জীবনে চলার পথে কত রকম মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায়। কারো সাথে শুধু ক্ষনিকের দেখা, কারো সাথে কিছুক্ষণ একসাথে পথ চলা। কেউ আজো স্মৃতিতে উজ্জ্বল, কেউ বিস্মৃতির পর্দা ঠেলে হঠাৎ মুখ বাড়ায়। অনেক কাল আগে দেখা এমন তিনজন মানুষকে মনে করে আজকের পোস্ট।
হিউম্যান কম্পিউটার
তখন শুধু বিটিভি ছিল। একদিন দেখি খবরে এক ছেলের সাক্ষাৎকার দেখাচ্ছে- ছেলেটি নাকি হিউম্যান কম্পিউটার! সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটরের অনেক ফাংশন সে মুখে মুখে করে ফেলতে পারে- যেমন কোন সংখ্যার পজেটিভ এক্সপোনেন্ট টু দি পাওয়ার এগার আর নেগেটিভ এক্সপোনেন্ট টু দি পাওয়ার আট পর্যন্ত, লগ, লন ইত্যাদি সে মাথার মধ্যে হিসাব নিকাশ করতে পারে। ছেলেটি বুয়েটে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর চতুর্থ বর্ষের ছাত্র।
বেশ অবাক করা ঘটনা- তাই ইচ্ছে হলে যাচাই করে দেখবার, সত্যি নাকি বুজরকি! কয়েকদিন পর যাচাই করার সুযোগও পেয়ে গেলাম- পোস্ট অফিসের বারান্দায় তাকে দেখতে পেয়ে বললাম, আমরা তার কেরামতি দেখতে চাই। তিনি রাজি হলেন, আমরা চারজনে ক্যালকুলেটর বের করলাম পরীক্ষা নেবার জন্য। প্রথমে বড় সংখ্যার গুন-ভাগ। আমরা যখন মুখে সংখ্যাটা বলে ক্যালকুলেটর টিপছি, তখন আমাদের হিসেব শেষ হওয়ার আগেই তিনি উত্তর বলে দিচ্ছিলেন- একেবারে সঠিক উত্তর। এরপর শুরু এক্সপোনেন্ট, যত বড়ই হোক না কেন সেগুলো তিনি করতে পারছিলেন, শুধু এবার একটু সময় লাগছিল আর কেমন যেন দাঁত কিড়মিড় করছিলেন। এক সময় আমাদের পরীক্ষা নেয়া শেষ হলো। এতই অবাক হয়েছিলাম যে, কোন ধন্যবাদ টন্যবাদ না দিয়েই আমরা চলে এসেছিলাম। কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না, কি করে ক্যালকুলেটর ছাড়া এই সব হিসাব করা সম্ভব হল!!
এরপর আবার উনি খবর হলেন, এবার পত্রিকার পাতায়। ততদিনে উনি পাস করে বের হয়ে চাকরি করছেন। একদিন দেখি পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বুয়েট কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে যে, উনার বুয়েটের সার্টিফিকেট বাতিল করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে উনি বুয়েটে ভর্তির সময় যে মার্কশীট দিয়েছিলেন তা আসল নয়, সম্ভবত ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রির নাম্বার বাড়িয়ে তিনি জাল মার্কসিট জমা দিয়েছিলেন যাতে ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে পারেন।
মার্কসিট জাল করে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন, কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করে মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন। তাই তার এ পরিনতি দেখে বেশ দুঃখ পেয়েছিলাম। কিন্তু বুয়েট কর্তৃপক্ষ কি করে জানল যে, তার মার্কসিট জাল!?
শুনলাম তার কোন এক "বন্ধু" বুয়েটে জানিয়ে দিয়েছিল মার্কসিট জালের কথা।
এরপর হিউম্যান কম্পিউটারের কোন খবর আর কখনোই জানতে পারি নি।
ছোটবোন
তখন আমরা নানা বাড়ি থাকি। এক সন্ধ্যাবেলায় দুজন অচেনা অতিথি এলেন। আমার বয়সী এক কিশোরী মেয়ে, আর তার বাবা। শুনলাম ওরা আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়, ভারত থেকে এসেছেন, কিন্তু কেন এসেছেন সেটা জানতে পারলাম না। পরদিন সকালে দেখি ওদের সাথে যোগ দিয়েছে এক তরুণ, শুনলাম তরুণটি ওই মেয়েটির ভাই। ভাই, বোন, বাবা তিন জন এক ঘরে বসে সারাদিন কথা বলছিল। আমার খুব কৌতুহল হচ্ছিল, তাই মাঝে মাঝেই গিয়ে দাঁড়াচ্ছিলাম, কিন্তু কোন কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না। জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম মেয়েটি ভাইয়ের দুহাত ধরে অনর্গল কথা বলছে, আর ভাই হাসিমুখে সব শুনছে, মাঝে মাঝে কথা বলছে। বাবা চুপচাপ বসে ভাই-বোনকে দেখছেন।
ভাই কোন সময় চলে গেল জানিনা। পরদিন বাবা আর বোনও বিদায় নিলেন। তারা চলে যাবার পর তাদের সম্পর্কের জানতে পারলাম।
