বাংলাদেশে সবচেয়ে হট টপিক কোনটা? আজ পর্যন্ত যতো কথা শুনেছি বা দেখেছি তার মধ্যে ভারতের বাংলাদেশ দখল করা প্রসঙ্গ দেখলাম সবচেয়ে বেশী উত্তাপ ছড়ায়। আর হবেই বা না কেন!! সামরিক শক্তিধর ভারত আর যাই হোক “মালাউনের দেশ”, জাতে “হিন্দু”, “মুসলমানের শত্রু” আর “মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন চালায়” আর কথায় কথায় যেভাবে বাংলাদেশ দখলের হুমকি দেয় তাতে করে সে কবে বাংলাদেশ দখল করবে সেটাই হল কথা।
এমন কথা সেই ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি।
সন্দেহ নেই একদিকে ভারত যেমন আগ্রাসী মনোভাব দেখাতে পছন্দ করে তার সব প্রতিবেশী দেশগুলো সম্পর্কে সেখানে একদিক দিয়ে তার আশেপাশের কোনও দেশই যেমন তার ওপর সন্তুষ্ট থাকতে পারেনা বা আশঙ্কামুক্ত থাকতে পারেনা, তেমনি তার অতীত ইতিহাস বিশেষ করে তারা যেভাবে একে একে কাশ্মীর থেকে শুরু করে সিকিম, হায়দারাবাদ আর সাবেক পর্তুগীজ কলোনিগুলো (যেমন গোয়া) যেভাবে দখল করে নিয়েছিলো তাতে করে এই সম্ভাবনার পালে সব সময়ই জোর বাতাস বয়ে বেড়ায়। তাছাড়া সম্প্রতি গণ অভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া আওয়ামী লীগ এর বিগত ১৫ বছর বাংলাদেশের সাথে তাদের সামগ্রিক আচরণ, বিশেষত তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে শুরু করে লাগাতার সীমান্ত হত্যা, নদ নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখা আর সময় সময় ভারতের বিভিন্নজনের ঔদ্ধত্য, দাম্ভিক কথাবার্তা আর উস্কানিমূলক বক্তব্য সব সময়ই এদেশের মানুষকে এই আশঙ্কায় আশঙ্কিত করে এসেছে বারবার।
তাছাড়া ঐতিহাসিকভাবে সাম্প্রদায়িক মনোভাব এই আশঙ্কার পালে সব সময়ই জোর হাওয়া বইয়েছে।
কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন একটাই – ভারত কি সত্যিই বাংলাদেশ দখল করবে?
শুরুতেই বলে রাখি, ভারত বাংলাদেশ আক্রমণ করে দখল করবে - বিপুল জনপ্রিয় এই বিতর্কের মধ্যে যেটা পপুলার অপিনিয়ন আমি তার সাথে দ্বিমত পোষণ করি।
কেন করি?
বলছি এবার।
প্রথম কথা হচ্ছে - ভোটের রাজনীতি। দেখুন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ কোনটা জানেন? এদেশের বিপুল পরিমাণ মুসলিম জনসংখ্যা। এদেশের ১৭-১৮ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১৫ কোটি জনসংখ্যাই তো মুসলমান। ধরেন ভারত বাংলাদেশ দখল করে নিলো। এখন এই বিশাল জনসংখ্যা কিন্তু টেকনিক্যালি ভারতের রাজনীতিতে ভোটের প্রভাব ফেলবে বিশাল রকমের।বিশেষত এই বিশাল জনসংখ্যার ১৫ কোটি মুসলমান কিন্তু কখনোই ভারতের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিজেপিকে বরদাশ্ত করবে না। অর্থাৎ ভারত কষ্ট করে বাংলাদেশ দখল করলেও তার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিজেপি কিন্তু তার সুফল মোটেই পাবেনা। কোনোদিক দিয়েই না। কংগ্রেস হয়তো সেটা চাইতে পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে যেখানে দেশের এতো বিপুলসঙ্খ্যক মানুষ ভারত বিরোধী সেখানে ভারত যদি ধরুন তার শক্তি খাটিয়ে বাংলাদেশ দখল করেও ফেলে তাতেও কিন্তু তারা এখানে কোনও বলার মতো সুবিধা করতে পারবে না। অর্থাৎ দিনশেষে রাজনৈতিকভাবে ভারতের বিশেষ কোনও প্রাপ্তি ঘটবে না। