১. মুক্তি ও সূত্রপাত
নাসির উদ্দিন ইউসূফ বাচ্চু পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘গেরিলা’। এ বছর মে মাসের প্রথম দিকে মুক্তি পায় সারাদেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে। অনেক তারকার সমাহারে নির্মিত ছবিটি মূলত সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে নির্মিত। তবে যুদ্ধকালীন বিভিন্ন দৃশ্য ও ঘটনা নির্মাতার মতে ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা’র আলোকে চিত্রায়িত। যা মূল উপন্যাসের কাহিনীর সাথে যুক্ত হয়েছে।
২. মূল কাহিনী ও তার সময়কাল
ছবিটির কাহিনী ২৫ মার্চ, ১৯৭১ এ শুরু হয়ে আগস্ট/সেপ্টেম্বরের দিকে এসে শেষ হয়। ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাসের চরিত্র ‘বিলকিস’; যার সাংবাদিক স্বামী ২৫ মার্চ রাতে বের হয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। আর এদিকে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
এদিকে বিলকিসের সহযোগিতায় তারা ‘গেরিলা’ নামের সরকার বিরোধী একটি ছোট পত্রিকা প্রকাশ করা ছাড়াও ছোট ছোট অপারেশন চালাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ ও সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে চলে তাদের যুদ্ধ।
একপর্যায়ে আলতাফ মাহমুদসহ সংশ্লিষ্ট সকলের নাম ফাঁস করে দেয় এক বন্দী মুক্তিযোদ্ধা। আগস্ট মাসের দিকে ঝটিকা অপারেশনে ‘মেজর সারফরাজ’ তাদেরকে গ্রেফতার করতে শুরু করলে বিলকিস পাড়ি জমায় গ্রামের উদ্দেশ্যে। গ্রামে গিয়ে নতুন বিপত্তির সম্মুখীন হয় সে। তার ভাই খোকন কমান্ডার ও মামাকে মেরে ফেলে পাকিস্তানিরা। ভাইয়ের লাশ দেখতে গিয়ে এক পর্যায়ে বিলকিসও গ্রেফতার হয়। সর্বশেষ নিরুপায় বিলকিস গ্রেনেড চার্জ করে নিজেকে সহ পুরো ক্যাম্প উড়িয়ে দেয়। এই হল ছবির সারমর্ম।
৩. ছবিতে উঠে আসা ঐতিহাসিক চরিত্র
ছবিতে বিশিষ্ট সুরকার আলতাফ মাহমুদ এর চরিত্রায়ন করা হয়েছে, যিনি ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারী’ গানের স্রষ্টা। আহমেদ রুবেল অভিনীত আলতাফ মাহমুদ ছবিতে সরকার বিরোধী গান রচনা ও সুর করে তা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সর্বত্র প্রচার করার চেষ্টা চালান। এক পর্যায়ে তিনি সরকার কর্তৃক গ্রেফতার ও বন্দী হন।
৪. আধুনিক সম্পাদনা, সিমেনাটিক দৃশ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার
‘গেরিলা’ ছবির সম্পাদনা, মেকআপ ও প্রযুক্তির ব্যবহার কিঞ্চিত আশাব্যঞ্জক ও সম্ভাবনার দিক নির্দেশ করে। এদেশী সিনেমাতে অদ্যবধি প্রদর্শিত গোলাগুলি ও বোমব্লাস্টিংয়ের দৃশ্যায়নে ‘গেরিলা’ কিছুটা হলেও এগিয়ে আছে। বোমব্লাস্টিংগুলো অত্যন্ত দুর্বল হলেও এদেশের অন্যান্য ছবির অভিজ্ঞতায় খুব নিম্নমানের নয়। তাছাড়া, মৃত লাশের মেকআপ ও চিত্রায়নে ব্যতিক্রম এসেছে। পাকিস্তান আমলের ট্রেন, বিশাল সামরিক বাহিনী, ট্যাঙ্ক, বিমান ইত্যাদির ব্যবহার অনেক কষ্টসাধ্য বলে সিনেমাটির মান বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে কিছু কিছু দুর্বল অ্যানিমেশন খুবই বেখাপ্পা মনে হয়েছে।
