
মধ্যপ্রাচ্য, ইতিহাসের জন্মভূমি, সভ্যতার দোলনা। অথচ আজ এ যেন এক কসাইখানা, যেখানে মুসলিম রক্ত ঝরছে সবচেয়ে বেশি, আর তার পেছনে কলকাঠি নাড়ছে মুসলিমরাই। আপনি যদি নিরপেক্ষ চোখ নিয়ে এ অঞ্চলের দিকে তাকান, দেখবেন ধর্ম এখানে কেবলই একটা আবরণ, যার আড়ালে চলছে ক্ষমতা, প্রভাব আর সম্পদের নির্লজ্জ হানাহানি। এখানে পবিত্র ধর্মীয় স্লোগান ওঠে, কিন্তু আসল দেবতা হলো ভূরাজনৈতিক স্বার্থ।
সিরিয়ার যুদ্ধ কি জনগণের যুদ্ধ ছিল? কাগজে-কলমে হ্যাঁ, আরব বসন্তের ঢেউয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণ হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে, ইরান যখন বাশার আল-আসাদের পাশে দাঁড়াল, তখন আর তা জনগণের যুদ্ধ থাকেনি। ২০১১ সালের পর তেহরান যখন সরাসরি ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (IRGC) এবং হিজবুল্লাহর মাধ্যমে সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করল, তখন কি ইরানের জনগণের মতামত নেওয়া হয়েছিল? প্রশ্নই ওঠে না। ইরান সরকার একে ‘ধর্মীয় কর্তব্য’, ‘শিয়া ঐক্য রক্ষা’ বা ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বলে চালিয়ে দিয়েছে। জনগণ কি চেয়েছিল তাদের সন্তানরা সিরিয়ার মরুভূমিতে প্রাণ দিক? নিশ্চয়ই না। তারা চায় দুবেলা ভাত, একটি স্থিতিশীল অর্থনীতি, আর মাথা গোঁজার ঠাঁই। সিরিয়ায় ইরানের প্রক্সি যুদ্ধ ছিল সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি এবং IRGC-এর ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, জনগণের আকাঙ্ক্ষার নয়।
ইরানের সংবিধান বলে তারা একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র, যেখানে জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। হাস্যকর! এই গুরুত্ব কতটুকু, তা বোঝা যায় যখন গার্ডিয়ান কাউন্সিল নামের এক অভিজাত ইসলামিস্ট গোষ্ঠী ভোটের প্রার্থী ঠিক করে দেয়। উদারপন্থী বা সংস্কারপন্থীদের সেখানে কোনো ঠাঁই নেই। জনগণ রাষ্ট্রপতিকে ভোট দেয় বটে, কিন্তু কে প্রার্থী হবে, তা ঠিক করে সেই ১২ সদস্যের কাউন্সিল, যার অর্ধেক সুপ্রিম লিডার আর বাকি অর্ধেক প্রধান বিচারপতির নিয়োগপ্রাপ্ত। অর্থাৎ, পুরোটাই সুপ্রিম লিডারের পকেটে।
সর্বোচ্চ নেতাকে নির্বাচন করে 'অ্যাসেম্বলি অব এক্সপার্টস', যারা নিজেরাও গার্ডিয়ান কাউন্সিলের অনুমোদিত। একবার সুপ্রিম লিডার নির্বাচিত হলে তাকে হটানোর কোনো উপায় নেই। তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন সশস্ত্র বাহিনী, বিচার বিভাগ, রাষ্ট্রীয় মিডিয়া, পররাষ্ট্রনীতি, এমনকি পরমাণু কর্মসূচিও। প্রেসিডেন্ট এখানে এক নির্বাহী প্রশাসক মাত্র, পুতুল।
তাহলে কি জনগণের কোনো গুরুত্ব নেই? তাত্ত্বিকভাবে আছে, বাস্তবে নেই। তারা চায় বেকারত্ব কমুক, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসুক, নিষেধাজ্ঞা উঠে যাক। ৪০-৫০% মূল্যস্ফীতির বোঝা কাঁধে নিয়ে তারা কি পারমাণবিক বোমা চায়, নাকি পেটে দু'মুঠো ভাত? উত্তরটা স্পষ্ট। সিরিয়া বা ইয়েমেনে প্রক্সি যুদ্ধ জনগণের প্রয়োজন নয়, এটা ইরানি শাসকগোষ্ঠীর শিয়া প্রভাব বলয় তৈরি এবং ইসরায়েলকে ঘিরে কৌশলগত চাপ সৃষ্টির ধর্মীয়-রাজনৈতিক আদর্শবাদ মাত্র।
ইরান কি মুসলিম বিশ্বের 'মোড়ল' হতে পারবে ? তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব হলেও বাস্তবে অসম্ভব। এর প্রধান কারণ, সুন্নি-শিয়া বিভাজন। ইরান একটি শিয়া রাষ্ট্র, যেখানে বিশ্বের ৮৫% মুসলিম সুন্নি। সৌদি আরব, মিশর, তুরস্ক—সবাই শিয়া ইরানের উত্থানকে সন্দেহের চোখে দেখে। ইরানের 'বিপ্লব রপ্তানির' নীতি অনেক সুন্নি রাষ্ট্রকে ক্ষুব্ধ করেছে। আরব লীগ বা ওআইসি-তে ইরানের প্রভাব খুবই সীমিত। বরং প্রক্সি মিলিশিয়াদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ইরান নিজেই নিজেকে একঘরে করে ফেলেছে। অর্থনৈতিক দুর্বলতা আর নিষেধাজ্ঞা তো আছেই। ইরান শুধু হিজবুল্লাহ, হুথি বা আসাদের মতো কিছু শিয়া মিলিশিয়া ও সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে, কিন্তু বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। তারা ফিলিস্তিনের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেদের ক্ষমতা বাড়াতে চায়।
