আমাদের গ্রামে বেশ কয়েকটা ধনী পরিবার ছিলো। ধনী বলতে যাদের অনেক জমি ছিলো। নিজেদের বড় পুকুর বা দীঘি আছে। এবং পাকা বাড়ি আছে। দরিদ্রদের বাড়ি ছিলো বাঁশের বেড়া দিয়ে, উপরে টিন। সেই টিনের চালে বড় বড় ফুটো থাকতো। বৃষ্টির সময় ঘর পানি দিয়ে ভেসে যেত। পাটাতন ছিলো মাটির। কিছু দিন পরপর পুরো ঘর মাটি দিয়ে লেপটে দিতে হতো। আমাদের গ্রামে পুরুষ মানুষরা গোছল করতো নদীতে। আর নারীরা গোছল করতো স্কুলের পুকুরে। স্কুলের পুকুর সবার জন্য উন্মুক্ত ছিলো।
আমরা ভয়াবহ রকমের দরিদ্র ছিলাম। নিজেদের কোনো জমি ছিলো না। পুকুর ছিলো না। আমি বাবার সাথে নদীতে গোছল করতাম। মা গোছল করতো স্কুলের পুকুরে। বাবা আমাকে সাঁতার শিখিয়েছে বারাশিয়া নদীতে। একদিন বাবার হাত ধরে নদীতে গিয়েছি। বুক পর্যন্ত পানিতে নেমেছি। বাবা আমাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিলো। আমি ডুবে যাচ্ছিলাম। মরে যাচ্ছিলাম। শেষ মুহুর্তে বাবা আমাকে টেনে তুললো। তারপর বাবা আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে পানিতে ভেসে থাকতে হয়।
বাবা বাজার থেকে খুব কমই মাছ কিনে এনেছে। বছরের বেশির ভাগ সময়ই বাবার কাছে টাকা থাকতো না। এমন কি ঈদের সময়ও বাবার কাছে টাকা থাকতো না। আমাকে নতুন জামা কিনে দিতে পারতো না। কোনো ঈদেই নতুন জামা পড়তে পারি নাই। আমার বয়সী অনেকেই ঈদের দিন নতুন জামা পরতো। তাদের বাড়িতে নানা রকম মজাদার খাবার রান্না হতো। আমাদের বাড়িতে সারা বছর আউশ ধানের ভাত, সাথে আলু ভর্তা। সেই আলু ভর্তাতে বেশির ভাগ সময় শরিষার তেল থাকতো না।
আমরা মাংস খেতাম বছরে একবার। কোরবানীর ঈদের সময়। গ্রামের ধনী বাড়ি গুলোতে মস্ত বড় গরু জবাই হতো। তাঁরা আমাদের মাংস দিতো। সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই, তিন কেজির মতো মাংস হতো। মা একসাথে সব মাংস রান্না করতো। আমাদের তিন জনের সংসার। ঈদের দিন ইচ্ছা মতো বাবা আর আমি মাংস খেতাম। মা মাংস খুব একটা পছন্দ করতো না। রতন কাকা প্রতি বছর ঈদে পোলাউ আর সেমাই রান্না করে আমাদের বাসায় পাঠাতেন। শুনেছি রতন কাকা করোনায় মারা গেছেন গত বছর।
আমার বাবা দরিদ্র ছিলেন। কিন্তু একজন হৃদয়বান মানুষ ছিলেন। আমার দাদার সম্পদ ভালোই ছিলো। কিন্তু নদী সব খেয়ে নিয়েছে। শুনেছি আমাদের একটা পাটকল ছিলো। সেটাও নদী খেয়ে নিয়েছে। একদিন বাবাকে বলেছিলাম, বাবা বড় মাছ দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছা করে। বাবা করিম চাচার নৌকা নিয়ে মাঝ নদীতে গিয়ে আমার জন্য একটা বড় বোয়াল মাছ ধরে এনেছিলেন। সেই মাছের স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। আমার মা ভালো রান্না জানতেন। সামান্য পেঁয়াজ মরিচ ঢলে ভর্তা বানাতেন। দারুন স্বাদ লাগতো খেতে।
প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম। আমার কোনো স্কুলের ড্রেস ছিলো না। ছিলো না এক জোড়া জুতো। খালি পায়ে স্কুলে যেতাম। যে জামাটা পরে স্কুলে যেতাম সেটার আবার দুটা বোতাম ছিলো না। বই খাতা নিতাম হাতে করে। কারন স্কুল ব্যাগ ছিলো না। বৃষ্টির দিনে বই খাতা গুলো শার্টের ভেতরে নিয়ে দিতাম এক দৌড়। আমার শিক্ষকেরা আমাকে ভালোবনাসতেন। কারন তারাও আমাদের মতো দরিদ্র ছিলেন। লেখাপড়ায় আমি বেশ ভালো ছিলাম। আসলে আমি সব কিছুতেই ভালো ছিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০২১ রাত ১২:১৩