বিদেশে আসার পর বুঝতে পেরেছি, দেশ কি। নিজের দেশ! প্রবাসী হয়ে থাকা খুব কষ্টের। বারবার দেশের কথা মনে পড়ে। বুকের মধ্যে উথালপাথাল করে। দেশে থাকতে কখনও দেশ নিয়ে চিন্তা ভাবনা আসে নি মনে। বিদেশের মাটিতে পা রেখে বুঝলাম নিজের দেশ কি জিনিস। কি শান্তি। বাংলায় কথা বলতে না পেরে আমি ছটফট করি। আমার দম যেন বন্ধ হয়ে আসে। শুধু মাত্র বাংলায় কথা বলার জন্য ছুটে যাই, জ্যাকসন হাইটস। নিজ দেশের খাবার খাই। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চা খাই, গল্প করি। নিজের দেশের গল্প করি। বড় ভালো লাগে। পরবাসে নিজের দেশের গল্প করা অনেক আনন্দের। সদ্য কেউ দেশ থেকে আমেরিকা এলে তার কাছে ছুটে যাই। যেন সে আমার আপন আত্মীয়। তার কাছ থেকে জেনে নিই দেশের কথা। আমেরিকাতে বাংলাদেশের কারো সাথে দেখা হলে আমি তাকে জড়িয়ে ধরি।
বাংলাদেশ নিয়ে একবার আমরা একটা অনুষ্ঠান করে আমেরিকানদের মাথা নষ্ট করে দিয়েছিলাম।
দেশে থাকলে দেশ নিয়ে এত চিন্তা হয় না। এত চিন্তা আসেও না। বিদেশে আসার পর দেশ নিয়ে চিন্তাভাবনা আসে। খারাপ সংবাদ শুনলে অস্থির হয়ে যাই। ভালো সংবাদ শুনলে বন্ধুবান্ধব মিলে পার্টি দেই। বিয়ার খাই। দেশে বাঙ্গালীরা মিলেমিশে না থাকলেও বিদেশের মাটিতে মিলেমিশে থাকে। সপ্তাহ শেষে কারো না কারো বাসায় অনুষ্ঠান থাকেই। সবাই মিলে আনন্দ করি। খাই। মজা করি। কখনও কখনও দূরে পিকনিক করি। বড় ভালো লাগে। বিদেশে বসে ভাবি কেন আমাদের দেশটা বিদেশের মতো হলো না। কেন আমাদের দেশের মানুষ গুলো খারাপ। লোভী। মিথ্যাবাদী, প্রতারক আর ভন্ড। ৭১ সালেও দেশের সব মানুষ এক হতে পারেনি। কেউ কেউ আড়ালে চেয়েছিলো পাকিস্তানই থাকুক। তাদের জয় হোক। আজকাল দেশের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছে যে নিজের দেশে খেলা হলেও নিজের দেশকে সাপোর্ট করে না। সাপোর্ট করে পাকিস্তানকে। পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে উল্লাস করে।
প্রবাসীরা জ্ঞানীগুণীরা দেশ নিয়ে অনেক আলাপ করে। তাদের আলাপ আলোচনা আমি মন দিয়ে শুনি। বুঝতে চেষ্টা করি। বেশির ভাগ প্রবাসীরা মনে করে- দেশের সর্বনাশের পেছনে দায়ী পুলিশ, সরকারী আমলা এবং রাজনীতিবিদরা। পুলিশ ঘুষ ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। তাদের আচরন দেখলে মনে হয়- ঘুষ খাওয়ার জন্যই তাঁরা পুলিশে জয়েন করেছে। অবশ্য পুলিশে চাকরির জন্য, পদন্নোতির জন্য, ভালো জাগায় পোষ্টিং এঁর জন্য পুলিশকেও ঘুষ দিতে হয়। সামান্য ফুটপাত থেকে পুলিশ নিয়মিত টাকা তোলে। আসামী ধরা পড়লেও টাকার বিনিময়ে তাকে ছেড়ে দেয়। সমস্ত অন্যায় কাজই পুলিশ করে। আমাদের গ্রামে দেখেছি, একলোক সীমাহীন টাকার মালিক। কালো টাকা। প্রতিদিন পাঁচ জন পুলিশ সারারাত তার বাড়িতে গার্ড দেয়। অথচ সে কোনো মন্ত্রী, এমপি বা বড় সরকারী কর্মকর্তা না। পুলিশ জনগনের বন্ধু না। পুলিশ দুষ্টলোকদের বন্ধু। দেশের এই অবস্থার জন্য পুলিশ অনেকখানি দায়ী। পুলিশ সৎ হলে দেশ বদলে যেতো।
পুলিশের মতো সরকারী আমলারাও ঘুষ ছাড়া কিছু বুঝে না। বাংলাদেশে এমন কোনো সরকারী দফতর আছে যেখানে ঘুষ লাগে না? এই ঘুষ লেনদেন বন্ধ হলে দেশের অনেক সমস্যার সমাধান এমতেই হয়ে যেত। সিটি করপোরেশনের অফিস গুলোও ঘুষের আড্ডাখানা। সামান্য একটা ট্রেড লাইসেন্স করাতেও ঘুষ দিতে হয়। সরকারী অফিসের বিজ্ঞাপন পত্রিকায় ছাপানোর জন্য ঘুষ দিতে হয়। রাজনীতিবিদদের লন্ডন, আমেরিকা, কানাডা আর মালোশিয়াতে বাড়ি আছে। এই বাড়ির নাম দিয়েছে তাঁরা সেকেন্ড হোম। দেশের টাকা দিয়ে বিদেশে বাড়ি করে। অন্যায় ভাবে। অসৎ ভাবে। দুদক এসব দেখে না। দুদকও ঘুষ খায়। তাদের বাড়িতে চলে যায় ঘুষের টাকা। কোরবানীর ঈদের সময় চলে যায় আস্তো গরু। জামা কাপড়। পাঁচ তাঁরা হোটেলের খাবার। দুদক চাইলে অসৎ লোকদের ধরা কোনো ব্যাপারই না। বরং দুদক অসৎ লোকদের ভরসা দেয়। সাপোর্ট দেয়।
আমাদের গ্রামের হাই স্কুলের পিয়নের চাকরী পেতে আট লাখ টাকা লেগেছে। দাড়োয়ানের চাকরির জন্য লেগেছে ছয় লাখ টাকা। হাজার হোক সরকারী স্কুল। আমাদের গ্রামের এক ছেলে প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরী করে। সে এখন সরকারী চাকরির জন্য পনের লাখ টাকা নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। জমি বিক্রি করেছে। ধারধেনা করেছে। প্রাইভেট চাকরির নিশ্চিয়তা নেই। যে করেই হোক সরকারী চাকরী পেতেই হবে। উকিলরা টাকা খেয়ে ভালো মানুষকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। দোষী লোককে ফুলের মালা দিয়ে বরন করে। জজরাও ঘুষ খায়। সব কিছু মিলিয়ে বলা যেতে পারে বাংলাদেশে কোনো সৎ মানুষ নেই। বাংলাদেশ হলো খারাপ মানুষের দেশ। বাংলাদেশে যারা কারাগারে আছে তাদের যদি প্রচুর টাকা থাকতো তাহলে তাদের কারাগারে থাকতে হতো না। কারাগার হলো দরিদ্র লোকদের জন্য। ধনীরা অপরাধ করে কিন্তু তাদের কারাগারে যেতে হয় না।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ২:৫৬