হারূন সাহেব, সাদ সাহেব, আর আফসার সাহেবের বন্ধুত্ব সেই মফস্বলের স্কুল জীবন থেকে। প্রথম দুজন চাকরি উপলক্ষে নানা জায়গা ঘুরে অবশেষে অবসর নিয়ে থিতু হয়েছেন তাদের সেই মফস্বল শহরেই; আফসার সাহেব বরাবরই এই মফস্বল শহরের বাসিন্দা ছিলেন। বি এ পাশ করেই পৈত্রিক ব্যবসায় লেগে গিয়ে পরিশ্রম আর বুদ্ধি দুটোই পুরোপুরি ব্যবসায় ঢেলে দেবার ফলে আজ তিনি শহরের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী, অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তিনজনেরই ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন, সবাই দেশে-বিদেশের নানা শহরে নিজেদের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। হারুন সাহেবের স্ত্রী গত হয়েছেন এক বছর আগে।
হারূন সাহেব আর সাদ সাহেবের মত আফসার সাহেবের অখন্ড অবসর নেই, তবুও বিকেলের পর থেকে তিনি আর কোন কাজ রাখেন না। তিন বন্ধু মিলে প্রতিদিন সন্ধ্যা হতেই আফসার সাহেবের বাড়িতে আড্ডা বসান, মনে হয় কৈশোরের দিনগুলো আবার তাদের জীবনে ফিরে এসেছে। আলোচনার বিষয়বস্তুর কোন ঠিক থাকে না, যেকোনো বিষয়েই তারা কথার পর কথা বলেই চলেন। একদিন এমনি কথা বলতে বলতে সাদ সাহেব বললেন, "একজন সুস্থ মানুষ একটাও কথা না বলে বড়জোর এক সপ্তাহ কাটাতে পারে।" দ্বিমত পোষণ করলেন আফসার সাহেব। বললেন, "একটা সুস্থ মানুষকে নানা প্রয়োজনে কথা বলতেই হয়, বড়জোর তিন দিন কথা না বলে একজন মানুষ কাটাতে পারে!"
হারুন সাহেব এতক্ষণ চুপচাপ বসে কথা শুনছিলেন। এবার তিনি কথা বললেন, "আমি কথা না বলে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতে পারব"। "কি বললি! বছরের পর বছর!!" হো হো করে হেসে উঠলেন আফসার সাহেব। "তিন মাস কথা না বলে দেখ্, একেবারে পাগল হয়ে যাবি। আরে গল্পগাছা না করলি, কিন্তু দরকারি কথা না বলে থাকবি কি করে!!" সাদ সাহেবও আফসার সাহেবকে সমর্থন দিলেন, কিন্তু দেখা গেল হারুন সাহেব তার মতে অনড় রইলেন। তর্কাতর্কি করতে করতে একসময় হারুন সাহেব বললেন, তিনি ১২ বছর কথা না বলে কাটাতে পারবেন; যদি এই দীর্ঘ সময় তিনি পড়ার জন্য পছন্দমত বইয়ের যোগান পান, খাবার- পোষাক এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস তিনি কাগজে লিখে দিলে কেউ যদি সেসব তাকে সরবরাহ করে, তবেই। এবার আফসার সাহেব রেগে গেলেন। বললেন, "আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি বাজি রাখছি, তোর যা দরকার তুই কাগজে লিখে জানালেই আমি তোকে পৌঁছে দেব, তবু তুই ১২ বছর কথা না বলে থাকতে পারবি না। যদি পারিস, তবে আমার সমস্ত সম্পত্তি তোর; আর যদি না পারিস, তাহলে বাকি জীবন তুই আমার সব কথা মেনে চলবি।"
উপরে লেখা গল্পটা আমি পড়িনি, লেখক কে তাও জানি না। এর নাট্যরূপ দেখেছিলাম অনেক দিন আগে, যখন বিটিভিতে প্রতি সপ্তাহে একদিন বিশ্বসাহিত্যের সেরা গল্পের নাট্যরূপ দেখানো হতো। এই নাটকে যতদূর মনে পড়ে হারুন সাহেব চরিত্রে আব্দুল্লাহ আল মামুন, আর সাদ সাহেব আর আফসার সাহেবের চরিত্রে সৈয়দ আহসান আলী সিডনী আর গোলাম মোস্তফা ছিলেন।
