somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেখ মুজিব, ১৫ই আগস্ট, এবং টোকাই-রাজনীতি

১৫ ই আগস্ট, ২০২৫ রাত ১০:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ওরা ভেবেছিল তোমাকে হত্যা করলেই সব শেষ : কিন্তু তারা জানে না বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ" জুলাই অভ্যুত্থানের আগে দেওয়া বিপ্লবী সারজিস আলমের এই বক্তব্য আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। অথচ এ কথার ভেতরেই রয়েছে একটি গুরুতর ভুল। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু কেবল একজন নেতার সমাপ্তি ছিল না, তাঁর রাজনৈতিক ভিশনেরও মৃত্যু ছিল। ‘৭৫-এর মুজিব ছিলেন বাকশালি চিন্তার মানুষ যে বাংলাদেশ তিনি চেয়েছিলেন, আজকের বাংলাদেশ সেই পথের সঙ্গে অনেকটাই বেমানান।

২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতিটি ১৫ই আগস্ট প্রায় একইভাবে কেটেছে। ভোর থেকেই শুরু হয়ে যেত সেই পরিচিত গান: "যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই"। বিভিন্ন এলাকায় প্যান্ডেল টাঙিয়ে টোকাই ও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সমাবেশ করত। সেখানে বসে খানাপিনা চলত। কিন্তু স্টুডেন্টদের পরীক্ষা কিংবা অসুস্থ রোগীদের কথা কেউ ভাবত না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকীতে অনুষ্ঠান থাকত। বাংলা, ইংরেজি, সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে তাঁকে নিয়ে অসংখ্য টপিক ছিল। পরীক্ষার আগে সাজেশন চাইলে শিক্ষকেরা বলতেন: "বঙ্গবন্ধু টপিকসটা পড়বা"। একবার আমার এক ছাত্রীর ১৫ই আগস্টের পরদিন ইংরেজি পরীক্ষা ছিল। তার মা গানবাজনায় বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের টপিক থেকে প্র্যাকটিস করাতে। গানের আওয়াজে তাঁর মাথা ধরে গিয়েছিল, এমনকি ছাত্রীর বাবা ভলিউম কমানোর জন্য গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরেছিলেন।

করোনার ঠিক আগে আমরা ঢাকার জমি হারিয়েছিলাম আওয়ামী ভূমিদস্যু ঢাকা-১৬ আসনের এমপি ইলিয়াস মোল্লার কারণে। ২০১৯ সালের ২২শে ডিসেম্বর আমাদের পরিবারের জন্য অত্যন্ত বিভীষিকাময় ছিল। ছলে-বলে-কৌশলে আমাদের জমি কেড়ে নেওয়া হয়। আমি পুলিশের লাঠির আঘাত খেয়েছিলাম। আব্বু-আম্মু শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। নিঃস্ব অবস্থায় চলে যাওয়ার সময় ভাবছিলাম, এইসব ভূমিদস্যুদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতাম আমরা । প্রতি ১৫ই আগস্টে ৫০০ টাকা করে চাঁদা দিতে বাধ্য হতাম। না দিলে নানা ধরনের ভয়ভীতি ও চুরির মুখোমুখি হতে হত।

একইভাবে, আমাদের এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণের নামে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নিত। প্রতি মাসে ১০০০ টাকা আর আগস্ট মাসে তা বেড়ে দাঁড়াতো ১৫০০ টাকায়। এই চাঁদার টাকায় মসজিদের পাশাপাশি অনেক টোকাই নেতার বাড়িঘরও তৈরি হয়েছিল। ১৫ই আগস্টের রাতে প্লাস্টিকের প্যাকেটে তথাকথিত ‘তবরুক’ দিয়ে যেত, যার মধ্যে মাংসের পরিমাণ খুবই কম থাকত। ৫০০ টাকা দিয়ে আমরা চারজনের পরিবার আরামে পোলাও কোরমা খেতে পারতাম, সেখানে এই তবরুকের জন্য আলাদা আগ্রহ ছিল না।

আমার এক দুষ্টু ছাত্র ১৫ই আগস্টের উচ্চ শব্দে বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে বলেছিল, "জয় বাংলা, লুঙ্গি সামলা।" এর ফলস্বরূপ, সে টোকাই গ্যাংয়ের হাতে নিগৃহীত হয়েছিল। তারা তাকে অণ্ডকোষে ঘুষি মেরেছিল। এভাবেই আওয়ামী লীগ দলীয় কর্মীরা শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করত, যা মানুষের মনে ক্ষোভ তৈরি করেছে।

বাংলা বইতে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একটি সুন্দর গল্প পড়েছিলাম, যেখানে একজন রিকশা চিত্রশিল্পী শেখ মুজিবের ছবিকে সবার ওপরে রেখেছিলেন। এই গল্পটি হয়তো লেখকের কল্পনা, কিন্তু মানুষের মনে যদি কোনো আবেগ থেকেও থাকে, বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড এবং তাদের জোরপূর্বক প্রচারণার কারণে তা বহুলাংশে কমে গেছে। জোর করে মাইক বাজিয়ে বা কাঙালি ভোজের আয়োজন করে মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায় না। বিগত বছরগুলোতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ১৫ই আগস্টের ভিড়, ধাক্কাধাক্কি, এবং ফটোসেশনের মতো কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধার পরিবেশ নষ্ট করেছে। আওয়ামী লীগের উচিত ছিল এই দিনে কাচ্চি ও ফটোসেশন ব্যবসা বন্ধ করে সাধারণ মানুষের জন্য ৩২ নম্বর বাড়িটি উন্মুক্ত রাখা এবং শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষদের সহায়তা করা।

তবে এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন মনে হচ্ছে। বিভিন্ন পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, এবার তাঁর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। একজন সমসাময়িক লেখক সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন: "পাগল যদি সাঁকোয় ওঠে, কখনো তাকে বলতে নেই সাঁকো নাড়াস না। কারণ একবার যদি পাগল শুনে, তবে সে সাঁকো নাড়বেই।" তাঁর মতে, বাংলাদেশ বহুকাল আগে থেকেই বিদ্রোহী। এদের রক্তে আছে দ্রোহ। ইন্টেরিম সরকারের "১৫ই আগস্ট কিছু করা যাবে না" বলে চাপিয়ে দেওয়ার কারণেই আজ শেখ মুজিবুর রহমান জনমানুষের একজন হয়ে উঠেছেন। তবে আমি এই আচরণকে ভেড়ার পালের মতো কিংবা ট্রেন্ড ফলো করা ছাড়া ভিন্ন কিছু ভাবতে রাজি নই।

রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে মানুষের ধারণা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়। সম্প্রতি জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। একজন তুখোড় ওয়াজি হিসেবে জামায়াতকে লাইমলাইটে আনার পেছনে তার অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু তার মৃত্যুর সময় তিনি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন। আমার এক চাচার মুখে শুনেছিলাম, তিনি শেষ সময়ে জামায়াতের রাজনীতি করা নিয়ে অনুতাপ করতেন ।

আওয়ামী লীগের আমলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে ১৫ই আগস্ট জন্মদিন পালন করা শুরু করেছিলেন। এবার তিনি খুবই অনাড়ম্বরভাবে জন্মদিন পালন করেছেন। প্রফেসর ইউনূস তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে নীরব ছিলেন। এতে বোঝা যায়, তাঁর কাছে এখন বিএনপিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যা সম্ভবত তাঁর এক্সিট প্লানের অংশ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০২৫ রাত ১০:৪০
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

×