৫. ছবির বিতর্কিত দিকসমূহ
ছবির মূল কাহিনী ও তার চিত্রায়নের আধুনিকতায় ছবিটিকে এদেশীয় সিনেমার জগতে ভালো অবস্থানে রাখা যেত কিন্তু ছবিটি নির্মাণের পেছনের অসৎ উদ্দেশ্য, অনুদান ও নির্দিষ্ট মহলের কাছ থেকে অর্থ-সম্মান পাবার লালসায় কৃত পদলেহন এবং নিছক স্বার্থান্বেষণ ও রাজনৈতিক মত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আগামী প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের বিকৃত উপস্থাপন নিতান্তই নিকৃষ্ট মানসিকতার পরিচায়ক। নিম্নে সুনির্দিষ্টভাবে এই ছবির বিতর্কিত দিকসমূহ উল্লেখ করা হল।
রাজনৈতিক মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা
‘গেরিলা’ ছবিতে প্রদর্শিত মুক্তিযুদ্ধটি একটু ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যাবে যে, সেটি বাংলাদেশের গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্যায়ন নয় বরং শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্যায়ন। সিনেমাটি একটি নির্দিষ্ট মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে গিয়ে খুব দক্ষ ভূমিকা পালন করেছে বলা যাবে না বরং অদক্ষ চিত্রায়নে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পদলেহন খুব স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে।
‘জামায়াতে ইসলামী’ নামের যথেচ্ছ ব্যবহার
রাজনৈতিক একচোখা দৃষ্টির মূল দৃশ্যপট ফুটে ওঠে ‘গেরিলা’য় ‘জামায়াতে ইসলামী’ নামটির যথেচ্ছ ব্যবহার দেখলে। সাধারণ দেশবাসী ও নতুন প্রজন্মের ব্রেইন ওয়াশ প্রকল্পের আওতাধীন সরকারি কর্মকান্ডের সিনেমাটিক প্রয়োগ হচ্ছে ‘গেরিলা’। ইতোপূর্বে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক অনেকগুলো পূর্ণদৈর্ঘ্য-স্বল্পদৈর্ঘ্য, ৩৫মি.মি. বা ডিভিতে নির্মিত ছবি এদেশে মুক্তি পেয়েছে। সেকল ছবিতে সরাসরি কোন রাজনৈতিক দলের নামে এইভাবে যথেচ্ছ চিত্রায়ন হয়নি।
‘জামায়াতে ইসলামী’ দেশের তৃতীয় অবস্থানের রাজনৈতিক দল। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় দশভাগ এই দলটির রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং এছাড়াও বিপুল জনগোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে দলটির ভূমিকাকে রাজনৈতিক একচোখা দৃষ্টিকোণ থেকে মিডিয়ায় প্রচার করে একটি বড় মাপের স্ক্যান্ডাল তৈরি ছাড়া ‘জামায়াতে ইসলামী’র রাজনৈতিক মতবাদের এবং কর্মসূচীর বিরুদ্ধে কোন যুক্তি দাঁড়া করা আজ অবধি সম্ভব হয়নি। কেননা, ইসলামী মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত এ দলটির কর্মকান্ড- কর্মসূচী রাজনৈতিকভাবেই স্পষ্ট ও প্রকাশ্য। এমনকি, বর্তমানে আমীর, সেক্রেটারি জেনারেলসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কারাগারে আটক থাকার পরেও ভারপ্রাপ্ত কমিটি গঠণ ও নিয়মিত কার্যাবলী একই গতিতে কীভাবে চলছে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাছাড়া, কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে মিডিয়ায় প্রচারিত সম্ভাব্য দাঙ্গা-হাঙ্গমা ও জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচীর আশঙ্কা নিতান্তই