somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্যা নোটবুক-১০, মুদ্রাদোষ - দূষণীয় অসুখের পোষণ নয়,পরিত্যাজ্যতা কাম্য।

২৭ শে অক্টোবর, ২০১৯ সকাল ১০:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মুদ্রাদোষ - দূষণীয় অসুখের পোষণ নয়, পরিত্যাজ্যতা কাম্য।

মুদ্রাদোষ, ইরেজিতে যাকে বলে Mannerism বা peculiar habit, আমরা জানি মুদ্রা মানে আধুলি বা কয়েন আর দোষ’ মানে - বদ অভ্যাস। এই দুটি শব্দের মিলিত রূপই হলো মুদ্রাদোষ। তবে সার্বিক অর্থে এখানে আলোচ্য মুদ্রাটি ভিন্ন । নৃত্যের মূল শিক্ষা 'মুদ্রা' মানে নিদিষ্ট প্যাটার্ন, ধরন, ধাঁচ, ঢং, অঙ্গ ভঙ্গি । নৃত্যের মুদ্রার সঙ্গেই মুদ্রাদোষ শব্দটা সম্পর্কিত। বলা হয়ে থাকে, সব মানুষের মাঝে কিছু না কিছু মুদ্রাদোষ আছে। যেমন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, বাজে ডিসিশন নেবার হার কমানোর জন্য সবসময় একি ধরনের স্যুট পড়তেন। বিল গেটস যখন মাইক্রোসফটের সিইও ছিলেন তখন তিনি প্রতিবছর এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে কোন প্রকার বিরক্তি ছাড়া তক্তার উপর বসে চিন্তা করতেন ।
অনেকেই এক কদম বাড়িয়ে এগুলোকে জন্মগত দোষ বা বংশগত বৈশিষ্ট্য হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন। তবে তা সত্যি কি না সে বিষয়ে বিশ্লেষণের প্রয়োজন রাখে। আমাদের অনেক নামি-দামি কবি ও সাহিত্যিকগন তাদের লেখায় একি শব্দের বহুলাংশে ব্যবহার করেছেন। সাহিত্য বিশ্লেষকরা এগুলোকে বিশেষ ধরনের মুদ্রাদোষ হিসাবে অভিযোগ তুলে ধরেন। যদিও মুদ্রাদোষ নিয়ে আমাদের দেশে স্টাডি বেশ সীমিত। তবে মানুষের শারিরীক ও মানসিক দিক বিবেচনা করে মুদ্রাদোষকে মূলত নিম্নোক্ত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়-
ভাষাগত মুদ্রাদোষ -
ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, বক্তার কথা বলার সময় তারা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে কিছু শব্দের ব্যবহার অতিরিক্ত মাত্রায় যোগ হয়। এইসব শব্দের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে শ্রোতাকে বিরক্ত করে তুলে। এই ধরুন অনেকেই বলে, আর বলেন না 'আপনার' আজকে দিনটি বেশ খারাপ আপনার - এখানে আপনার শব্দটি মুদ্রাদোষ। রাবিশ, আর খবিশ এই দুটো বেশ পরিচিত শব্দ। ভিআইপিদের মুখ থেকে নিসৃত এই বাক্যগুলো সমাজে অনেক বিনোদিত ও বিদ্রুপাত্মক হয়েছে। যেমন - 'অল আর রাবিশ' বা 'দ্যাট'স টোটালি রাবিশ শুনলে অনেকে দিস ইজ মাল টক বলে থাকেন। আরেকজন মাল (George Mahl), যিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী। মানুষের ভাষাগত ত্রুটি বিচ্যুতি- নিয়ে বিশদ কাজ করেছেন। তার মতে এগুলো হলো, Speech disturbance বা ভাষাগত গোলযোগ। এইসবকে তিনি আটটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করেন। এই সকল গোলযোগ-এর মধ্যে ৪০ শতাংশ হচ্ছে ফিলার। ফিলার হলো সেই শব্দ বা শব্দসমূহ যেগুলো কথা বলার সময় অযথা নীরবতার পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়ে বক্তাকে চিন্তাভাবনা করতে যথেষ্ট সময় দেয়। যেমন- বাংলাতে ‘ইয়ে’, মানে, অউয়, হুম, হচ্ছে, শব্দগুচ্ছ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফিলার হিসাবে কাজ করে। মালে'র গবেষণায় সবচেয়ে uh আর um ফিলার দুটির ব্যবহার দেখা গিয়েছিল। এদিকে আরেক মনোবিজ্ঞানী জেমস পেনবেকার (Secret life of pronouns) নামক বইয়ে দাবি করেছেন, যেসকল লোকের ভাষার ব্যবহারে বিঘ্ন ও জড়তা সম্বলিত তাদের বুদ্ধিমত্তা সাবলীলদের চেয়ে বেশি। এবং তারা নাকি গভীর চিন্তাশীল মনের অধিকারী।

