
অতীতেও কিন্তু এ ধরনের ঘটনা দেশে ঘটেছে। দুর্দশার কারণে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা একীভূত করা হয়েছে। দুটোতেই লুটপাট হয়েছে, প্রচুর খেলাপি ঋণ। এর আগে বিসিসিআই (ব্যাংক অফ ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল) নামের আন্তর্জাতিক একটি ব্যাংকের শাখার (বর্তমানে এর নাম ইস্টার্ন ব্যাংক) বিলুপ্তি ঘটে চুরি-চামারির জন্য। ওই ব্যাংককে পুনর্গঠিত করে ইস্টার্ন ব্যাংক নামকরণ করা হয় এবং করা হয় বেসিক ব্যাংক। আমানতকারীরা টাকা ফেরত পায়নি এমন অভিযোগ শুনিনি। রয়েছে কমার্স ব্যাংক, যা বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক। পদ্মা এখন সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানায়। এ ব্যাংকের আমানতকারীরা কি তাদের আমানতের টাকা হারিয়েছেন? এমন কথা শুনিনি। সরকার উদ্ধার করেছে। রয়েছে বিসিআই (যা ছিল একটি বিনিয়োগ কোম্পানি)। ওখানে কি কেউ টাকা হারিয়েছে? দেশের বাইরেও আমরা যেতে পারি। ২০০৬-০৭ সালের ঘটনা। উৎপত্তিস্থল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পুঁজিবাদের ‘ঠাকুরদাদের’ দেশ, যারা সারা বিশ্বকে নিয়ম-নীতি শেখায়। যারা অর্থব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। আগ্রাসী বাজার অর্থনীতি কী, তা তাদের কাছ থেকে শেখা যায়। সেখানে ‘সাবপ্রাইম’ নামে এক বিরাট সংকট দেখা দেয়, যার রেশ এখনো চলছে। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়। সব ব্যাংক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত ‘ডেরিভেটিভ’ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেরও যায় যায় অবস্থা। এর জের পড়ে ইউরোপীয় দেশগুলোতে। সারা বিশ্ব পড়ে আর্থিক সংকটে। ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কী করা হয় তখন? মার্কিন সরকার বলেছিল-না, আমরা এসবে নেই; যা গেছে তা গেছে; নিজেদের সমস্যা নিজেরা বুঝে নিন। যতদূর মনে পড়ে, তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন বারাক ওবামা। তিনি ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন (এক হাজার বিলিয়ন সমান এক ট্রিলিয়ন) ডলার সাহায্য দিয়ে আর্থিক খাতকে রক্ষা করেছিলেন। শত হোক আমানতকারীদের টাকা। তাদের টাকা নষ্ট হলে আর্থিক খাত থাকবে না। এটা করতে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি সাহায্য করেছিলেন ঝুঁকি নিয়ে।
এ প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সাহেব পরীক্ষার হলে বসেছেন পরীক্ষা দিতে। ‘পুস্তকি বিদ্যা’, নাকি বাস্তবতা-কোনটি তিনি মানবেন? উত্তরটা তিনি শেষ পর্যন্ত কী দেবেন-দেশবাসী তা দেখতে চায়। ইতোমধ্যেই অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছে। গত ২ সেপ্টেম্বর এক খবরে বলা হয়েছে, ‘পোশাক কর্মীদের আগস্টের বেতন-ভাতা পরিশোধ : ব্যাংক থেকে বিশেষ ঋণ পাবেন উদ্যোক্তারা’। এটি হচ্ছে খবরের শিরোনাম। খবরে দেখা যাচ্ছে, এ ঋণের টাকা হবে মেয়াদি ঋণ। গ্রেস পিরিয়ডসহ। কেন এ সিদ্ধান্ত? পোশাকশিল্পের মালিকদের কি টাকা-পয়সার অভাব হয়েছে যে তাদের টাকা দিতে হবে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য? এক মাসের বেতন দেওয়ার মতো টাকা তাদের নেই? যদি তাই হয়, তাহলে কী করে আমরা বলি যে ব্যবসায়ীর ব্যবসা, সরকারের তাতে কিছু করার নেই? পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, প্রয়োজনেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক পোশাকশিল্পের পাশে দাঁড়াচ্ছে। রপ্তানি বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য। লাখ লাখ শ্রমিকের জীবন-জীবিকার জন্য। তাই নয় কি? যদি তাই হয়, তাহলে ব্যাংকের আমানতকারীরা কী দোষ করল? তাদের টাকা তুলতে সাহায্য করতে আপত্তি কোথায়? আপত্তি যদি থাকেই, তাহলে মিন্টু সাহেবের মতে দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে। দেশের অর্থনীতির বর্তমান যে অবস্থা, তাতে কি এ কাজটি সঠিক বলে বিবেচিত হবে? কঠিন এক প্রশ্নের পরীক্ষা। আমরা উত্তরদাতা গভর্নরের খাতা পরীক্ষা করে দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। ‘পুস্তকি বিদ্যা’, নাকি বাস্তবতা-কার জয় হয় এবং তা কীসের বিনিময়ে।
আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি-ব্যবসা অঙ্ক নয়। ব্যবসা মানে ক্লাসে বক্তৃতা দেওয়া নয়। ব্যবসা হচ্ছে ‘অ্যাপ্লায়েড ইকনোমিকস’-‘ইকনোমিকস’ নয়। ‘ব্যবসার প্রশাসন’ ভিন্ন জিনিস। অতএব...।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৩