
আমি যখন স্কুলে পড়তাম, দুপুরের শিফটে ক্লাস ছিল। একদিন স্কুলে যাওয়ার আগে দেখি ছোটো মামা সংসদ টিভিতে অধিবেশন দেখছেন। কৌতূহল হলো, মামা এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছেন। আমিও দাঁড়ালাম একটু। পর্দায় একজন সংসদ সদস্য দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছেন, "মাননীয় স্পীকার, তারেক রহমান জিয়াউর রহমানের ছেলে। তারেক রহমান একটা ইনস্টিটিউট!" মামা তখনও আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, "সংসদের ক্লাউনগুলোকে চিনে রাখ। এরা দেশের সমস্যা, জনগণের সমস্যার চেয়ে নেতার গুণগান গাইতেই বেশি ব্যস্ত থাকে।"
সেই কথাটা আমার মনে গেঁথে গেল। তারপর থেকে মাঝে মাঝে আমিও সংসদ টিভি দেখতে শুরু করলাম। একদিন দেখলাম বিএনপির এক নেতা বলছেন, "মাননীয় স্পীকার! তারেক রহমান অবশ্যই আসবেন। যেদিন তারেক রহমান দেশে আসবেন, সেদিন অচল বাংলাদেশ আবার সচল হবে।" মনে মনে হাসি পেল। বাংলাদেশ কি সত্যিই কোনো একজন মানুষের আসা-যাওয়ার উপর নির্ভরশীল? গত বছর জুলাই মাসে যখন কোটা আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন হলো, তিনদিন এই দেশে কোনো সরকার ছিল না। সেই তিনদিন কি দেশ থেমে গিয়েছিল? মানুষ কি তাদের কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল?
২০২২ সালে IELTS করার জন্য মেন্টরস কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছিলাম। সেখানে গাইবান্ধার আবদুর রাজ্জাক নামে একজনের সাথে পরিচয় হয়। সে ছিল তারেক রহমানের বিগ ফ্যান। তাকে যখনই মজা করে জিজ্ঞেস করতাম, "তারেক মিয়া কবে আসবে? আসলেই তো শেখ হাসিনা জেলে ঢুকাবে," সে রেগে গিয়ে বলত, "মজা নিও না। যেদিন তারেক রহমান দেশে আসবে, সেদিন এক কোটি লোক তাকে রিসিভ করতে যাবে।" আজকে তার সেই ইচ্ছা পূরণ হতে চলেছে। এক কোটি না হলেও পঞ্চাশ লক্ষ লোক নাকি ঢাকায় এসেছে লিডারকে দেখতে। ভালোই তো, মানুষের আশা পূর্ণ হোক।
কিন্তু আসল প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। তারেক রহমান যখন সতেরো বছর লন্ডনে ছিলেন, তখন কীভাবে সময় কাটিয়েছেন? উন্নত বিশ্বের রাজনীতি তিনি আসলে কতটা বুঝতে পেরেছেন? কোনো দক্ষতা কি অর্জন করেছেন? কথিত আছে তিনি ইন্টার ফেইল। এত বছর সময় পেয়ে তো অন্তত গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার কথা ছিল। উন্নত বিশ্বের নেতাদের দেখা যায় পলিটিক্যাল সায়েন্স, পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, এলএলবি, থিওলজি কিংবা সোশাল সায়েন্সে উচ্চতর ডিগ্রি থাকে। তারেক রহমান কি এমন কোনো ডিগ্রি নেওয়ার চেষ্টা করেছেন? নিশ্চয়ই সারাদিন নেতা-কর্মীদের সাথে মিটিং করেই তো সময় কাটেনি। তিনি কি কোনো প্রফেশনাল কাজের সাথে জড়িত ছিলেন? শুনেছিলাম দেশ থেকে নেতার জন্য মাসিক খরচাপাতি পাঠাতে হতো। একজন নেতা যদি প্রফেশনাল কোনো কাজে যুক্ত থাকেন, অবশ্যই সেটা দেশ পরিচালনায় কাজে লাগার কথা।
তিনি এমন এক সময়ে দেশে ফিরছেন যখন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের মতো একটা বড় দল নিষিদ্ধ হয়ে আছে। শেখ হাসিনা ভারতে নির্বাসিত জীবন শুরু করেছেন। কতদিন সেখানে থাকতে পারবেন, কে জানে! বিএনপি সামনের নির্বাচনের জন্য একটা ইশতেহার দিয়েছে। আসলে ইশতেহার না দিলেও কিছু যায় আসে না। বাংলাদেশের নির্বাচনে এসব তেমন ম্যাটার করে না। সবাই মোটামুটি আগে থেকেই জানে আওয়ামী লীগের পর বিএনপি ক্ষমতায় আসে। সেই কারণেই হয়তো জামায়াতে ইসলামী তেমন কোনো ইশতেহার ঘোষণা করেনি। কারণ জামায়াত যে ক্ষমতায় আসবে, এটা তারা নিজেরাও বিশ্বাস করে না।
যাই হোক, বিএনপির ইশতেহারে কী আছে একটু দেখা যাক। তারা ক্ষমতায় এলে ফ্যামিলি কার্ড, হেলথ কার্ড, ফার্মার্স কার্ড দেবে। আঠারো মাসে এক কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। এক ট্রিলিয়ন অর্থনীতি গড়বে। মানসম্মত ও যুগোপযোগী শিক্ষা দেবে। ওয়ান টিচার ওয়ান ট্যাব দেবে। পরিবেশ সংরক্ষণ ও বনায়ন করবে। ক্রীড়া ও শিল্পচর্চায় নতুন ধারা সৃষ্টি করবে। বেকার ভাতা চালু করবে। পেপাল চালু করবে। কৃষির আধুনিকায়ন করবে এবং কৃষিকে রপ্তানিযোগ্য করবে। ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য ভাতা চালু করবে। দেখতে ভারী চমৎকার মনে হচ্ছে, তাই না?