নাটকের গল্পটা শেষ করি... হারুন সাহেব শর্ত মেনে নিলেন। ঠিক হলো, আফসার সাহেবের বাগানের কোনে যে একটি ঘর আছে, সেই ঘরে হারুন সাহেব থাকবেন। ঘরে দরজা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ থাকবে। একটি মাত্র জানালা বন্ধ থাকবে, জানালার নিচের অংশ দিয়ে তিন বেলা হারুন সাহেব কে খাবার দেয়া হবে, যে খাবার নিয়ে যাবে তাকে কাগজে লিখে হারুন সাহেব তার প্রয়োজন জানাবেন। আফসার সাহেব এতই সিরিয়াস হয়ে গেলেন যে, তিনি তার উকিলকে ডেকে একেবারে কাগজপত্র তৈরি করে নিলেন এইসব শর্ত উল্লেখ করে, সাদ সাহেবকে হলেন সাক্ষী। ঘর বই দিয়ে বোঝাই করতে দুদিন সময় নেয়া হলো। ৬ই মে রাত বারোটায় হারুন সাহেব ঘরে ঢুকলেন, দরজায় তালা দেওয়া হলো, ১২ বছর পরে ৬ মে রাত ১২ টায় দেখা যাবে হারুন সাহেব তার শর্ত পূরণ করতে পারলেন কিনা।
এক বছর কেটে গেল, দু'বছর, তারপর তিন বছর। এবার আফসার সাহেব একটু চিন্তিত হলেন, বদ্ধ ঘরের ভেতর হারুন সাহেব পাগল টাগল হয়ে যাননি তো! যে লোকটি খাবার দেয়, সে জানিয়েছে হারুন সাহেব নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবার খাচ্ছেন, শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন। তিন বছর পরে হারুন সাহেব প্রথমবার চিরকুট দিলেন লোকটির হাতে, অনেকগুলি বইয়ের লিস্ট। আফসার সাহেব বই গুলো আনিয়ে দিলেন। কিছুদিন বাদেই আবার লিস্ট, আফসার সাহেব সেগুলো আনিয়ে দিলেন। তারপর ক্রমাগত বই আনানো, এত সমস্ত বইয়ের কথা হারুন সাহেব কিভাবে জানেন কে জানে!! কোনো কোনো বই বিদেশ থেকে আনিয়ে দেয়া লাগল, তাতে আফসার সাহেবের কোন অসুবিধা নেই, তার এত অঢেল সম্পদ আছে যে, বই কিনে দেউলিয়া হবার কোন চান্সই নেই! সান্ধ্যকালীন আড্ডা এখন আর তেমন জমে না, তিনি আর সাদ সাহেব বসে বসে হারুন সাহেবের কথা আলোচনা করেন। প্রথম কয়েক বছর আফসার সাহেব হারুন সাহেবের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হতেন, কিন্তু ৭-৮ বছর কেটে যাবার তিনি নিজের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হতে লাগলেন- হারুন সাহেব যদি সত্যিই এভাবে কথা না বলে কাটিয়ে দেন তাহলে শর্ত অনুযায়ী তার সমস্ত সম্পদ হারুন সাহেব কে দিয়ে দিতে হবে! তিনি দিনরাত ভাবতে লাগলেন হারুন সাহেব কে কিভাবে কথা বলানো যায়। একদিন হারুন সাহেবের ঘরে গেলেন; বললেন, "একটা বন্ধ ঘরে বসে জীবনটা শেষ করে দিস্ না, বাইরে বের
দেখ পৃথিবীটা কত সুন্দর! আবার আমরা আগের মত আড্ডা দেই!" হারুন সাহেব মৃদু হাসেন। আবার কয়দিন যায়, আরো অস্থির হয়ে আফসার সাহেব হারুন সাহেবকে বোঝাতে যান; বলেন, "এত বছর কথা না বলতে বলতে হয়তো তোর স্বরতন্ত্রী নষ্ট হয়ে গেছে, আমার সাথে সাথে কথা বলার চেষ্টা করে স্বরতন্ত্রী ঠিক করে নে।" হারুন সাহেব মৃদু হাসেন। এভাবে ১১ বছর কেটে যাবার পর আফসার সাহেব উদ্বেগে যেন পাগল হয়ে গেলেন, প্রতিদিন তিনি একবার করে হারুন সাহেবের জানালায় গিয়ে কখনো কাকুতি মিনতি, কখনো গালাগালি করেন, কিন্তু হারুন সাহেব একটি শব্দও উচ্চারণ করেন না!