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে এক কাশ্মীর এর কথা বাদ দিলে বাদবাকি যেসমস্ত দেশ ভারত দখল করেছে (যেমন সিকিম, গোয়া) এগুলো কিন্তু মুসলিম অধ্যুষিত নয় সেটা খুব ভালো করেই জানেন। যার কারণে এক কাশ্মীর ছাড়া এসব দখল করা জায়গায় ভারতের এই ভোটের রাজনীতি, বিশেষত বিজেপির রাজনীতি কোনও ক্ষতির মুখে পড়ছে না। কারণ ধর্ম এখানে বেশ বড় একটা ফ্যাক্টর। আর তাছাড়া কাশ্মীরের মুসলিম জনসংখ্যা আর বাংলাদেশের মুসলিম জনসংখ্যার পার্থক্য উপেক্ষা করার মতো নয়। কাশ্মীরের মুসলিম জনসংখ্যা বাংলাদেশের মুসলিম জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম। যেকারনে ভারত কাশ্মীরকে পায়ের নীচে দাবিয়ে রাখতে পারলেও বিশাল মুসলিম জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশকে দখল করে দাবিয়ে রাখতে পারবেনা।
আর তাছাড়া কাশ্মীর ছাড়াও, ভারত যখন ৪৭ এর পরে হায়দরাবাদ দখল করেছিলো সেখানেও কিন্তু হায়দরাবাদের মুসলিম জনসংখ্যা কিন্তু খুব একটা আহামরি ছিল না।
সিকিম যখন দখল করেছিলো ভারত, সিকিম কিন্তু মোটেই মুসলিম অধ্যুষিত কোনও দেশ ছিল না সেসময়, আজও নেই।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে – বাংলাদেশের ঘাড়ে জমা থাকা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ। ভারত যদি কখনো বাংলাদেশ দখলই করে নেয় তাহলে বাংলাদেশের ঘাড়ে জমা হওয়া বিশাল পরিমাণ ঋণের বোঝা কিন্তু তখন ভারতের ঘাড়ে পড়বে!! এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘাড়ে জমা হওয়া বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৫.৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর বর্তমানে ২০২৩-২৪ সাল নাগাদ সেটা ছাড়িয়ে গেছে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশী!! সংখ্যাটা গুণে দেখুন!! এখন বলুন, ভারতের বাংলাদেশ দখল তত্বের ওপর পি এইচ ডি ডিগ্রীধারীরা, চিরকাল লাভের গুড় খাওয়া ভারত কি এই এতোটা ঋণগ্রস্থ বাংলাদেশ দখল করে নিজের কাঁধে বোঝা বাড়াবে? যেখানে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব সুবিধার নয়!! প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ভারতের আগ্রাসী হাত যখন কেড়ে নিয়েছিলো কাশ্মীরকে তখন কিন্তু কাশ্মীরের ঘাড়ে মোটেই এতো বিশাল ঋণের বোঝা ছিল না। এতো বড় ঋণের বোঝা ছিল না সিকিমের ঘাড়েও। এতো বেশী ঋণের বোঝা ছিল না হায়দরাবাদ বা গোয়ার ক্ষেত্রেও। যে কারণে ওদের বেশ আরামসেই গিলে খেতে পেরেছে ভারত। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অবস্থা অনেক পার্থক্যপূর্ণ, প্রায় আকাশ পাতাল।
তৃতীয় কথা হচ্ছে – আলাদা দেশ হবার কারণে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ভ্রমণ করার সময় কিন্তু ভারতকে ট্র্যাভেল ট্যাক্স দিতে হয়। তাছাড়া এর সাথে আনুষঙ্গিক অনেক খরচ বাংলাদেশীরা ভারতে গিয়ে করে, হোক সেটা মেডিক্যাল খাতে বা শিক্ষা খাতে বা শুধুই ভ্রমণের খাতে। অংকের হিসাবে সেগুলো কয়েক বিলিয়ন ডলার। এখন তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম যে ভারত বাংলাদেশকে দখলই করলো। তাহলে কি চিরকাল লাভের গুড় খাওয়া ভারতের আমাদের দেশ থেকে এসব খাতে এভাবে এতো টাকা যাওয়ার কোনও সুযোগ থাকে? বুঝে দেখুন এসব ব্যাপার।
চতুর্থ কথা হচ্ছে – ভারতের যদি সত্যিই বাংলাদেশ দখলের কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থেকে থাকতো তাহলে বাংলাদেশের চারদিকে সীমান্তে এতো মিলিয়ন ডলার খরচ করে ইলেকট্রিক কাঁটাতারের বেড়া দাঁড় করাতো না। যেদেশের জনসংখ্যা তাকে কাল বা পরশু হোক তার নিজের মধ্যে নিতে হবে তাদেরকে আটকানোর জন্য আজ সে এতো টাকা খরচ করে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া যে তৈরি করবে না সেটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না।
তো তাহলে?
