উৎসব জমিয়ে তোলে বিয়ে, কাউকে রাজা করে কাউকে রাণী। প্রায় মানুষের কাছে জন্মের মত উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল বিয়ে। সমাজবিদ্যা বা অন্যান্য বিদ্যাস্কুল এই বিয়ের কতইনা ফিরিস্তি দিল, কেউ বলছে ইহা এক প্রকারের বন্ধন, কেউ বলছে সন্তান দান, লালন পালন নিমিত্তে ইহা একখানা স্থায়ী বন্ধুত্ব, কেউ বলছে ইহা সামাজিক সুরতে দৈহিক চাহিদা পূরণীয় সংগঠন; ব্যতিক্রমী কেউ অবশ্য সাহস করে মূল কথাটাই বলে দিল- বিয়ে হইল বৈধ গণিকা বৃত্তি। পুরাকালীন ধর্মবৎ লেকচারগুলোতেও বর্ণিত আছে পুরুষের পাঁজর হইতে নারী সৃষ্টি (একই অঙ্গ বলা যেতে পারে), বিয়ে বিভাজিত অঙ্গের পুনরায় একত্রিকরণ। যথা, তথা আলোচনার হাত, ঠ্যাং বহুপাশদিয়ে যেতে পারে তবে আমার আলোচনা ওদিকে না। বিয়ের সুন্দর লেবাসের বহুত কাহিনী চোখে জমিয়ে রেখেও ওটাকে অত ভালকিছু ভাবতে পারছি না। আশ-পাশ, পত্র-পত্রিকা আমাকে জানান দিচ্ছে বিয়ের উৎসব যাকে তোমরা বলে বেড়াচ্ছ তা তো একটা নারীর মরণযাত্রার আগাম বিলাপ; হলুদ, মেহেদী, আলতার যে রং সে তো পোড়নপ্রিয় আগুনের লেলিহান শিখা।
দেহের আবরণে হৃদয় জোড়ার সামাজিক কর্মটি বিয়ে; স্থায়ী বসবাসের লক্ষ বলে হৃদয়ে হৃদয় জোড় পাতানো আবশ্যিক। মানব মানবীর নিবিড়তম এ সম্পর্কের মূল বাণী এটাইযে- বন্ধুর পথ পাড়ি দাও বন্ধুত্বের সূত্র মেপে। একে অপরকে উজাড় করে কাছে কাছে থাকা, মনোদৈহিক বেদনায় একে অপরের উপশম হওয়া ইত্যাদি মন্ত্রের দাবিগুলো দিনকে দিন অসার হয়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদী দৌড়ঝাঁপের ফাঁপড়ে পড়ে পুরুষগুলো হয়ে পড়ছে পাগলা কুকুর- তাদের কাণ্ডজ্ঞানহীনতা, কূপমণ্ডুকতা আর পাশবিকতার ফলে ধ্বংস হচ্ছে এক একটি মানব প্রতিমা। তিনি স্বামী, তিনি রাজা মহারাজ, নিজেকে উজাড় করবে কী, স্ত্রী তো সন্ত্রস্ত তার বিষ দাঁত দেখে কখন কামড় দিয়ে খাবলে নেবে সোনার দেহ। আড়াল নীতি গ্রহণ করতে হচ্ছে স্ত্রীকে, প্রভুর আগ্রাসী মানসিকতার জন্য।
দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে নারীর উপর স্বামীর নির্যাতনের মাত্রা। মানসিক তো আছেই বর্তমানে ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে দৈহিক নির্যতনের মাত্রা। খবরপত্রের প্রায় প্রতিদিনকার পাতায় পাচ্ছি নির্যাতিত নারীর মৃত্যুর খবর। যৌতুক, সন্দেহ বা সামান্যতম ঘরকন্নার দোষে স্বামীর হাত উঠছে স্ত্রীর উপর। নির্মম পন্থায় চলে এ নির্যাতন। বহির্জগতে ভেজাবেড়াল পরিচিত পুরুষটিও তার স্ত্রীর সামনে বাঘরূপ লাভ করছে। পত্রিকার কিছু জানা খবর (হয়ত) আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
৮ আগস্ট (মানিকগঞ্জ)
৭ আগস্ট বিয়ে হয় রুনার। মাত্র একদিনের ব্যবধানে, মেহেদির দাগ মোছার আগেই বর্বর স্বামীটি তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। যৌতুকের মাত্র বিশ হাজার টাকা বাকি ছিল বলে তাকে জীবন দিতে হল। জীবনের দাম বুঝি শুধু বিশ হাজার?