শারিরীক মুদ্রাদোষ -
শরীরগত কসরতের ক্ষেত্রে নানান জনের নানান হাবভাব পরিলক্ষিত হয়। অনেকের অপ্রত্যাশিত কিছু একটা চোখে পড়লে তা সবার কাছে বিচিত্র মনে হয়। যেমন- অনেকের হাত কচলানো, ঠোঁটে ঠোঁটে চিমটি কাটা,ঘনঘন চোখের পাতা টিপতে থাকা। অনেক সেলিব্রিটি বক্তব্য দোওয়ার সময় বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করেন।দেখা যায় কেউ বারবার সার্টের কালার চেপে ধরেন৷ আবার কেউ কেউ সার্টের হাত ভাজ করতে থাকেন। যেমন - কথা সাহিত্যিক মুজতবা আলী তার হাতের চাবি দিয়ে তর্জনীর উপর নিয়ে বারবার ঘুরাতেন।এগুলোকে প্রথম প্রথম দেখতে দৃষ্টিকটু মনে হলে পরবর্তীতে তা সহনীয় হয়ে ওঠে।

অনুকরণীয় মুদ্রাদোষ - কোন একটি বিশেষ শব্দ সমাজে বহুল পরিমাণে প্রচলিত হলে তাকে অনুকরণীয় মুদ্রাদোষ বলা যায়৷ উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ইচ্ছে ও অনিচ্ছায় কোন নিদিষ্ট লিঙ্গকে অনেকেই 'মাল' বলে থাকেন। যেমন - দোস্ত !দেখ মালটা বেশ জটিল ! এই আজব মালটা কোথা থেকে আমদানি হলো ? আবার কাউকে জিনিয়াস হিসাবে তুলনা করতে অনেকসময় বলা হয় 'সে একটা মাল,বা তার মাথায় মাল আছে, এগুলোকে অনায়াসে অনুকরণীয় মুদ্রাদোষ বলা যায়।

মুদ্রাদোষ কি পরিহারযোগ্য -
No one is perfect, কেউই নিখুঁত ও পরিপাটি নয়৷ সবারই বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু না কিছু দূর্বলতা আছে। একজন চাইলেই যেমন চাঁদে আরোহন করতে পারেনা। তেমনি চাইলেই গুণী হওয়া যায়না। তারজন্য প্রয়োজন সাধনা ও একাগ্রতা। আমাদের চলনে-বলনে একটু যত্নশীল,আরো একটু সর্তক হলে বিভ্রম কেটে ওঠা সম্ভব। তবেই মুদ্রাদোষ নামক অতি সামান্য দোষ পরিত্যাগ করা মোটেই অসম্ভব কিছু নয়।
প্রাসঙ্গিক ঘটনা -
হাবিব স্যার ফার্মগেট থেকে বাসে করে মিরপুর যাচ্ছেন। পথিমধ্যে নীল শাড়ি পড়না এক সুন্দরী ললনা বাসে চড়লেন৷ হাবিব স্যার মেয়েটিকে দেখে মনে মনে দোহাই আল্লাহ বলতে লাগলেন। যদিও প্রথমবার মেয়েটির চোখে চোখ পড়াতে হাবিব স্যার একটি চোখ টিপে দেয়াতে মেয়েটির আঁতে লাগলো। হাবিব স্যার বাসের জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে চেয়ে স্বল্পবাসনা নারীদের নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। মেয়েটি তাকে লক্ষ্য করে দেখলো স্যার চোখ টিপে যাচ্ছে। একবার দু বার তিনবার দেখতে দেখতে মেয়েটির সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেলো। শেষবারে হাবিব স্যারের চোখে পড়লে মেয়েটি সিট থেকে উঠে এসে ধাপাস করে স্যারের গালে বসিয়ে দিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে হাবিব স্যারের হুঁশ ফিরে এলো। মেয়েটিকে বসের যাত্রীরা জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে- সে বললে দেখেন না বদমাশটা চোখ টিপতেই আছে। সবাই ভালো করে দেখতে পেলো এটা তো হাবিব স্যার ইচ্ছে করে দিচ্ছে না। এটা তার একটি বদ অভ্যাস। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই বিব্রতবোধ করলো।

