প্রবাস জীবনটা খুব আনন্দময় কিছু না। আমি দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসী। এই দেশে কাজ করলে টাকা আছে। সেই টাকা দিয়ে বিলাসিতা করা যায়। কিন্তু বিলাসিতা জীবন আমার পছন্দ না। তবে আমি একটা গাড়ি কিনেছি। গাড়ি ছাড়া এই দেশে চলা অসম্ভব। অবশ্য আমেরিকাতে সব প্রবাসীর অন্তত একটা গাড়ি আছে। কারো কারো একাধিক গাড়ি। গাড়ির তুলনায় প্রবাসীদের বাড়ি কম। বেশির ভাগই ভাড়া থাকে। প্রবাসে আমার কষ্ট একটাই দেশের কথা খুব মনে পড়ে। যখন কাজে থাকি তখন কিছু মনে আসে না। রাতের বেলায় বিছানায় নিজ দেশের কথা গুলো, সৃতি গুলো বুকের মধ্যে চেপে বসে। বড় কষ্ট হয়। বড় যন্ত্রনা হয়।
কিছুদিন ধরে খাজা ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছে। খাজা ভাইয়ের বয়স আমার বাবার চেয়ে বেশি। কিন্তু খাজা ভাই খুব কঠিন করে বলে দিয়েছেন- আমাকে চাচা ডাকবে না। ভাই বলে ডাকবে। খাজা ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় ঢাকার গুলিস্তানে। তখন ঢাকায় নতুন এসেছি। নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়েছি। থাকি পুরান ঢাকার আগামসি লেনের এক সস্তার মেসে। আগামসি লেন থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত হেঁটে আসতাম। একদিন গুলিস্তানে আমার পকেটমার হয়। সারা মাসের খরচ ছিলো ম্যানিব্যাগে। সারা মাস কি করে চলবো এই চিন্তায় আমি অস্থির। তাছাড়া মেছের ভাড়াও দেওয়া হয়নি। প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে গোলাপ শাহ মাজারের সামনে বসে ছিলাম।
চারিদিকে গাড়ি বাসের বিকট শব্দ। অথচ কোনো শব্দই আমাকে স্পর্শ করছিলো না। সারা মাসের খরচের টাকা পকেটমার হয়েছে। এখন কি করবো? এই চিন্তায় আমার গলা বুক শুকিয়ে এসেছিলো। এমন সময় খাজা ভাই আমার পাশে বসে বললেন- তোমার পকেটমার হয়েছে নিশ্চয়? আমি খাজা ভাইয়ের দিকে ভালো করে তাকালাম। সাদা পাঞ্জাবী আর সাদা লুঙ্গি পড়া একজন বয়স্ক মানুষ। মাথার চুল সাদা। গাল ভরতি সাদা দাঁড়ি। চোখে সুরমা দিয়েছেন। খাজা ভাই বললেন, আমি ইচ্ছা করলে তোমার ম্যানিব্যাগ খুঁজে দিতে পারি। কিন্তু আমি তা করবো না। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় তোমার দাওয়াত। ঐ দেখো রাস্তার ডান পাশে খিচুরী রান্না হচ্ছে। সবজি খিচুরী।
খাজা ভাই গুলিস্তান এলাকার একজন লিডার। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে গুলিস্তান আছেন। এই এলাকার মানুষজন তাকে সবাই চিনে, জানে, সমীহ করে। গুলিস্তান এলাকার অবৈধ বিদ্যুতেই লাইন দেয় খাজা ভাই। এই কাজ করে সে মাসে মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করেন। খাজা ভাই প্রতি সপ্তাহে গোলাপ শাহ মাজারের কাছে তিন ডেক খুচুরী রান্না করেন। গরীব দুঃখীদের খাওয়ান। এমন কি প্রতি মাসে অসহায় গরীব মানুষদের শাড়ি লুঙ্গি দেন। গুলিস্তান এলাকার ব্যবসায়ীরা খাজা ভাইকে তোয়াজ করেই চলেন। আমার ঢাকার জীবনে যতবার বিপদে পড়েছি, খাজা ভাইয়ের সাহায্য পেয়েছি। তিনি আমার কাছে ফেরেশতার মতোন মানুষ।
আমার বান্ধবী লিন্ডা। ছুটির দিন গুলো আমি তার সাথেই কাটাই। একদিন লিন্ডাকে খাজা ভাইয়ের কথা বললাম। লিন্ডা প্রচন্ড অবাক হলো- খাজা ভাইয়ের কথা জেনে। বলল, সে গোপাল শাহ মাজারের খিচুরী খাবে। লিন্ডা খাজা ভাইয়ের ছবি দেখতে চাইলো। আমার কাছে খাজা ভাইয়ের কোনো ছবি নেই। লিন্ডা বলল, যাকে তুমি এত পছন্দ করো, তার ছবি তোমার কাছে থাকবে না কেন? আমি বললাম, যখন আমি বিদেশ আসি তখন খাজা ভাই ছিলেন জেলে। আমি কারাগারে গিয়েই খাজা ভাইয়ের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কারাগারের নিয়ম কানুন খুব কঠিন। দেখা হয়নি। তার মোবাইল নম্বরও আমার কাছেদ নেই।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১২:৪৫