১৭ আগস্ট (কুড়িগ্রাম)
যৌতুকের ৫০ হাজার টাকা না পেয়ে স্ত্রীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়েছে স্বামী। পোড়া শরীর নিয়ে কতোদিন বাঁচবে মেয়েটি কে জানে। ছ বছরের দাম্পত্য সম্পর্কে একফোঁটা মায়াও কি জন্ম নেয়নি পশুটার মনে?
২১ আগস্ট (সিলেট)
পরকীয়া করত সন্দেহ করে রাগের মাথায় স্ত্রীকে গলাটিপে হত্যা করেছে স্যানিটারি মিস্ত্রী ইলিয়াস। হত্যা করে নিজেই পুলিশকে খবর দেয়। তাদের এক বছর বয়সী একটি সন্তানও আছে। কি হবে সন্তানটির ভাবি জীবন?
২৬ আগস্ট (নওগাঁ)
চাচাত ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়েছিল শাকিলার। বিয়ের আগে যৌতুক না চাইলেও, বিয়ে পরবর্তী ৫০ হাজার টাকা দাবি করে বসে তার স্বামী। ৩০ হাজার টাকা আদায় করে বাকিটার জন্য শাকিলাকে চাপ দিতে থাকে। গালাগালের পাশাপাশি চালায় শারীরিক নির্যাতন। মারধরের একশেষে শাকিলার মৃত্যু হয়। জীবনের ১৮টি বছর মাত্র পৃথিবী দেখার সুযোগ পেয়েছিল শাকিলা। বেঁচে থাকা এতোই কি কঠিন?
২৯ আগস্ট
অনেকে মনে করেন নারী নির্যাতন হয় অশিক্ষিত পরিবারে। কিন্তু প্রকৃত তা নয়, শিক্ষিতজন আরো ধুরন্ধর, তার নির্যাতন হয় আরো সুপরিকল্পিত, গূঢ়। চিকিৎসক তামান্নার মৃত্যুটা উদাহরণ হিসেবে আনা যায়। চিকিৎসক স্বামী এবং তার শিক্ষিত বাবা মার দেয়া প্রতিদিনকার মানসিক পীড়ন সহ্য করতে না পেরে গলায় ফাঁস দিয়েছে। যৌতুকের মালামালে কমতি পড়ায়, একটা ফ্ল্যাট বাড়ি না জোটায় তামান্নার উপর সবসময়ই চলত মানসিক নির্যাতন কখনোবা মারধর। এসব এমন বিষ হয়ে উঠেছিল যে দেড় বছরের ছেলের মায়া কাটিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে দ্বিধা করেনি। তামান্না। আহা তামান্না!
১০ সেপ্টেম্বর (নোয়াখালী)
চার বছরের দাম্পত্য জীবন ছিল মুন্নির। এর ভেতর আড়াই লক্ষ টাকার যৌতুক পেয়েও স্বামী পাষাণটার উদর ভরেনি। ক্রমাগত যৌতুক দাবি আর নির্যাতন করত তারা। দুই বছরের জুঁই- এর দিকে তাকিয়েও তাদের মায়া হয়নি, পিটিয়ে মেরে লাশ ঝুলিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা বলে প্রচার করে দিল।
১৫ সেপ্টেম্বর (চট্টগ্রাম)
গার্মেন্টস কর্মী খুশী খুন হয়েছে দাম্পত্য কলহের জের ধরে। স্বামী বলছে রাগের বশে স্ত্রীকে খুন করেছে। স্বামী রাগবে আর খেলনা গুড়ো করার মতো স্ত্রীকে খুন করবে, এতই তুচ্ছ একটা জীবন?