অবাস্তব প্রমাণিত হচ্ছে। আর একটা ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয়, দেশী রাজনীতির ট্রেডিশান বলে- এই সময়টায় কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভসহ অন্যান্য আন্দোলনই জামায়াতের একমাত্র কর্মসূচী এবং সরকারবিরোধী ইস্যু হবার কথা। কিন্তু বাস্তবতা সত্যি সত্যিই ভিন্ন। যেমন, ক’দিন আগেও প্রেসক্লাবে জামায়াতের মানববন্ধনে পুলিশ হামলা করে। অথচ মানববন্ধনের ইস্যু ছিল ‘সিএনজির মূল্য বৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্যের লাগাতার উর্দ্ধগতির প্রতিবাদ’।
অবাস্তব দেয়াল লিখন ও ব্যানার
‘গেরিলা’ ছবিটি ভালো করে দেখলে যে কারও চোখ পড়বে এখানে সেখানে টাঙানো অনেকগুলো ব্যানারে এবং কিছু দেয়াল লিখনে। যেগুলোর ভাষা অনেকটা এরকম- ‘রাজাকারে যোগ দিন- জামায়াতে ইসলামী’, ‘শান্তিকমিটিতে যোগ দিন- জামায়াতে ইসলামী’, ‘ভারতের দালালদের ধরিয়ে দিন- জামায়াতে ইসলামী’, ‘শেখ মুজিবের ফাঁসি চাই- জামায়াতে ইসলামী’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এখন সাধারণ দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, আসলেই কি জামায়াত এমনটা করেছে? উল্লেখ্য, রাজাকার কিংবা শান্তি কমিটি ছিল ১৯৭১ এ গঠিত সরকারী প্রতিরক্ষা বাহিনী, যেমনটা বর্তমানে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ইত্যাদি কিংবা ৭২ এ শেখ মুজিব কর্তৃক গঠিত অত্যাচারী রক্ষী বাহিনী। এসকল বাহিনী সরকারী তত্ত্বাবধানে সৃষ্ট, লালিত ও বেতন-ভাতা প্রাপ্ত। প্রশ্ন হল- এ বাহিনীর জনশক্তি ছিল কারা? এক বাক্যে উত্তর দিতে গেলে বলতে হবে- এদেশের তৎকালীন নিরুপায় ভীতু জনগণরা। কোন রাজনৈতিক দল থেকে এসব বাহিনী গঠণ করা হয় নি।
জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন রাজনৈতিক মতানুযায়ী তারা দেশে যুদ্ধ সংঘটিত হবার পক্ষে ছিল না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তারা পাকসেনাদের সাথে হাত মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এক পশলা যুদ্ধ করেছিল। যখন দেশ স্বাধীন হল তখন এক রাজনৈতিক গোষ্ঠী এই ব্যাপারটিকে নিজেদের মত করে এমনভাবে প্রচার করে এসেছে যে, তারা রাজাকার ও জামায়াতকে আলাদা করেনি। তারা প্রচার করে গেছে, জামায়াত তখন রাজাকার গঠণ করেছে। মূল ঝামেলার উৎপত্তি সেখান থেকেই। অথচ দেখা যায়, প্রতি এলাকায় স্থানীয় সাধারণ জনতার সমন্বয়ে রাজাকার গঠণ হওয়ায় সবমিলিয়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সমর্থককেই সেখানে পাওয়া যায়। সত্যি কথা বলতে, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংখ্যাও সেই রেশিওতে কম ছিল না। বর্তমান আইন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল এর বড় ভাই রাজাকার বাহিনীর কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন, যাকে যুদ্ধ জয়ের পরে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে তার আধমরা দেহ নর্দমা/আবর্জনার মাঝ থেকে উদ্ধার করা হয়। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিয়ে এই প্রসঙ্গ ইতি টেনে কথার মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই।
সুতরাং সহজ ভাবেই বোঝা যায়, রাজাকারে যোগ দেবার আহ্বান আর যাই হোক খোদ জামায়াতের করার কথা নয়। যদি এমন কোন ব্যানার থেকে থাকে তবে তা অবশ্যই পাকিস্তান সরকারের সরকারী ব্যানার ছিল। তাই ‘গেরিলা’য় প্রদর্শিত জামায়াতের নাম অবশ্যই রাজনৈতিক ইশারায় মানহানী করার উদ্দেশ্যে মাত্র।
অপর একটি দেয়াল লিখন সকল দর্শকের নজর কাড়ে- ‘শেখ মুজিবের ফাঁসি চাই- জামায়াতে ইসলামী’। বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেকাংশে বিকৃত আসলেও অন্তত এতটা বিকৃত আজকেও আসেনি। জামায়াত কখনও শেখ মুজিবের ফাঁসি চেয়েছে বলেও আগে কখনও শোনা যায় নি। এটি পরিপূর্ণভাবেই নাসিরউদ্দিন বাচ্চু অথবা তার উপরের উপদেষ্টাদের আবিষ্কার। জামায়াত ইসলামীকে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে কখনই অপর রাজনৈতিক দলের ওপর চড়াও হতে দেখা যায় নি বরং চিন্তাধারা ও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী মিলে গেলে অনেক সময়ই একসাথে কাজ করতে দেখা গেছে। উল্লেখ্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জামায়াত আমীর নিজামীর একটি ছবি এখন সবার কাছে রয়েছে। যেখানে তারা একসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে একমঞ্চে উপবিষ্ট হয়েছিল।
ছবিতে ‘জামায়াতে ইসলামী’ এর বিকৃত চরিত্রায়ন
নাসিরউদ্দিন ইউসূফ বাচ্চু হয়ত ব্যক্তিগতভাবে জামায়াত পছন্দ করেন না। এটি খুবই স্বাভাবিক। গণতান্ত্রিক দেশে ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষের বাস। কিন্তু নিতান্তই রাজনৈতিক কারণে জামায়াতের মানহানী করার চেষ্টা অবাস্তব বরং আরও বাড়তি কিছু স্বার্থ জড়িত থাকা ছাড়া ‘গেরিলা’য় জামায়াত ইসলামীর এহেন বিকৃত চরিত্রায়ন অসম্ভব।
ছবিতে জামায়াত ইসলামী হিসেবে যাদের উপস্থাপন করা হয়েছে তারা চেহারা-সুরৎ মাশাল্লা ভয়ঙ্কর। একদৃষ্টিতেই যেন তাদের দেখে গোটা জামায়াতের প্রতি মনে ঘৃণা জন্মে তার বন্দোবস্ত মেকাপ থেকে শুরু করে আরও গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত। যুবক বয়সী দু’জন অভিনেতা রাস্তায় মেয়ে উত্যক্ত করা, হিন্দু দুধওয়ালাকে নির্যাতন, ধর্ষণ থেকে শুরু করে হাতে রামদা মিছিল করছে- যার হাস্যকর চিত্রায়ন মুক্তিযুদ্ধের সিরিয়াস ছবিতেও কৌতুকবোধ জন্ম দেয়। স্বাধীনতার সময় ‘গেরিলা’র মত কোন রামদা-চাপাতি-কিরিচের মিছিল এবং এই ধরণের হিংস্র আক্রমন দাড়ি-টুপি পড়া মানুষদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল এমন কথা ইতিপূর্বে কখনও জানা যায়নি।
রক্তমাখা সাদা পাঞ্জাবী গায়ে মাথায় টুপি পড়ে হাতে দুইহাত লম্বার রামদা নিয়ে কচি খন্দকার (ছবিতে জামায়াতের চরিত্রে অভিনয়কারী) যখন আজাদ আবুল কালামকে নির্দেশ করছে তারই কর্তা এটিএম শামসুজ্জামানকে জবাই কর- তখন যে কারও অনুভূতি নড়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবতায় যা একেবারেই অলীক। ১৯৭১ এ জামায়াতের নৃশংসতামূলক কোনপ্রকার নির্দেশনা ও কর্মকান্ডই ছিল না বরং দেখা গেছে যুদ্ধবিরোধী প্রকাশিত একটাকা সাইজের একটি লিফলেট যা হাতে হাতে পৌঁছে দিয়ে দেশে যুদ্ধের বিপক্ষে জনমত তৈরির একটি প্রচলিত রাজনৈতিক চেষ্টা করতে।