পরোক্ষ ঘটনা -
জনাব কয়সর চৌধুরী। দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে লন্ডনে থাকেন। এবার একটি বিয়ের ফায়সালা হয়ে যায় এমন অবস্থা। কনের পরিবারের সাথে ফাইনাল কথাবার্তার দিন তিনি হবু শশুর বাড়ি গেলেন। কনের সাথে সাক্ষাৎ পর্ব শেষে হবু শাশুড়ের সামনে সোফায় বসে আছেন। শাশুড় সাহেব লক্ষ্য করলেন কয়সর চৌধুরী তার হাঁটু নেড়েই চলছেন। মনে মনে বেয়াদব গালি দিয়ে তাকে বিদায় করে দিলেন। বিয়ের বিষয়ে না করে দেওয়াতে চৌধুরী সাবের পক্ষ থেকে কারণ জানতে চাওয়া হলো। হবু শাশুড় বলে দিলেন বেয়াদবটা আমার সামনে কি ঢংয়ে পা নাড়াচ্ছিল দেখেননি। বিয়েটা হয়নি উপরন্তু চৌধুরী সাবকে শুনতে হয়েছে কটু কথা ও তিরস্কার বাণী।
প্রত্যক্ষ ঘটনা -
কিছুদিন আগে আমার অফিস সহকর্মী চেয়ারে বসে হাঁপাচ্ছে। সবাই হুলস্থুল করে ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলো - কি ব্যাপার? সে কিছু না বলে কেঁদেই চললো। পরে জানা গেলো অফিসের লিফটের কাছে উপর তলার এক স্টাফকে সে হ্যালো বলেছিল। লোকটা 'হাই' বলে হাত বাড়িয়ে দেয়। হ্যান্ডশেক করে চলে যাবার সময় লোকটি তার বাহুর পাশে স্পর্শ করে। তাতেই তার মুড অফ হয়ে যায়। সে মনে করে যে, লোকটি তার স্পর্শকাতর স্থানে ইচ্ছাকৃতভাবে হাত দিতে চেয়েছে। সহকর্মীকে সাথে করে অফিসের সবাই একসাথে উপর তলায় গিয়ে হাজির। ষাটোর্ধ বয়সের লোকটিকে জিজ্ঞেস করতে তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। সে বেশ স্বাভাবিক যেন এইসবের কিছুই জানে না। ফলে সবার রাগের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলো। এবার পুলিশ কল করে এবিউজিংয়ের নালিশ দেয়া হবে এমন অবস্থা। কিছুক্ষণ পর লোকটির ম্যানেজার মহিলা এলেন। তিনি বিস্তারিত জানার পর, যখন লোকটিকে জিজ্ঞেস করছিলেন এমন সময় সে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। সে বললো তার সামান্য কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই। কারো গায়ে হাত দিয়ে কথা বলটা নাকি তার অভ্যাস। ম্যানেজার সেটা জানেন বলে স্বীকার করলেন। এবং এমন ঘটনায় অবাক ও বিব্রত হলেন । লোকটার কাছ থেকে লিখিত নিলেন, কখনো যেন অফিস এলাকায় কাউকে গায়ে হাত দিয়ে কথা না বলে। ঘটনাটি সেদিনের মতো শেষ হলেও তা উভয়ের জন্য ছিলো আজীবনের শিক্ষা।

নোট --
১) কারো দোষ-ত্রুটি নিয়ে আজগুবি কেচ্ছা না রটিয়ে বরং আত্মোপলব্ধি করা উচিৎ।
২) কাউকে অক্ষম বা অকর্মা বলার আগে নিজের সক্ষমতাকে যাচাই করা জরুরী ।
৩) সমাজের অসঙ্গতি নিয়ে যুক্তি-তর্ক না করে যৌক্তিক সমাধান প্রয়োজন।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১:২১
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমিও যাবো একটু দূরে !!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২২

আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×