২০ সেপ্টেম্বর-১ (ঢাকা)
স্বামীর দেয়া আগুনে সারা শরীর দগ্ধ হয়েছে সালমার। তার গায়ে কেরোসিনের গন্ধ পাওয়া গিয়েছিল। স্ত্রী তো আর মানুষ না, যেভাবে পার মারো কাটো।
২০ সেপ্টেম্বর-২ (ঢাকা)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে দেশের এক একটি সোনার খনি। দেশ জাতির জন্য তারা বয়ে আনবে সম্মান, সম্পদ গৌরব এটাই সকলের প্রত্যাশিত। সুতপা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী। দাম্পত্য কলহের জের ধরে খুন হয়েছে স্বামীর হাতে (যদিও বলা হচ্ছে আত্মহত্যা)। মেধাবী মেয়েটির বদমেজাজী স্বামীর অমানবিক প্রভুগিরীর চাপে সে পিষ্ট হচ্ছিল। স্বজন বন্ধুদের সে বলেছিল তার দুর্বিষহ জীবন যাপনের কথা, বেঁচে থাকার তুমুল কষ্টের কথা। শিক্ষিত, শান্ত মেয়েটির সংসার জীবন বছরখানেক পার না হতেই মৃত্যুর পথে নামতে হয়েছে। তার জীবন পতনে সংসারের যা ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে বেশি হয়েছে দেশের।
উপরোক্ত খবরগুলোতে নারী নির্যাতনের বেশির ভাগ কারণ অনাদায়ী যৌতুক। সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে, সুশীল হচ্ছে এসব কথা যে সব হাদারাম বলে বেড়াচ্ছে তাদের বলি- না মানুষ সামনে যাচ্ছে না, ক্রমাগত পেছনে পা ফেলছে, আদিম হচ্ছে, বুনো হচ্ছে। তা না হলে এত প্রচার এত উদাহরণ তারপরও কী করে যৌতুকের কারণে নির্যাতন একের পর এক হয়েই যাচ্ছে? কথাটা বলা উচিত ছিল যৌতুক দেয়া নেয়া কী করে চলছে, কিন্তু অত আশা করতে পারছি না, কারণ মানুষ লোভী, অর্থ অর্জনের এমন মেগা অফার হাতছাড়া করতে চাইবে না।
যে যৌতুক নিচ্ছে তাকে দেখা যাচ্ছে যে কোনভাবে যৌতুক দিতেও হচ্ছে। পয়সাপাতি যাদের মেলা আছে যৌতুক দিলে তাদের গায়ে আঁচড়ও লাগে না, কিন্তু যাদের দানা-পানি যোগাতেই অঙ্গ কালা হয় তাদের যে অস্তিত্বই মুছতে বসে। ভাবমারা বেশ কজনকে দেখি যৌতুক নেয় না বলে বেড়ায়, খবর নিলে দেখা যায় শ্বশুর পক্ষের আসবাবে তার ঘর ভর্তি। এছাড়াও পালা পার্বণে শ্বশুর পক্ষের গিফট না পেলে বিস্তর রেগে উঠেন। ক্যাশ টাকাই শুধু যৌতুক এমন নয়, শ্বশুর বাড়ি প্রদত্ত হালকা হাওয়াই মিঠাই ছাড়া সবগুলোতেই মূলত যৌতুক (হেসে বা রেগে যেভাবেই গ্রহণ করুন না কেন)।
এ দেশে প্রচার শিক্ষায় কাজ হবে না, আইনের কঠিন থাপ্পড় না পড়লে যৌতুক কখনোই কমবে না। শিক্ষাসহ অন্যান্য ওজনদার ক্ষেত্রের বিদ্যা না পেলে নারীর মূল্য বাড়বে না। জীবন ধারণের স্বাধীনতা কি জিনিস বেশির ভাগ মানুষই জানে না, তারা প্রভুত্ব খোঁজে। সমাজের দুর্বল আচার সংস্কৃতির চাতালে পুরুষ সুযোগ পেয়েছে, শিক্ষিত অশিক্ষিত সকল মহলের পুরুষ নারীর উপর স্বৈরশাসন চালিয়ে যাচ্ছে। নারী নির্যাতনের অন্যতম কারণ এই মনোবৃত্তি। স্ত্রীর মনোভাবকে থোড়াই কেয়ার করে চাপিয়ে দেয় স্বচিন্তা, স্ব মনোভাব যা মোটেও সুবোধ নয়। অন্যের মনোভাবনা, অন্যের জীবনকে মূল্য না দিলে মানুষের সভ্য হওয়ার দাবি তো ম্লান হয়ে যাবে। যাবতীয় হত্যা, নির্যাতন আর অন্যায়ে আসুন আমরা প্রতিবাদ করি।
ইয়াসিন আরাফাত
আলোচিত ব্লগ
কে কাকে বিশ্বাস করবে?
করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।
সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিসিএস পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বসতে না পারার কষ্টটা সমালোচনার কোন বিষয়বস্তু নয়
গতকালের একটি ভাইরাল খবর হচ্ছে কয়েক মিনিটের জন্য বিসিএস পরীক্ষা দেয়া হলো না ২০ প্রার্থীর !! অনেক প্রার্থীর কান্নাকাটির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।এ বিষয়ে পিএসসি চেয়ারম্যান এর নিয়ামানুবর্তিতার জ্ঞান বিতরনের... ...বাকিটুকু পড়ুন
বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ
ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন
সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?
আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন
পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?
রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন