
জুলাই মাসে বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৫ বছরের শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্ত পেতে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। এরই প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন। ঐক্যবদ্ধ বাঙালির গণপিটুনীর ভয়ে আওয়ামী লীগের ৩০০ এমপি আত্নগোপনে চলে যান যা ইতিহাসে নজীরবিহীন। আর এই কাজটি যে প্রজন্মের দ্বারা সম্ভব হয়েছিল তারা হলো জেন-জি প্রজন্ম। জেন-জির চোখে এই আন্দোলন ও সরকারের পতনকে জুলাই বিপ্লব হিসাবে দেখা হচ্ছে। বিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতে ইহা জুলাই অভ্যুত্থান হিসাবে ইতিহাসে স্থান পাবে। বিপ্লব না অভ্যুত্থান সে বিতর্কে না গিয়ে আমরা এই অসাধারণ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আগত নতুন সরকারের সফলতা- ব্যর্থতা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আজকের ব্লগে আলোচনা করবো।
সফলতা : জুলাই অভ্যুত্থানের পর গঠিত ইন্টেরিম সরকারের প্রতি আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসর বাদে সবার সমর্থন ছিলো। কারণ এই সরকারের প্রধান হয়েছেন নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস। এছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান শক্তি সমন্বয়কদের মধ্যে থেকে তিন জনকে উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেয়াতে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশেষ কৌতুহল ছিলো। সরকার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের দোসর ও ক্রিমিনাল নেতাদের গ্রেফতার করে। অর্থ পাচারের উপর লাগাম টেনে ধরে। ইহা অনেক বড়ো সফলতা হিসাবে অনেকে দাবী করেন। তাছাড়া বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের বিভিন্ন দাবী দাওয়া সরকার ঠান্ডা মাথায় হ্যান্ডেল করে। তবে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয় তরুণসমাজ। চাকুরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো হয়েছে, আবেদন ফি ২০০ টাকা করা হয়েছে, আওয়ামী লীগের রোষানলে পড়ে সরকারি চাকুরি থেকে বাদ পড়াদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ড.ইউনূস স্যারের ম্যাজিকে বিভিন্ন দেশের এম্বাসী বাংলাদেশে খোলার কথাবার্তা চলছে। জুলাই অভ্যুত্থানের অয়াহতদের চিকিৎসা ও চাকুরির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীদের উপর থেকে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরত আনা হয়েছে। আওয়ামী লীগ কে যারা দানবে পরিণত করেছিলো সে সব আমলাদের বদলী ও ওএসডি ও বিশেষ ক্ষেত্রে অবসরে পাঠানো হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পত্তির হিসাবে চাওয়া হয়েছে। সীমান্তে ভারতকে পাল্টা জবাব দিতে বিজিবিকে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। বিডিআর হত্যা মামলার সুষ্ঠু বিচারের জন্য ট্রাইবুনাল গঠন করছে। জুলাই অভ্যুত্থানের ভিলেন দের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। শেখ হাসিনা কে ভারত থেকে ফেরত আনার জন্য কথাবার্তা চলছে।
ব্যর্থতা : ইন্টেরিম সরকারের প্রধান ব্যর্থতা হলো তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিয়ে ঐক্যমতে পৌছাতে ব্যর্থ হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থান যে বিগত সময়ের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলনের চূড়ান্ত ফসল তা সরকার বুঝতে ভুল করেছে। প্রধান উপদেষ্টা হতে শুরু করে সবাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের ছাত্রদের অতিরিক্ত ক্রেডিট দেয়াতে বাকি সহ শক্তিগুলোর বিরাগভাজন হয়েছে। রাজনৈতিক দল বিশেষত বিএনপির সাথে সরকার দূরত্ব কিন্তু জামায়াতের সাথে ভালো সম্পর্ক অনেকেই ভালো চোখে দেখছে না। ইন্টেরিম সরকারের প্রধান সহায়ক শক্তি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও বাংলাদেশ কে নতুন রিপাবলিক ঘোষণা দেয়ার চেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলো ভালো ভাবে নিচ্ছে না। তারা এর পিছনে