বছর দুয়েক আগে ভাইটি ( তার নাম দিলাম গামা) কলেজে পড়তো; পড়াশোনা খেলাধুলা সব কিছুতেই সে খুব ভালো ছিল। এক হিন্দু ছেলের সাথে কোন কারনে তার ঝগড়া হয়। এরপর থেকে হিন্দু ছেলেটি সবসময় তাকে উত্যক্ত করত। একদিন খেলার সময় কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে গামা ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে হিন্দু ছেলেটাকে মারতে থাকে, মারতে মারতে মেরেই ফেলে! এই হত্যাকাণ্ডের ফলে ছোট শহরটিতে রায়ট বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়। গামার স্বজনেরা তাকে সরিয়ে দেন, একেবারে বর্ডার পার করে বাংলাদেশে। আদালতে বিচার হলে অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে খুনের দায়ে হয়ত তার ফাঁসি হত না, কিন্তু যাকে খুন করেছিল তার স্বজনেরা নাকি গামাকে খুন করে বদলা নিতই।এদের থেকে বাঁচাতেই গামাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের কোথায়, কিভাবে থাকত জানিনা, স্বজনদের সাথে কোন যোগাযোগ ছিল কিনা তাও জানি না। কিভাবে আমার নানার বাসায় সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা হয়েছিল সেটাও জানি না, শুনলাম ছোট বোনটি ভাইয়ের জন্য খুব কান্নাকাটি করত। তাই ভাইকে দেখাবার জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকা স্বত্ত্বেও বাবা তাকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন।
বোনতো দেখে গেল, কিন্তু মা আর অন্য ভাই বোনরা!! তাদের কেমন লাগত যখন বাড়ির সবচেয়ে ছোট কিশোর ছেলেটি খুনের দায়ে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াতো! কখনোই জানতে পারি নি। সতের আঠারো বছর বয়সে একটা ছেলে মা, আত্মীয় পরিজন হীন অচেনা দেশে কি করে থাকতো জানিনা।
বছরখানেক পর একদিন খবর এলো, গামা মারা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়, সে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে যাচ্ছিল। যখন মৃত্যুর খবর এলো ততক্ষণে অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবে তার লাশ নারায়ণগঞ্জে দাফন হয়ে গেছে। সবাই বললো ভালোই হয়েছে, এভাবে বেঁচে থাকার কোনও অর্থই হয় না। মৃত্যুকে এড়াতে সে পালিয়ে এসেছিল। এড়াতে পারল কই?
ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে ছোট বোনটি কি করেছিল? সে কি আকুল হয়ে ভাইয়ের জন্য কেঁদেছিল?
মদ্যপ
ডাল-ভাতের মতো করে, কিংবা ডাল ভাত খাওয়ার সাথে সাথে কেউ মদ খেতে পারে, এই জিনিস আমার কখনো দেখা ছিল না। দেখলাম দুবাইতে, এক ভদ্রলোকের বাসায়। তিনি ক্রমাগত মদ খাচ্ছিলেন, কিন্তু তা সত্বেও তিনি স্বাভাবিক আচরণ করছিলেন। বউ ছেলে মেয়েরাও তার এই মদ খাবার স্বভাবটাকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলেন। ভদ্রলোক ব্যাংকে উচ্চপদে চাকরি করতেন। ধরা যাক তার নাম আলফা। আলফা সাহেবের বাসায় নানারকম মদ রাখা ছিল। আমার স্তম্ভিত, বিস্মিত চোখের সামনে তিনি মদ খেয়েই যাচ্ছিলেন- কথা বলতে বলতে, হাঁটতে হাঁটতে, এমনকি যখন টেবিলে বসে ভাত খাচ্ছিলেন তখনো একই সাথে মদও খাচ্ছিলেন।
আলফা সাহেবের বাসায় বসার ঘর ছিল সুসজ্জিত, সেখানে অনেক কিছুর মধ্যে দেয়ালে ফ্রেম করা একটা সার্টিফিকেট ঝুলছিল- সার্টিফিকেটের উপর লেখা Drunker's certificate, মদ্যপের প্রত্যায়নপত্র। মদ খাবার জন্য নাকি দুবাইতে এই সার্টিফিকেট নিয়ে রাখতে হয়- কোন কর্তৃপক্ষ এমন সার্টিফিকেট দেয় তা জানা হয় নি অবশ্য! এই সার্টিফিকেটের পাশাপাশি দেয়ালে ফ্রেম করে এই বাক্যটি ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল
"In order to prevent hang over he prefers always to be drunk."
তার অর্থ কি, তিনি যতক্ষণ জেগে থাকেন ততক্ষণ মদ খেতে থাকেন?
আলফা সাহেবকে ওই একদিনই কয়েক ঘণ্টার জন্য দেখেছিলাম। কিন্তু এখনো যখন কারো নেশার কথা শুনি তখন মাঝে মাঝেই আলফা সাহেবকে মনে পড়ে- খুব জানতে ইচ্ছে করে আলফা সাহেব কি আগের মতোই মদ্যপ রয়ে গেছেন!!!
নাকি মদ তাকে খেয়ে ফেলেছে!!!
==================================================================================
==================================================================================
পিছনে ফিরে তাকালে এমন কত মানুষের কথা মনে পড়ে। তাদের সম্পর্কে কিছু জানার কোন উপায়ই জানা নেই!!!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৫:১২