
হাসাকাহ, সিরিয়া – নামটা আজকাল মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক দাবার ছকে একটি ক্ষুদ্র ঘর হলেও এর প্রতিটি কম্পন এখন বিশ্ব-রাজনীতিতে প্রতিধ্বনি তুলছে। আজকে সিরিয়ার উত্তরপূর্বাঞ্চলের এই প্রদেশে অবস্থিত একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে মর্টার হামলার খবর ছড়ালো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। হতাহতের নির্দিষ্ট কোনও খবর না থাকলেও, এই হামলার তাৎক্ষণিক প্রেক্ষাপট, উৎস এবং কৌশলগত ইঙ্গিত অনেক বড় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে: ইরান কি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ চায়, নাকি এটি কেবল একটি রাজনৈতিক বার্তা—"আমরা পারি, তবে চাই না" ?
স্মরণ করুন কাসেম সোলাইমানিকে ২০২০ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় হত্যার পরপরই ইরান ইরাকে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে একাধিক ব্যালিস্টিক মিসাইল নিক্ষেপ করে। সেই হামলাগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল– আগেভাগে মার্কিন বাহিনীকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল যাতে জানমালের ক্ষতি না হয়। উদ্দেশ্য ছিল প্রতিশোধ নেওয়া নয়, প্রতিশোধ ‘দেখানো’। আজকের হাসাকাহের হামলাও যেন সেই পুরনো কৌশলগত থিয়েটারেরই পুনঃপ্রদর্শন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় কথিত আক্রমণ ছিল তেহরানের জন্য এক প্রকার অপমান। আন্তর্জাতিক বিধি না মেনে এমন হামলা শুধু প্রযুক্তিগত নয়, নৈতিক চ্যালেঞ্জও বটে। ফলে ইরান ‘মারেনি, কিন্তু ভয় দেখিয়েছে’। হাসাকাহতে যে মর্টার হামলা হলো, তা খুব সম্ভবত ইরান-ঘনিষ্ঠ কোনও মিলিশিয়া গোষ্ঠীর মাধ্যমে পরিচালিত। এমন হামলায় আসল উদ্দেশ্য হল—যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জানিয়ে দেওয়া, তেহরান চাইলে আঘাত হানতে পারে, কিন্তু এখনো তাদের "লাল রেখা" অতিক্রম করেনি।
ইরান বহুবার ইসরায়েলে ‘আংশিক’ আঘাত হেনেছে। তেল আবিবে সাইবার হামলা, গাজা ও লেবাননে হিজবুল্লাহ বা হামাসের মাধ্যমে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ এসবই ‘পরোক্ষ যুদ্ধনীতি’র অঙ্গ। পুরোপুরি ধ্বংস নয়, রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা। এ যেন সেই পুরনো ফারসি বুদ্ধির প্রয়োগ—দাঁত দেখাও, কামড় দিও না।
ইরান জানে—যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ তার অর্থনীতি, সামরিক ক্ষমতা ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার জন্য আত্মঘাতী। তাই তারা যা করে তা হলো “Managed Escalation”—অর্থাৎ নিয়ন্ত্রিত উত্তেজনা তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদেরকে রাজনৈতিক আলোচনার টেবিলে বসাতে বাধ্য করা। এতে তেহরান নিজের ‘পাওয়ার প্রজেকশন’ বজায় রাখে এবং নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে।
সিআরএস-এর তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে অন্তত ৫১টি দেশে ১২৮টি সামরিক ঘাঁটি চালায়, যার একটি বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্যে। এই ঘাঁটিগুলো শুধু সামরিক উপস্থিতির প্রতীক নয়, বরং ‘স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী আধিপত্য নীতির’ উপকরণ। ইরানের মতো রাষ্ট্র এই ঘাঁটিগুলোকে সামরিক নয়, রাজনৈতিক লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করে। হাসাকাহ সেই রাজনীতিরই অংশ।
ইরান সরাসরি যুদ্ধ চায় না, কারণ যুদ্ধ মানে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বাড়তি চাপ, অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং কৌশলগত বিপর্যয়। কিন্তু, আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে ও যুক্তরাষ্ট্রকে সংযত রাখতে এমন ‘হামলার অভিনয়’ করেই তারা বৈশ্বিক দাবার ছকে নিজের ঘরটি ধরে রাখছে। সুতরাং হাসাকাহতে হয়তো কেউ নিহত হয়নি। কিন্তু সেখানে ছোঁড়া প্রতিটি মর্টার ছিল একটি বার্তা—“আমরা এখনো আছি, এবং প্রস্তুত”।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