ইসরায়েল ও ইরানের শত্রুতা কোনো ধর্মীয় বিরোধ নয়, এটি নিছকই ভূরাজনৈতিক সংঘাত। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব ইরানের শাহের ইসরায়েলবান্ধব নীতিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। খোমেনি ইসরায়েলকে 'অবৈধ দখলদার রাষ্ট্র' ঘোষণা করেন। তখন থেকেই ইসরায়েল ইরানকে অস্তিত্বগত হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করে। ইরান সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র না ধরলেও, হিজবুল্লাহ, ইসলামিক জিহাদ, আর হামাসের মতো ইসরায়েলবিরোধী শক্তিগুলোকে অর্থ, অস্ত্র আর প্রশিক্ষণ দিয়ে শক্তিশালী করেছে। এর পেছনে আদর্শের চেয়েও বড় হলো পারমাণবিক কর্মসূচি, মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তার, এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠতার মতো কৌশলগত কারণ।
হামাস একটি সুন্নি গোষ্ঠী হলেও ইরান কেন তাদের সাহায্য করে? এর পেছনে ধর্ম নয়, নিরেট রাজনীতি আর কৌশল কাজ করে। ইরান ফিলিস্তিন ইস্যুকে ব্যবহার করে নিজেদের 'মুসলিম বিশ্বের বিবেক' হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। হামাসকে সমর্থন দিয়ে তারা ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, সৌদি আরব-ইসরায়েল ঘনিষ্ঠতাকে ব্যাহত করে, এবং মুসলিম বিশ্বে জনপ্রিয়তা বাড়ায়। ২০১২-১৩ সালের সিরিয়া গৃহযুদ্ধে হামাস যখন আসাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তখন ইরান-হামাস সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল। ইরান হামাসের অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা কমিয়ে দেয়। কিন্তু ২০১৭ সালের দিকে পরিস্থিতি পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে ইরান আবার হামাসকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করে। এটি প্রমাণ করে, সম্পর্কটা আদর্শের নয়, প্রয়োজনের।
সাম্প্রতিক সময়ের কাতার-সৌদি দ্বন্দ্ব, হামাস-মিসর সম্পর্কের অবনতি, এবং সৌদি-আমিরাত-ইসরায়েল ঘনিষ্ঠতা—এগুলো মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ভূরাজনৈতিক দাবার ছক। কাতার যখন সৌদিদের কোপানলে পড়ল, তখন তারা ইরান ও তুরস্কের দিকে ঝুঁকলো এবং হামাসের প্রতি তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখল। মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের পতনের পর হামাসের ওপর চাপ বাড়ল, যার ফলে হামাস আরও বেশি ইরানের ওপর নির্ভরশীল হলো। আর যখন সৌদি আরব ও আমিরাত ইসরায়েলের সঙ্গে 'আব্রাহাম অ্যাকর্ডস' স্বাক্ষর করে, তখন ফিলিস্তিনিদের প্রতি আরব দেশগুলোর 'বিশ্বাসঘাতকতা' আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইরান এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে 'একমাত্র প্রতিরোধ নেতা' হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করে।
আসলে, এই কসাইখানায় রক্ত ঝরছে সেই মুসলিমদেরই, যারা ধর্মকে ঢাল বানিয়ে নিজেদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বাড়াতে চায়। এখানে ধর্মীয় স্লোগান ওঠে, কিন্তু আসল খেলাটা হলো ক্ষমতার। মুসলিম বিশ্বের মোড়লগিরিটা এখানে কেবলই এক অলীক স্বপ্ন, কারণ নিজেদের ঘরই যে আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ছে, সেখানে নেতৃত্ব তো দূরের কথা, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই যে কঠিন!
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০২৫ রাত ১১:২৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