কিন্তু এসব জিনিস বাস্তবায়নের জন্য যে পরিমাণ সাহস, দক্ষতা এবং সততা প্রয়োজন, সেটা কি বিএনপির ভেতরে আছে? একই সাথে মনে রাখতে হবে যে বিএনপি ষোলো বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল। তাই তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও ভালো নয়। শেখ হাসিনার পতনের পর বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল শুরু থেকেই। প্রতিশ্রুতি দেওয়া সহজ, কিন্তু পালন করা অনেক কঠিন।
তারেক রহমান এবং বিএনপিকে যে বিষয়টা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সতর্কতার সাথে ডিল করতে হবে, সেটা হলো ভারত। বিএনপির সবশেষ শাসনামলে ভারতের সাথে সম্পর্ক প্রচণ্ড খারাপ হয়েছিল। ভারত আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো দলকে পছন্দ করে না। তাই ভারতের সাথে সুসম্পর্ক রাখা জরুরি। অন্তত অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সম্পর্ক যেটা একেবারে তলানিতে, সেটা থেকে ভালো করতে হবে। ভারত আওয়ামী লীগ আমলে যেভাবে চুক্তি করেছে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে চাইলেও সেভাবে পারবে না। ভারতের কাছে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সবসময় বিশেষ থাকবে। এটা ঐতিহাসিক ও কৌশলগত বাস্তবতা।
কিন্তু এখানে একটা জটিল ব্যালান্স করতে হবে। যারা ভারতবিরোধিতার নামে আসলে পাকিস্তানের উদ্দেশ্য সাধন করে, তাদের ব্যাপারে বিএনপিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ একাত্তরের গণহত্যা, স্বাধীনতা সংগ্রাম ভুলে যায়নি। তারা পাকিস্তানি শাসনও চায় না। ভারতীয় আধিপত্য বিরোধিতার নামে যারা সারাদিন হাউকাঊ করে, তাদের আসল উদ্দেশ্য কী সেটা প্রশ্ন করা জরুরি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হওয়া উচিত খুবই সোজা: যেখানে আমরা সুবিধা পাবো, সেখানেই যাবো। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য: সবার সাথে নিজস্ব জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে সম্পর্ক রাখতে হবে। না ভারতপন্থী, না পাকিস্তানপন্থী—শুধু বাংলাদেশপন্থী।
উগ্রবাদী দক্ষিণপন্থীদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যাতে তারা দেশে ধর্মের নামে অধর্ম চর্চা করতে না পারে। ভারতের সাথে সম্পর্ক খারাপ করে বাংলাদেশের লাভ নেই—ভূগোল তো আর পাল্টানো যায় না। কিন্তু তার মানে এই না যে আমরা মর্যাদাহীনভাবে কারো অধীনস্থ হয়ে থাকব। মর্যাদাপূর্ণ, সমমর্যাদার সম্পর্ক—এটাই হওয়া উচিত লক্ষ্য। এছাড়াও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করতেই হবে। পুলিশের হারানো মনোবল ফিরিয়ে আনতে হবে। বিদেশে অবৈধভাবে মানুষ যাওয়া থেকে নিবৃত্ত করতে হবে। দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে টেনে টুনে চালিয়ে নিতে হবে। বিষয়গুলো এতটা সরল নয়।
দেশের মানুষ যে ভবিষ্যতে খুব ভালো জীবনের নিশ্চয়তা পাবে, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। মেগা প্রজেক্ট, বড় বড় প্রতিশ্রুতি: এসব শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু সাধারণ মানুষ আসলে চায় নিরাপত্তা, সুশাসন এবং নিজের যোগ্যতায় বেঁচে থাকার সুযোগ। অন্তত ভয়হীনভাবে নিজে কিছু করে খেতে পারলেই স্বস্তি। এর বেশি প্রত্যাশা করলে হয়তো হতাশ হতে হবে। তারেক রহমান এবং বিএনপি কীভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৪১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



