আমার বাবা ছিলেন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। বাবা যখন শিক্ষক ছিলেন তখন আমার জন্ম হয়নি। আমার জন্মের আগেই বাবা চাকরী ছাড়তে বাধ্য হোন। আমাদের গ্রামের চেয়ারম্যান হান্নান তালুকদার বাবাকে স্কুল থেকে ছাটাই করেছেন। চেয়ারম্যান হান্নান তালুকদারের ছেলে বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করেছিলো। চেয়ারম্যান বলেছিলো- তার ছেলেকে পাশ করিয়ে দিতে। বিনিময়ে সে বাবাকে দশ হাজার টাকা দিবে। বাবা বলেছিলো সেটা সম্ভব না। আমি একজন শিক্ষক মানুষ। আমি অসৎ হতে পারবো না। স্কুলের সভাপতি ছিলো চেয়ারম্যান। নিজের ক্ষমতার জোরে বাবাকে স্কুল থেকে অব্যহতি দেয়।
চেয়ারম্যান সাহেব বাবার নামে মিথ্যা চারটা মামলা দিলো। সেই মামলা লড়তে গিয়ে আমাদের জমিজমা সব গেলো। অবশ্য চেয়ারম্যান সাহেব মৃত্যুর আগে আমার বাবার পা ধরে ক্ষমা চেয়েছিলেন। গ্রামবাসী সেদিন বাবাকে বলেছিলো- ক্ষমা করে দিন চেয়ারম্যানকে। বেচারা মৃত্যুশয্যায়। আমার বাবা চেয়ারম্যানকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু আমাদের জমিজমা আর ফিরে আসে নি। আমার মা মারা যায় ভালো চিকিৎসার অভাবে। মাকে তো আর ফিরে পাওয়া সম্ভব না। আজ আমি অনেক টাকার মালিক। গ্রামে অনেক জমি আমি কিনে নিয়েছি। সেসব জমিতে অসহায় লোকজন চাষবাস করছে। তাঁরা খেয়েপরে বেঁচে আছে।
গ্রাম তো আর গ্রাম নেই। শহরের মতো হয়ে গেছে। আমাদের গ্রামে বিউটি পার্লার আছে। কমিউনিটি সেন্টার আছে। ইংলীশ মিডিয়াম স্কুল আছে। ফাস্ট ফুডের দোকান আছে। ব্যায়ামাগার আছে। ডিশের লাইন আছে। ইন্টারনেটের লাইন আছে। বাবা আমাকে প্রতি সপ্তাহে দুটা মেইল করেন। খুব বেশি দরকার হলো হোয়াটসঅ্যাপ করেন। বাবাকে বলেছি- আমেরিকা চলে আসো। আমার সাথে কিছু দিন থেকে যাও। বাবা বলেন, এই গ্রাম ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। অন্য কোথাও গেলে আমার ঘুম হবে না। এই গ্রামের সমস্ত গাছ আমার পরিচিত। সমস্ত পথ আমার পরিচিত। মানুষজন, জমি, পুকুর, খাল, খেলার মাঠ, স্কুল ঘর আমার আত্মার সাথে মিশে আছে।
গ্রামের অন্তত দশজন ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন আমার বাবা। নিয়মিত তাদের খোজ খবর নেন। প্রাইমারী স্কুলে পাকা টয়লেট করে দিয়েছেন বাবা। পাকা মসজিদ থেকে সালতা বাজার পর্যন্ত বাবা দুই শ' গাছ লাগিয়েছেন। সেসব গাছের যত্ন তিনি নিজে করেন। কবরস্থানের দেয়াল ভেঙ্গে পড়েছিলো বাবা সেটা মেরামত করে দিয়েছেন। মসজিদের জন্য আঠারটা ফ্যান দিয়েছেন। পূজোর সময় মন্দির কমিটিকে বড় অংকের টাকা দেন প্রতি বছর। আমি প্রচুর টাকা ইনকাম করি। তার সামান্য কিছু বাবাকে পাঠাই। তাতেই বাবা মহৎ কাজ করেন। আমি বাবাকে বলেছি, আরো টাকা লাগলে আমাকে বলবে।
আমি বাবাকে বলেছি ঢাকায় অন্তত একটা ফ্লাট কিনো। বাবা রাজি হননি। বলেছেন, গ্রামে আমাদের তিন তলা বাড়ি আছে। থাকার মানুষ নেই। বিশাল পুকুর। প্রতিমাসে একবার মাছ ধরে বিলিয়ে দেই। জমি থেকে যা ফসল আসে সেটাও নিই না। বহু বছর হয়ে গেলো গ্রামে যাই না আমি। বাবা খুব করে এবার আসতে বলছেন। আমারও গ্রামে যাওয়ার জন্য মনটা আকুপাকু করছে। অথচ এমন এক চাকরী করি হুট করে যাওয়া যায় না। অনেক বড় দায়িত্ব আমার হাতে। মাস গেলে অনেক গুলো ডলার আমার একাউন্টে ঢুকে যায়। বাবা যেমন গ্রামে অনেক কিছু করেছেন। আমিও আমেরিকাতে বাড়ি গাড়ি করেছি। ব্যাংকে প্রচুর টাকা জমেছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০২১ রাত ১:২০