অবশেষে আবার এলো ৬ মে, শর্ত অনুযায়ী রাত ১২ টায় আফসার সাহেবের সমস্ত সম্পত্তির মালিক হবেন হারুন সাহেব। উকিল, সাদ সাহেব, এবং কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ আফসার সাহেব জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। জানালা বরাবর দেয়াল ঘড়িতে দেখা যাচ্ছে, বারোটা বাজতে পনের মিনিট বাকি। আফসার সাহেব শেষ চেষ্টা করলেন, "হারুন একবার কথা বল্! কথা দিচ্ছি আমার সব সম্পত্তি দিয়ে দেব, শুধু আমাকে থাকবার জন্য বাড়িটা দিস।"
হারুন সাহেব নির্বিকার বসে রইলেন। দেয়াল ঘড়িতে সময় এগোচ্ছিল, আর টিভির সামনে বসা আমাদের উদ্বেগ বাড়ছিল। বারোটা বাজতে যখন এক মিনিট বাকি, তখন হাসিমুখে কথা বলে উঠলেন হারুন সাহেব, "ভয় পাস নে আফসার, তোর সম্পত্তি তোরই থাকছে..." তিন জন হতভম্ব মানুষের সামনে হাসিমুখে হারুন সাহেব কথা বলে চললেন,
"১২ বছরে আমি কয়েক হাজার বই পড়েছি, নানা ধরনের বই! এই বইয়ের মধ্যে দিয়ে আমি দেখেছি মানব সভ্যতার সূচনা, মনুষ্যত্বের অবমাননা, মানুষের আনন্দ- দুঃখ- যন্ত্রণা; আমি পাড়ি দিয়েছি কত সাগর মহাসাগর, বন্ধুর গিরিপথ, শষ্যভরা প্রান্তর। আমি হেঁটেছি কত পথে... সক্রেটিসের শিষ্য হয়ে, মার্কো পোলোর সঙ্গী হয়ে, কুবলাই খানের বাহিনীর সাথে। আমি কেবল খুঁজে বেড়িয়েছি জীবনের সার-সত্যকে। সবশেষে পেয়েছি সেই সত্য- 'ফাবি আইয়্যি আলাই রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান, অতএব তোমরা উভয়ে তোমার প্রভুর কোন্ অনুগ্রহ অস্বীকার করবে'... কোন সম্পদের আমার আর প্রয়োজন নেই!"
এখানেই নাটক শেষ, চার জন অভিনেতার মুখের চার রকম অভিব্যক্তি দেখিয়ে!
অনেকদিন আগে নাটকটি দেখেছিলাম, তাই সংলাপগুলো হুবহু মনে নেই কিন্তু সুরা আর রাহমান এর আয়াতের উল্লেখ মনে আছে। বই আমার সব সময়ের প্রিয় সঙ্গী, কিন্তু এই নাটকটা দেখার পর থেকে বই পড়া আমার আরো বেশি প্রিয় হয়ে উঠল। খিদে মুখে যেমন খাবারের বাছবিচার থাকে না, তেমনি বই পড়ার ব্যাপারেও আমার কোন বাছবিচার ছিল না; দেশি-বিদেশি সাহিত্য পড়তেই থাকতাম, বিদেশি মানে অবশ্য অনুবাদ। বয়স যখন ১০/১২ বছর তখন হাতে এল কিরোর ভাগ্য গণনার বই; কিরোর বইয়ে হাতের রেখার ছবি দেখে নিজের ভাগ্য গণনা শুরু করলাম। আমার জীবন রেখায় একটা ফাটল ছিল, গণনা অনুযায়ী এর অর্থ ২০ বছরের আগেই আমি মারা যাব! খুবই দুঃখ নিয়ে স্থির করলাম, স্কুলের পড়াশোনা ছেড়ে দেব। তা অবশ্য শেষ পর্যন্ত আর করিনি!
বই পড়ে কখনো বোকাও বনেছি। স্কুলের এক বন্ধু একটা বই দিয়েছিল, "চালাক হবার পয়লা কেতাব", এক দিনের মধ্যে পড়ে ফেরত দিতে হবে। অনেকেই নাকি বইটার জন্য লাইন দিয়ে রেখেছে। খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করে দেখি হাবিজাবি, অর্থহীন লেখা। বইয়ের শেষ বাক্য ছিল, "বই পড়ে চালাক হওয়া যায় না রে বোকা!!"
আরেকবার বোকা বনে ছিলাম; বেলী রোডের একটা নামকরা বইয়ের দোকানের বেশ উঁচু তাকে একটা বই দেখলাম, "God created the integers", স্টিফেন হকিং এর লেখা। বইটার শিরোনাম দেখে খুব অবাক হলাম, স্টিফেন হকিং শেষ পর্যন্ত তাহলে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করলেন! পাতলা সেলোফেন মোড়া বইটাতে কি লেখা আছে দেখতে পারছিলাম না, দামটাও বেশ বেশি। একটু দোনামোনা করে বইটা কিনেই ফেললাম। বাসায় এসে সেলোফেন খুলে দেখি বইতে ঈশ্বর নিয়ে কোন কথা নেই, আছে শুধু গণিতবিদদের জীবনী আর তাদের দুর্বোধ্য গণিত! প্রায় বারোশো পৃষ্ঠার বইয়ের বিশ পৃষ্ঠাও পড়ে বুঝতে পারিনি!! স্টিফেন হকিং এত হাবিজাবি বই লিখতে পারেন- অবিশ্বাস্য!
হাবিজাবি বই অবশ্য অনেক পড়েছি। যখনই কোন বই ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করা হতো, তখনই সেটা যেভাবেই হোক জোগাড় করে পড়তাম। এইভাবে হুমায়ুন আজাদের নারী আর তসলিমা নাসরিনের কি কি সব বই পড়েছিলাম; পরে বুঝেছি এগুলো সাহিত্য হিসেবে লেখা হয়নি, ইসলাম ধর্মকে বিকৃত করে দেখানোর জন্য হাবিজাবি লেখা হয়েছে। অনেকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সালমান রুশদীর নিষিদ্ধ বই স্যাটানিক ভার্সেস পড়ে শেষ করতে পারিনি! গল্পের তাল মাথা নেই, সংলাপগুলো হিন্দি ইংরেজি মেশানো, মিথ্যায় ভরা- এটা ডাস্টবিনে ফেলে দেবার মত বই!
আজকাল আর তেমন একটা বই পড়া হয়না। সামু ব্লগের পোস্ট পড়ালেখা করতে করতেই সময় কেটে যায়। বই পড়া নাকি ব্লগ পড়া- কোনটা ভালো! পরের পড়াটাই যে বেশি ভালো লাগে!!!
ছবি: অন্তর্জাল থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১৯ দুপুর ১২:১২