‘গেরিলা’ ৭১ এর নৃশংসতাকে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার হাতে না ঘটিয়ে কিছু ভয়ঙ্কর মেকআপের ও হুজুর গেটআপের মানুষদের দ্বারা চিত্রায়িত করেছে যা আমাদের মুক্তিযুুদ্ধের ইতিহাসের সাথে সাংঘর্ষিক।
কিছু হত্যাকান্ডের দৃশ্যায়ন
‘গেরিলা’ ছবিতে মুক্তিযোদ্ধা কিংবা ছবিতে চিত্রায়িত ভালো চরিত্রগুলোকে হত্যার জন্য একটি মাত্র পদ্ধতি প্রদর্শন করেছে, যা হল জবাই। প্রতিটি হত্যাকান্ডের দৃশ্যেই হলভর্তি দর্শক কেঁপে উঠেছে, মায়েরা ছোট বাচ্চাদের চোখ চেপে রেখেছে, মনের অজান্তে অনেকেই অস্ফুট কাতর শব্দ বের করেছে মুখ দিয়ে। এক কথায় সেন্টিমেন্টাল প্রেসার তৈরি করে নিজের কথাটি দর্শকের মস্তিস্কে পুশ করার চিরাচরিত কৌশল।
ছবিতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত দলসহ অস্ত্রসজ্জিত মুক্তিযোদ্ধার দল প্রদর্শিত হয়েছে একটি- খোকন কমান্ডারের দল। ছবিতে এরকম মুক্তিযোদ্ধা হত্যাও হয়েছে একটি তথা খোকনকে হত্যা করা হয়েছে। আর এটিই করানো হয়েছে দাড়ি-টুপি পড়া মানুষের হাতে ধারালো রামদার নিচে। যে ব্যাপারটি অন্যসকল মুক্তিযোদ্ধা হত্যার প্রতীকী দৃশ্য হিসেবেও চালিয়ে দেয়া যেতে পারে। আর তাতে ব্যাপারটি দাঁড়ায় এমন যে, মুক্তিযোদ্ধা হত্যায় সামরিক বাহিনীর থেকে হুজুররা বেশি তৎপর- যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে সাংঘর্ষিক।
স্বাধীনতা ও ইসলাম এর দ্বান্দিক পটভূমি সৃষ্টি
‘গেরিলা’ ছবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কিত দিকটি হল, ইসলামের ঋণাত্মক চিত্রায়ন। ছবিতে মানুষ জবাই করার সময় খুব জোর দিয়ে আল্লাহু আকবার কিংবা আল্লার নামে জবাই দেয়ার ব্যাপারটি উঠে এসেছে। যা দেখলে স্বাভাবিকভাবেই মনের অজান্তে গোটা ইসলামের প্রতি মানুষের মন বিষিয়ে উঠবে। ছবিতে দেখা যায়, মানুষের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ শ্লোগান উঠছে। এমনকি বার কতেক ‘জিহাদ’, ‘গণীমত’ ইত্যাদি ইসলামিক টার্ম ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া, দাঁড়ি-টুপি-পাঞ্জাবীওয়ালাদের ভিলেন চিত্রায়িত করা হয়েছে।
ট্রেনের দৃশ্যে ট্রেনটি এক স্টেশনে এলে খাকি পোষাক পড়া দুই লোক উঠে সবাইকে চেকআপ করে। তাদের একচোখ নষ্ট নেতা একজনের ছাগল, একজনের রেডিও নিয়ে যায়, এক মেয়েকে ধরেও নিয়ে যায়- একই সাথে সে বোরকা না পড়ায় এবং টুপি না পড়ায় কিছু যাত্রীদেরকে তিরস্কার করে, এমনকি তাদেরকে ইসলামের পথে আসার আহ্বান জানিয়ে বলে ‘ঐসব বেইসলামি পোশাক ছাড়ো বাপু, ইসলামের পথে আসো বাপু’।
ট্রেনে যাত্রীদের মধ্যে একজন তার হিন্দু মেয়ে ধরে নিয়ে যাওয়াকে সমর্থন করে বলে ‘ঠিকই তো, তুই হিন্দু, আমাগের দেশে তুই থাকপু ক্যা, তুই থাকপি ভারতে’। এরপরে সে ট্রেনে ওঠা ক্যানভাসারের কাছ থেকে কৃমির ওষুধও নেয়। এইভাবে চিত্রায়িত খারাপ মানুষটিকে কিন্তু ক্যামেরার সামনে হাজির করা হয়েছে টুপি-পাঞ্জাবী আর বিশাল দাঁড়িওয়ালা অবস্থায়।
নাসিরউদ্দিন বাচ্চুর এই পন্থায় ইসলামকে মানুষের কাছে খারাপভাবে উপস্থাপন করার প্রয়াস দেখে সবার জানা ঐ কৌতুকটির কথা মনে পড়ে যায়:
বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দুই নেতা কথা বলছে। বিএনপি নেতা বলছে, ‘আমি সবসময় টেক্সিক্যাবে যাতায়াত করি। সে সময় আমি চালকের সাথে মধুর ব্যবহার করি, তার পরিবারের খোঁজখবর নেই, ভাড়া দেবার সময় বিশটাকা বাড়িয়ে দেই। তারপর নেমে যাবার আগে বলি, বিএনপিতে ভোট দেবেন।’ আলীগ নেতা তাই শুনে বলছে, ‘আরে আমিও তো আপনার মতই, আমিও ট্যাক্সিতে চড়ি। কিন্তু ট্যাক্সিতে উঠেই তাকে শুধু শুধু গাল দেই, সারারাস্তা বিড়ির ধোয়ায় তাকে অতিষ্ট করি, ঠিকমত চালানোর জন্য চ্যাচামেচি করি, পানের পিক ফেলে সিট নষ্ট করে দেই, ভাড়া দশ টাকা কম দিয়ে নামার বেলায় আপনার মতই বলি- ঐ গোলামের পুত বিএনপিতে ভোট দিবি।’
৬. ছবি তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন
‘গেরিলা’র বিতর্কিত দিকগুলো ভালো করে বোঝার চেষ্টা করলে যে কেউ বুঝতে পারবেন এটি বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত সিনেমাটি তৈরির উদ্দেশ্যটি কী- মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি তৈরি নাকি দেশের সর্বস্তরের জনতার সংবেদনশীল অনুভূতির জায়গাটিকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার হাস্যকর ও জামিনযোগ্য মামলায় গ্রেফতারকৃত জামায়াত কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনে যখন সেটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে পরিণত হয়েছে তখন এমন একটি রাজনৈতিক মদদপুষ্ট ছবিটি যে জনমনে প্রভাব ফেলার একটি মোক্ষম অস্ত্র তা বোঝার অসাধ্য নয়। দলীয় মত প্রকাশের অনুষ্ঠানে টাকা খরচ করেও যেখানে লোক জমায়েত করা সম্ভব হয় না, সেখানে আমার কথা শুনতে দলে দলে মানুষ টিকেট কেটে হলে আসবে- ব্যাপারটি যে কারও জন্যেই আনন্দদায়ক। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারের জন্যে ‘গেরিলা’ তো আরও বেশি আনন্দ বয়ে এনেছে বলে বোঝা যায়।
৭. সরকারের দৃষ্টিকোণে বাচ্চু
নাসির উদ্দিন বাচ্চুর প্রতি সরকারের স্নেহাশীষ দৃষ্টি খুবই স্পষ্ট। প্রথমত তাঁর স্ক্রিপ্ট ও পরিকল্পনাতেই সরকার যারপরনাই খুশি হয়ে ছবিটির অনুদানের ব্যবস্থা করেছে। অতঃপর নির্মাণ শেষে চাওয়ার চেয়ে একটু বেশি পেয়ে যাওয়ায় আনন্দ আর ধরে রাখতে না পেরে ছবিটি প্রদর্শনে সিনেমা হলের কর মাফ করে দিয়েছে। আর এখন মিডিয়া হুমড়ি খেয়ে ছবিটির আর বাচ্চু সাহেবের গুণকীর্তনের ঢোল বাজিয়ে চলছে।
৮. পরিশিষ্ট
এর আগে ১৯৯২ সালের দিকে জামায়াতে ইসলামীকে ইঙ্গিত করে নির্মিত ছবি ‘ঘাতক’ এ জামায়াত নেতৃবৃন্দের ন্যায় মেকআপে এমনভাবেই চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামী ছবিটির বিরুদ্ধে মামলা করলে সারাদেশে একযোগে ছবিটি প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘গেরিলা’ একটি একচোখা রাজনৈতিক ছবি। আমরা চাই না, আমাদের সংস্কৃতি রাজনীতির কলঙ্ক নিজমুখে ধারণ করুক। আমাদের সংস্কৃতি হোক সকল পদলেহন মুক্ত সুস্থ্য ধারার সংস্কৃতি, যা সমাজের বিবেকরুপে কাজ করবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





