মানবজমিন, Sat 17 Jul 2010
মেয়ের ছবি বুকে নিয়ে হাউ-মাউ করে কাঁদছেন হাসিনা রাব্বানী। চিৎকার করে বলছেন, ওকে বলেছি, মেয়েকে যদি বিয়ে করতে চাও দেবো তবু ওকে প্রাণে মেরো না। মেয়ের আর্তচিৎকার শুনে হাসিনা রাব্বানী পাশের ঘর থেকে দৌড়ে গিয়ে দেখেন দরজা বন্ধ। এ সময় বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে এভাবেই আকুতি জানান পাষণ্ড প্রেমিক কবিরের কাছে।
হাসিনা রাব্বানী বলেন, ভেতর থেকে মেনোকার গগনবিদারী চিৎকারে তখন চারপাশের বাতাস ভারি করে তুলেছিল। কিন্তু কোন অনুরোধই রাখেনি কবির। একবার দু’বার নয় অসংখ্যবার ছুরিকাঘাত করে ক্ষত-বিক্ষত করে মেনোকার মৃত্যু নিশ্চিত করে তবেই ক্ষান্ত হয়েছে। পুলিশের কাছে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে আসামি তারেকুজ্জামান কবির অকপটে স্বীকার করেছে। বলেছে, প্রতিশোধ নিতেই আমি খুন করেছি মেনোকাকে। তাকে খুন করতে আড়াই শ’ টাকা দিয়ে ছুরি কিনেছি। অন্য কারও সঙ্গে প্রেম করবে-এটা আমি মেনে নিতে পারিনি বলেই খুন করেছি। আমার ফাঁসি হলে তাতেও আমার কোন দুঃখ নেই।
রাজধানীর মিরপুরের মধ্য পাইকপাড়ায় কলেজছাত্রী মোহসীনা রাব্বানী মেনোকা (২৪) খুনের মূল কারণ প্রেম তা নিশ্চিত পুলিশ। মেনোকা ও কবিরের মোবাইল ফোনের এসএমএস, কবিরের স্বীকারোক্তি থেকেই এ ধারণা পুলিশের। ঘাতক তারেকুজ্জামান ওরফে কবির গতকাল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর থানার উপ-পরিদর্শক রুহুল আমিন জানান, কবির অকপটে স্বীকার করেছে কখন কিভাবে সে মেনোকাকে খুন করেছে। বলেছে, মেনোকাকে খুন করে আমি পালিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু পালাইনি। কারণ, আমি চাই সবাই জানুক আমি তাকে কেন খুন করলাম। আমি মেনোকাকে বলেছিলাম, সে যদি তার বাবা মায়ের পছন্দ করা ছেলে বিয়ে করে তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু সে আমার সঙ্গে এতদিন প্রেম করে আবার আরেক ছেলের সঙ্গে প্রেম করবে তা হবে না। মেনোকা আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। মোবাইল ফোনে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার নতুন প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলত। আমি কল ওয়েটিং পেতাম। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে সে বলতো আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছি। এ প্রতারণা আমি সহ্য করতে পারিনি। বাড়িতে বসেই আমি মেনোকাকে খুনের পরিকল্পনা করি। আড়াই শ’ টাকা দিয়ে বড় একটা ছুরি বানাই। তা দিয়েই আমি মেনোকাকে খুন করি। তার অপরাধের উচিত শিক্ষা আমি তাকে দিয়েছি। এখন আমার ফাঁসি হলেও কোন দুঃখ নেই। ওদিকে মেনোকার বাবা-মায়ের দাবি, মেনোকা ও কবিরের প্রেমের যে সম্পর্কের কথা সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে-তা সঠিক নয়। মা হাসিনা রাব্বানী বলেছেন, কবির সম্পর্কে মেনোকার মামা। বৃহস্পতিবারই প্রথম সে বাসায় আসে। কিন্তু মিরপুর থানার সেকেন্ড অফিসার আবু বক্কর জানান, মেনোকার বাবা-মা যা বলছেন তা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। ওই বাসায় কবির একাধিক দিন গেছে। এমনকি যেদিন মেনোকা খুন হয়, তার আগের দিনও মেনোকার মা, কবির ও মেনোকা এক সঙ্গে দুপুরে খেয়েছে। তাছাড়া মেনোকা যখন বাঁচাও বলে আর্তচিৎকার দেয় তখন বন্ধ দরজার এ পাশে দাঁড়িয়ে কবিরকে উদ্দেশ্য করে মেনোকার মা বলেছিলেন, কবির আমার মেয়েকে যদি বিয়ে করতে চাও দেব কিন্তু ওকে মেরোনা। তার একথা প্রমাণ করে মেনোকার সঙ্গে কবিরের সম্পর্কের বিষয় তিনি জানতেন।
মোবাইলের এসএমএসএ যা আছে : কবিরের মোবাইল ফোনে মেনোকার মোবাইল নম্বর থেকে আসা অনেকগুলো এসএমএস আছে। ১০ই জুলাই মেনোকার মোবাইল থেকে কবিরের কাছে এসএমএস আসে ‘আমাকে তুমি ক্ষমা কর। তোমাকে আমি অনেক ভালবাসি। তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।’ পরদিন ১১ই জুলাই আসে ‘প্লিজ ফোনটা ধর না, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।’ একইভাবে ১২ তারিখে এসএমএস আসে ‘আমি খালাত বোনের সঙ্গে শুয়ে আছি। ও ঘুমিয়ে গেলে তোমাকে কল দিব।’
মিরপুর থানা হাজতে সাংবাদিকদের কাছে কবির বলেছে, আমাকে প্রথম প্রেমের প্রস্তাব মেনোকাই দেয়। তাকে বলেছিলাম, আমি তোমার মামা হই। আমাদের বিয়ে হবে কেউ মেনে নেবে না। কিন্তু মেনোকা বলেছিল, আমরা ঠিক থাকলে কেউ কিছু করতে পারবে না। কিন্তু আমার সঙ্গে যখন তার প্রেমের সম্পর্ক পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে তখন সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছি মেনোকার সঙ্গে। আমার আর মেনোকার কল রেকর্ড পরীক্ষা করলেই সেগুলো পাওয়া যাবে।
সুরতহাল প্রতিবেদন: মেনোকার লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন মিরপুর থানার এসআই রুহুল আমিন। তিনি জানান, লাশের শরীরে ২০টিরও বেশি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন। পেটের নিচের অংশে সজোরে ধারালো ছুরি ঢোকানো হয়। এতে মেনোকার ভুঁড়ি বেরিয়ে যায়। তাছাড়া তার হাতের এবং পায়ের রগ কেটে দেয়া হয়। সামনের দিক থেকে পেটে ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে দেয়ার পর মেনোকা উপুড় হয়ে পড়ে যায়। পরে তার পিঠের কয়েকটি স্থানে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়া হয়।
থামছে না বাবা-মায়ের আহাজারি: গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ থেকে মেনোকার লাশ বাসায় নেয়ার পর হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। মেনোকার বাবা লুৎফে রাব্বানি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, সন্তানের লাশ যে বাবার কাঁধে অনেক ভারী। আমি কিভাবে সন্তানের লাশের খাটিয়া কাঁধে নেব। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ হত্যার বিচার চাই। কবিরের ফাঁসি চাই। মেনোকার মা মেয়ের লাশ দেখেই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। মেনোকার ছোট ভাই আকাশ কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, আপু আমাকে ডাক্তার বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন আমাদের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