সরকারের উসকানি রয়েছে বলে মনে করে। ছাত্র উপদেষ্টাদের মধ্যে ১/২ জনের ফেইসবুক পোস্ট ও ব্যক্তিগত পরিচয় নিয়ে বারবার অভিযোগ উঠছে । উপদেষ্টাদের মধ্যে আমলা নিয়োগ পাওয়াতে সরকারের সাড়ে সর্বনাশ হয়েছে। সরকারের অদক্ষতার সুযোগ নিয়ে আমলারা এই সরকার কে ব্যর্থ করে দেয়ার মিশনে নেমেছে। শুরুতে ইন্টেরিম সরকারকে ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেট সমীহ করলেও দিন যতো গড়িয়েছে সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা সাধারণ মানুষের ঘাড়ের উপর সওয়ার হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। পলাতক আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের ক্রমাগত মিথ্যাচার সরকার যথাযথ ভাবে হ্যান্ডেল করতে পারেনি। ধর্মীয় সম্প্রতি রক্ষায় সরকার প্রথমে খুব সতর্ক অবস্থানে থাকলেও দিন যত গিয়েছে তত বেশি ধর্মীয় সম্প্রীতির অবনতি ঘটেছে। তাবলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে ৪ জন মারা যান যা সরকারের ইমেজকে আনেক বেশি প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে সরকারের মধ্যে থাকা বিভিন্ন পক্ষের দ্বন্ধ সুস্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ উঠছে যে তিনি এবং তার সরকার ৭১ সালকে ২৪ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চাচ্ছেন। ইহা ভালো লক্ষন নয়। বিভিন্ন সোশ্যাল ইনফ্লুয়েঞ্জারা সরকারের মধ্যে থাকা ব্যক্তিদের একান্ত পারসোনাল বিষয় জনসম্মুখে তুলে ধরে তাদের ক্যারেক্টার এস্যাসিনেশন করে যাচ্ছে। এতে মানুষের মধ্যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে ইন্টেরিম সরকারে থাকা লোকজন নিয়ে। সরকার বড়ো বড়ো অসৎ ব্যবসায়ী যারা আওয়ামী লীগের দালালি করেছিলো তাদের নিকট বোতলবন্দি হয়ে পড়ছে। সেনাবাহিনী এই সরকারের প্রধান শক্তি হলেও তাদের ম্যাজেস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়ার পরও সার্বিক পরিস্থিতি নাগালের বাইরে। সর্বশেষ আইএমএফ ও আমলাদের প্রেস্ক্রিপশনে কর বাড়ানো সরকারের জন্য বুমেরাং হতে যাচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অসহযোগিতার ফলে সরকারের দুর্বলতা আরো বেশি চোখে পড়ছে। বিভিন্ন সংস্কার কমিটিতে এনজিও কর্মী, বিদেশি নাগরিকত্ব পাওয়া ব্যক্তি ও সমন্বয়কদের রাখা হলেও কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের না রাখার কারণে খোদ সংস্কার প্রক্রিয়া এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। পলিসি মেকার দের যে কোন ধরণের সংস্কার কমিটিতে থাকা সংস্কারের গ্রহণ যোগ্যতা বাড়ায়। এছাড়া ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায়ে কেউ সাজা না পাওয়া, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে জামায়াতের সমর্থিত লোক নিয়োগ দেয়া সুষ্ঠু বিচারের পক্ষে অন্তরায় হিসাবে দেখা দিয়েছে। মব জাস্টিস, আন্দোলন করে বিচারপতিদের অপসারণ, এজলাসে ডিম মারা সহ নানাধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা সরকারকে বারবার লজ্জাজনক অবস্থায় ফেলেছে।
ভবিষ্যৎ শঙ্কা ও সম্ভাবনা : এই সরকার যদি সঠিক ভাবে যথাসময়ে নির্বাচন দিয়ে সস্মানে চলে যেতে পারে ইহা তার সফলতা। আর যদি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বিবাদ আরো বাজে পর্যায়ে পৌছায় তবে ইন্টেরিম সরকারের ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার প্রসেস ততটা সুখকর হবে না। দেশের মানুষ চায়না খুব বেশিদিন কোন অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকুক । কারণ দেশের বিনিয়োগ ও কার্যত ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়েছে। ইন্টেরিম সরকারের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে দ্রুত সকল রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌছাতে পারলে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হিসাবে তা বিবেচিত হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ১১:৫০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



