আমি এখন বাফেলো শহরে থাকি।
আমেরিকার সেরা দশ শহরের তালিকার শীর্ষে রয়েছে বাফেলো। এখানে হালাল মার্কেট, হালাল রেস্তোরাঁ আর অনেক মসজিদ। এই শহরে বাঙ্গালীদের অভাব নেই। অনেক বাঙ্গালীকে লুঙ্গি পড়ে হেঁটে যেতে দেখেছি। পান খেয়ে পিক ফেলতে দেখেছি। বাঙ্গালীদের সাধারনত আমি এড়িয়ে চলি। প্রবাসী জীবনে সবচেয়ে কষ্ট হয়তো একাএকা খেতে বসা। অবশ্য আমি ঘরে থাকলেই সব সময় টিভি ছেড়ে রাখি। এবং আমার ফ্রিজে সব সময় বিয়ার থাকেই। লিন্ডার জন্য আমাকে ফ্রিজে বিয়ার রাখতেই হয়। আলু ভাঁজা লিন্ডা খুব পছন্দ করে। এজন্য ফ্রিজে আলুও রাখি সব সময়। শুক্র ও শনিবার সপ্তাহে দুই দিন আমার ছুটি। এই দুই দিন লিন্ডা আমার সাথেই থাকে। মাঝে মাঝে আমরা বেড়াতে যাই। এ সপ্তাহে লিন্ডা আসে নি। সে তার মায়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছে ফ্লোরিডায়।
আমি খুব অল্পতেই বিষন্ন হয়ে পড়ি।
ছুটির দিন। বাসায় আছি একা। বৃষ্টি হচ্ছে। আমি বিষন্ন হয়ে গেলাম। দেশের কথা মনে পড়লো। মা বেঁচে নেই। তবু বারবার মায়ের কথাই মনে পড়ে। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নিয়ে পড়েছি। ভালো রেজাল্ট করেছি। এখন ভালো চাকরী করছি। অথচ এই আমি বাবার সাথে অন্যের জমিতে চাষ করেছি দিনের পর দিন। মা দুপুরবেলা আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসতো। পাট শাক বাজি, আলু ভর্তা। আমাদের বাড়ির উঠানে তিনটা বড় আম গাছ ছিলো। সেই আম গাছ বিক্রি করে আমি ঢাকা আসি। ঢাকায় খাজা ভাইয়ের মাধ্যমে পরিচয় হয়- মকিম ভাইয়ের সাথে। তার পুরো নাম মকিম গাজী। আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। যদিও তিনি আমার বাবার বয়সী। তবু তাকে ভাই বলে ডাকতাম। মকিম ভাই একবার আমার সাথে আমাদের গ্রামে বাড়ি এসেছিলেন। চার দিন থেকে গেছেন।
আজ বলব মকিম ভাইয়ের গল্প।
আমার দেখা অসাধারণ একজন মানুষ মকিম ভাই। মকিম ভাই কি করতেন আমি জানি না। তিনি আমাদের মেসে থাকতেন। আমার পাশের ঘরেই থাকতেন। কোনো কারন ছাড়াই আমাকে স্নেহ করতেন। নানান বিষয় নিয়ে আমার সাথে গল্প করতেন। তার সাথেই জীবনে প্রথম সোনার গাও হোটেলে যাই। পুরান ঢাকার রেস্টুরেন্ট গুলোতে খাওয়াতে নিয়ে যেতেন আমাকে। আমার মনে আছে একবার রাত দুটায় তার সাথে কলতাবাজারে হাজী বিরানী খেতে গিয়েছিলাম। আরেকদিন নিয়ে গিয়েছিলেন মামুন বিরানীক খেতে বোরহান উদ্দীন কলেজের সামনে। এমন কি আমাকে দুটা টিউশনিও যোগাড় করে দিয়েছিলেন। অসংখ্যবার আমাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন। কিন্তু সেসব টাকা তিনি কখনও ফেরত নেন নি। মানুষটার কাছে আমার অনেক ঋণ।
মকিম ভাইয়ের সাথে শেষ দেখা হয় ঢাকা এয়ারপোর্টে।
আমি আমেরিকা চলে যাচ্ছি। আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্না করেছিলেন। তার কান্না দেখে আমার চোখেও পানি চলে এসেছিলো। রক্তের আত্মীয় না হয়েও তিনি আত্মার কাছাকাছি ছিলেন। আজ মকিম ভাই কেমন আছেন আমি জানি না। অনেক চেষ্টা করেও তার কোনো খোঁজ পাইনি। মাঝখানে কত বছর পার হয়ে গেলো! কফির মগ হাতে নিয়ে বৃষ্টি দেখছি দূর দেশে বসে। কতদিন প্রিয় মানুষদের দেখি না। মকিম ভাই বলেছিলেন- সব সময় আমার সাথে যোগাযোগ রাখবেন। কখনও হারাবেন না। মকিম ভাই কথা রাখেন নি। তিনি হারিয়ে গেছেন। নাকি মরে গেছেন! আমি আমার প্রিয় মানুষদের কথা ভুলি নি। ভুলে যাওয়া সম্ভব না আমার পক্ষে। এবার দেশে গেলে তাকে ঠিকই খুঁজে বের করবো।
গতকাল খিচুরী রান্না করেছিলাম।
কিছু বেঁচে গিয়েছিলো। বেঁচে যাওয়া খিচুরী ফ্রিজে তুলে রাখতে ভুলে গিয়েছিলাম। নষ্ট হয়ে গেছে। বেশ ক্ষুধা পেয়েছে। বাসার কাছেই এক হালাল রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। সেখানে ভাত আর গরুর মাংস খেলাম। বিল দিতে গিয়ে দেখি ক্যাশ কাউন্টারে বাংলাদেশের পত্রিকা। বাসী পত্রিকা। কি মনে করে সেই পত্রিকা আমি চেয়ে নিয়ে এলাম। পত্রিকায় শেষে পাতায় চোখ বুলাতে গিয়ে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। অবিশ্বাস্য! মকিম ভাইয়ের ছবি। তিনি একদম বুড়ো হয়ে গেছেন। তবে মাথা ভর্তি চুল, বলিষ্ঠ চেহারা। চোখে মুখে কি তেজ ভাব! কত বছর পর মুকিম ভাইকে দেখলাম! নিউজ পড়ে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এটা কিভাবে সম্ভব! আমি ভাবতেই পারছি না। হায় হায়!
পত্রিকার শিরোনাম এই রকমঃ
'ডাকাত মকিম গাজী'। আমি পাগলের মতো পড়ে গেলাম নিউজটা। পরপর তিনবার পড়লাম। পত্রিকায় যা লিখেছে তার সারমর্ম হলো- মকিম ভাই ভয়াবহ একজন ডাকাত। কমপক্ষে দুই শ' ডাকাতি সে করেছে। চার বছর তালাশ করেও পুলিশ মকিম গাজীকে ধরতে পারেনি। তার নামে বিভিন্ন থানায় ১১৩ টা মামলা আছে। মকিম ঢাকাসহ রাজশাহী, চিটাগং এবং খুলনায় ডাকাতি করেছে। পুলিশ তাকে দুইবার ধরতে গিয়েও ধরতে পারেনি। পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে মকিম পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। শেষে তাকে ঢাকার মগবাজার এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। একবার সে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকেও পালিয়ে যায়। তারপর তিন বছর পর আবার তাকে সিআইডি গ্রেফতার করে। গত তেরো বছর ধরে মকিম গাজী কারাগারে। তার সাজা কোনো দিন মাফ হবে না। কারন তিনি কারাগার থেকে পালিয়েছেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ২:০৫