somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এই বাঁধটাতেই যেন মরণ হয়

১২ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




ন্যুজ শরীরটার ভার বহনের দায় হাতের লাঠিটির। কানে প্রায় শুনেনই না , চোখেও ছানি পড়েছে। নদী তার কাছের মানুষদের দুরে ঠেলে দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে সহায় সম্বল। নদীর ভাঙ্গা গড়া, সংসারের ভাঙ্গা গড়া, জীবনের ভাঙ্গা গড়া, করতে করতে তিনি আজ প্রায় কা¬ন্ত । তবুও থেমে নাই তার জীবন। তিনি কালাই বেওয়া (১০০)। গ্রামের সবাই কালাই বুড়ি বলেই ডাকে তাকে।

কুড়িগ্রামের ধরলা পাড়ের গ্রাম হলোখানা হেমেররকুটি বাঁেধর পাড়ে ছোট্ট একটি ঝুপড়ি ঘরে থাকেন কালাই বুড়ি। প্রতি বছর বর্ষায় তার ঘরটিতে পানি উঠে তলিয়ে যায়। বন্যা হলেতো পানির তোড়ে মিলিয়ে চলে যায় ধরলা থেকে ব্রহ্মপুত্র হয়ে সাগরে। তখনও দু’চারটা,থালাবাটি নিয়ে কোন মতে হাতড়াতে হাতড়াতে উঠে পড়ে বাধেঁর উপরে। বাঁধটাকে আঁকড়ে ধরে থাকেন কয়েকদিন । তারপর পানি কমে গেলে আবারো খরখুটো দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন নিজেই। সর্বশক্তি দিয়ে শক্ত পোক্ত করে বাঁধার চেষ্টা করেন ঝুপড়ির বেড়া,চাল। এই বাঁধটাই তো তার আশ্রয়দাতা! প্রায় সারা জীবন কোলেপিঠে করে রেখেছে তাকে। নিজের হাত-পা ঘাড়-গর্দান ছিড়ে গেলেও কালাই বুড়িদের ফেলে দেয়নি নদীতে। ববং নিজের বুক পাজড় কেটেও থাকতে দিয়েছে পরম মমতায়।

কালাই বুড়ির জন্ম হয়েছিল ধরলা পাড়ের গ্রামে। খুব ছোট বয়সে দাদির কোলে চড়ে গিয়েছিলেন পাশের পাড়ায় স্বামীর বাড়ি।স্বামীর নাম কেরামত আলি মারা গেছেন প্রায় চল্লিশ বছর আগে। কেরামত আলি ছিলেন দুধ ব্যবসায়ী । চরের গৃহস্থদের গরুর দুধ সংগ্রহ করে তিনি হাটে বাজারে বিক্রি করতেন। জমি জিরাত তেমন ছিল না । যা ছিল বসত ভিটার মতো তাও গিলে খায় ধরলা। তাই তাদের বার বার করতে হয়েছে ঠিকানা বদল। সারা জীবন নদীর এপার -ওপার করতে করতে কা¬ন্ত কেরামত আলি এক সময় চলে গেলেন চিরস্থায়ী ঠিকানায়। কালাই বুড়ি মরিয়ার হাসি হেসে বলেন, ওমরা (তিনি) মরিয়্ওা ঠিক থাইকবার (থাকতে) পায় নাই, যেটে (যেখানে) মাটি (কবর)দিছে পরের বার (বছর) সেখানও ভাইঙ্গছে (ভেঙ্গে) । তিন ছেলে মন্তাজ, এন্তাজ ও নওসাদ যে যার মতো আশ্রয়ের খোঁজে চলে গেছে। তারা কোথায় থাকে তাও জানেন না কালাইবুড়ি। মেয়ে সোনাভান বিধবা । তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে তিনিও বাধেঁ আশ্রিত। তার নিজেরই চলে না , তবুও মা তো , মাঝে মাঝে দেখেন। তাই কালাইবুড়িকে পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় বয়স্ক ভাতার উপর। কত টাকা ভাতা পান জানতে চাইলে বলেন, মুই(আমি) কিছুই জানোং(জানি) না। কত দিন পর কয় টাকা দেয় তাও জানং না । সে টাকা নিবার যাওয়া নাগে শহরের ব্যাংকে। অন্য কোন ভাতা পাওয়া ব্যক্তি এসে খবর দিলে তিনি রিক্সায় করে চলে যান শহরের ব্যাংকে।তিনি বলেন, ব্যাংকোত যার শইল্লে(শরীরে) শক্তি নাই তার দিকে কাইয়ো(কেউ) দেখে না, ভীড় ঠেলার শক্তি কি মোর আছে? এই ভাতার টাকায় চলে খাওয়া-পরা-চিকিৎসা,থাকার ঘরটি মেরামত সব। সময়ের সাথে সাথে তিনি স্বামী, সন্তান, সংসারের সাথে সাথে হারিয়ে ফেলেছেন তার নিজের নামটাও। অনেক চেষ্ঠা করেও তিনি নিজের নামটি মনে করতে পারেননি। বলেন, ছোট বেলায় মোর(আমার) একটা নাম আছিল(ছিল) । মোর নাম ধরি তো কাইয়ো (কেউ)কোনদিন ডাকায় (ডাকে) নাই। মানসে (মানুষে) তো কালাই বুড়ি কয়। তিনি আরো বলেন,‘ দ্যাশে (দেশে) কত আজা (রাজা) আসে আজা যায়, ভোটের সময় হইলে(হলে) সবায় (সবাই) ভোট চাবার(চাইতে) আইসে কিন্তু মোর তো কপাল বদল (আমার তো ভাগ্য পরিবর্তন) হয় না।

ঝড়,বন্যা, নদী ভাঙ্গনের সাথে যুদ্ধ করে যার জীবন কেটেছে, নদীর গর্জন শুনতে শুনতে তার কেটে গেছে রাত। বাতাসের শব্দ ও নদীর গর্জন শুনে তিনি এক সময় বলে দিতে পারতেন ধরলার পানি সেবার কতোটা বাড়তে পারে বা নদীটা কোন দিকে ভাঙ্গবে। প্রতি বছর ভাঙ্গা গৃহস্থালী গুছিয়ে জোড়া লাগিয়েছেন । আবারো ভাঙ্গনের অপেক্ষা করে করে গেছে দিন মাস বছর । যেন নিয়তি ভেবে সেটা মেনে নিয়েছিলেন। তাই অভ্যাসে পরিনত হয়েছে তার গোছাগোছি। তাছাড়া বেশীক্ষণ বসেও থাকতে পারেন না এক জায়গায়। লাঠিটিতে ভর দিয়ে খড়ি কুড়াতে হেঁটে বেড়ান চর থেকে চরে ।চরে খড়ি পাওয়া দায়। শুকনা গোবর, কাশের মুড়া কুড়িয়ে কোছায় নিয়ে ঘরে ফিরেন। সকাল- সন্ধার রান্না পরে কিছুটা খড়কুটো জা¡লিয়ে চলে শীত নিবারণ।

জীবনেরই শেষ সময়টায় একটু নির্ভরতা বা নিশ্চয়তা চান কালাই বুড়ি। বলেন , মুই আর কোনোটে (কোথাও) যাবার (যেতে) না চাঙ (চাই)। এই বাধেঁর জাগাতেই(জায়গা) যেন মোর মরন হয়।
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×