তাহলে কেন বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের এতো মাথাব্যাথা ?
কারণ, বাংলাদেশের বিশাল মার্কেট আর ভারতের নিরাপত্তা (ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে)।
বাংলাদেশের ১৭/১৮ কোটি জনসংখ্যার বিশাল যে একটা বাজার আছে সেটা যে কোনও দেশের পক্ষেই লোভনীয়। চিরকাল লাভের গুড় খাওয়া ভারত এই বাজার কোনোভাবেই হারাতে চাইবে না এটা খুবই স্বাভাবিক। দেশের বাজারের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখুন একবার চিত্রটা। আর বিশদ ব্যাখ্যায় গেলাম না।
দ্বিতীয় ব্যাপার হচ্ছে ভারতের সেভেন সিস্টার্সের নিরাপত্তা (ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে)। ভারতের সেভেন সিস্টার্সের রাজ্যগুলো যে ভারতের সাথে থাকতে চায়না সেটা কে না জানে। এসব রাজ্যে বিশেষ করে আসামের উলফা ভারতকে ভীষণ চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো। উলফার নেতারা যে বিগত বি এন পি সরকারের আমলে (বিশেষ করে ২০০৩-০৪ এর দিকে) যে বাংলাদেশের কাছ থেকে বিশেষ খাতির পেয়েছিলো সেটাও আজ অজানা কোনও বিষয় নয়। যে ১০ ট্রাক অস্ত্র সেসময় ধরা খেয়েছিল যতদূর জানি সেটা মূলত বাংলাদেশে এসেছিলো এই উলফাদের হাতে চলে যাওয়ার জন্যই। সেটা যদি সত্যিই তাদের হাতে যেতো তাহলে খবর ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর।
এসব কারণে ভারত ভীষণ মরিয়া হয়ে উঠেছিলো বাংলাদেশে তাদের বিশ্বস্ত এজেন্টদের ক্ষমতায় বাসানোর জন্য এবং আজীবন ক্ষমতায় বসিয়ে রাখার জন্য। এখন এই জায়গায় আওয়ামী লীগ এর চেয়ে আর কে তাদের সেরা অপশন হতে পারে?
ভারত বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থেই আক্রমণ করে দখল করবে এমন সম্ভাবনা আসলে অনেক কম। তা ভারতীয়রা আর তাদের মিডিয়া যতোই হুমকি ধামকি দিক । ভারত যেটা চায় সেটা হল বাংলাদেশের সমস্ত কিছুর ওপর পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণ। একেবারে একচ্ছত্র একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। তারা যা বলবে বাংলাদেশ শুধুমাত্র সেভাবেই যেন চলে সে ব্যবস্থা।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য আমেরিকা যে ইরাকে হামলা চালিয়েছে বা আফঘানিস্তানে হামলা চালিয়েছে এসব করে কিন্তু আমেরিকা সেসব দেশকে দখল করে নিজেদের অংশ বানিয়ে নেয় নি কখনোই। তারা যেটা করেছে সেটা হল হামলা চালিয়ে সেসব দেশের সরকার উৎখাত করে নিজেদের পুতুল সরকার ক্ষমতায় বসিয়ে গেছে।
ভারত যে হামলা চালানোর কথা বলছে, এই হামলা যদি সত্যিই তারা করে তাহলেও তারা বাংলাদেশকে ভারতের অংশ করে নেবে এমন সম্ভাবনা কম। বরং ভারত চাইবে বাংলাদেশে হামলা চালিয়ে বাংলাদেশের সামরিক শক্তিসহ অন্যান্য শক্তিকেন্দ্রগুলো ধংস করে আবারো তাদের বিশ্বস্ত এজেন্টদের বা তাদের অনুগত পুতুল সরকারকে (যেমন আওয়ামী লীগ) পাকাপাকিভাবে বাংলাদেশের ক্ষমতায় বসিয়ে যেতে, যারা সব ক্ষেত্রেই ভারতের স্বার্থকে সংরক্ষণ করবে, প্রোটেকশন দেবে। যেটা আমেরিকা ইরাকে বা আফগানিস্তানে করেছিলো।
ভারত চায় বাংলাদেশ আজীবন তাদের করদরাজ্য হয়ে থাক। ভারতের একান্ত অনুগত সেবাদাস হয়ে থাকুক। এটা করার জন্য ভারত ছলে, বলে কৌশলে সব রকমের প্রচেষ্টাই করবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২