somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্যবধানে ব্যবধান

০৪ ঠা জুন, ২০০৭ দুপুর ১:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার পাগল ভাইয়ের হাত-পায়ে শেকল, আর মা ভাইয়াকে গোসল করানোর প্রাণান্ত চেষ্টায় মগ্ন। এই দৃশ্য ছিল বাসায় প্রায় প্রতিদিনকার। মায়ের চোখের জল যেন দেখতে না হয় সে জন্য দেরি করে বাসায় ফেরা, দরজা-জানালা বন্ধ করে এক বসে থাকা, ভাইয়ার চেঁচামেচির শব্দ যেন কানে এসে না পৌঁছে, সেই চেষ্টার অন্ত ছিল না। আমরা আর সব ভাইবোন কেমন জানি যান্ত্রিক হয়ে গেলাম হঠাৎ করেই। যেমন হঠাৎ করেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে আমার প্রিয় ভাইটা। বাবা তার অসহায় দু চোখ দিয়ে বড় ছেলের পাগলামি দেখেন।

এই ঘটনাটা ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়কার কথা। এখন গণ্ডিটা পেরিয়ে অনেক দূর এগিয়েছি। তবুও পিছু ফিরে দেখি এগুইনি এক রত্তি। এক ইঞ্চি। মুহূর্তগুলো এখনও আঘাত করে প্রতিনিয়ত। আমি ভুলতে পারি না সেই সময়গুলো।

এজন পিতা যখন তার বড় ছেলের মৃত্যু কামনা করেন, তখন বোঝা যায় তিনি কতটা অসহায়! মনে পড়ে আমরা যখন ভাইয়াকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি তখনকার কথা। পুরো পথ বাবার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে।

ভাইয়া বাবাকে বললো, “আমার তো অনেক দিন পাবনা হাসপাতালে থাকতে হবে তাই না বাবা? আমি তো পাগল! হয়তো আর ফিরেও আসতে পারব না! আমাকে এভাবে একা ফেলে রেখে যেতে আপনার কষ্ট হবে না ?”

ভাইয়াটা সেদিন একদম স্বাভাবিক আচরণ করছিল। ভাইয়ার একেকটা কথা আমার বুকের ভেতর হাতুড়িঘাত করছিল। আমাদের গাড়িটা যতই পাবনার দিকে ছুটছে ততই বাবার ব্যবহার অস্বাভাবিক হতে থাকে। আমরা হেমায়েতপুর চলে এসেছি। কয়েকজনের কাছে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল, পাবনা মানসিক হাসপাতালটা কোথায়? আমাদের গাড়িটা হাসপাতালের ফটকের সামনে এসে থেমেছে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাগলদের পাগলামি দেখছি। কেউ আজান দিচ্ছে, কেউ বকাবকি করছে, কেউ কেউ চুপচাপ বসে আছে, কেউ ...। আমি বাবাকে বললাম, ভাইয়াকে এখানে ভর্তি না করালে কি হয় না? বাবা খুব সাধারণ উত্তর দিয়েছিলেন, হ্যাঁ হয়। বাবা শুধু আমাদের কারো সমর্থন চাচ্ছিলেন। না, সেদিন ভাইয়াকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়নি। আমরা পাবনা শহরটা ঘুরে আপন শহরে ফিরে আসি। আসার পথে বাবার হাসি হাসি মুখ দেখে আমার কী যে ভালো লাগছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

ভাইয়া দেশের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। সক্রিয় বাম রাজনীতি বলতে যা বোঝায় তিনি তাই করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট আর রাজনীতির কল্যাণে দীর্ঘ সময়ে অনেকেরই প্রিয়ভাজন হতে পেরেছিলেন। শুধু চুশূল হয়েছিলেন একটি বিশেষ গোষ্ঠীর। শেষে তাদেরই মানসিক আর শারীরিক নির্যাতনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। আমি তখন মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করছি। অবশেষে দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদল্যালয়ে মোটামুটি বিষয়ে ভর্তির সুযোগও পেয়ে যাই।

কিন্তু পারিবারিক বিধিনিষেধের কারণে অবশেষে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। রাজনীতিতে কখনো জড়াব না- মায়ের কাছে দেওয়া এই প্রতিশ্র“তির কারণে সক্রিয় রাজনীতিতে আসিনি। কলমটাকেই ভালোবেসে নতুন হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছিলাম। সেখানেও বাধা! পত্রিকার খোলা কলাম আর অভিমত কলামে টুকটাক লিখতে শুরু করি। না, প্রচারের জন্য নয়, শুধু মনের তাগিদেই লিখতাম।

অনেক আগে ভাইয়া আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। এখনো খুব যতেœ আমি চিঠিটা রেখে দিয়েছি--

“কেমন আছিস রে তুই ?
তুই তো বিজ্ঞানের ছাত্র তাই তোকে জিজ্ঞেস করলাম।
আজ অনেক দিন যাব? ভাবছি।
আচ্ছা বাঁদুড় দিনে চোখে দেখে না কেন?
আর রাতেই বা কীভাবে দেখে? তাড়াতাড়ি উত্তর দিস।
আমি এ নিয়ে বিশেষ চিন্তার মধ্যে আচ্ছি।
ইতি...।

২৭ বছরের একজন যুবক বাচ্চা ছেলের মতো আমাকে প্রশ্ন করে চিঠি লিখেছে, আর সে আমার ভাইয়া আমি উত্তর দিতে পারিনি। সবার আগোচরে চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে। সেদিন একটিবারের জন্যও আমার চোখের জল থামাতে চেষ্টা করিনি, আমি কেঁদেছি শুধু আমার পাগড় ভাইয়ার জন্য।

অনেকদিন পর ভাইয়ার সেই কথাগুলো আবার মনে পড়ছে। মাঝখানে সুস্থ ছিলেন। তখন বিয়েও করেন তিনি। ভালোই ছিলেন। আবার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলায় ডিভোর্স হয়ে যায়। তারপর আবার সুস্থ হলেও বাচ্চাটার জন্য এখন পাগল প্রায়।

ও হে ওর মেয়ে নুসরাত। হেভি ট্যালেন্ট।

এখনও আমার সবচেয়ে বড় এবং প্রিয় ভাইটার এই অবস্থার জন্য ঘুমাতে পারি না। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে একটা টং দোকানে বসে থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মনে করি।

সে সময় টং দোকান থেকে দেখতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসগুলো চলে যাচ্ছে। আমার আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া নিষেধ। তখন নীরবে চোখ ভিজে আসতো। আমি একা! আমার আগে-পিছে কেউ ছিল না। বন্ধু! তারা সব লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। আমি অস্পৃশ্য! অনেক পথ পেরিয়ে আমি আবারও সেই শুরুতেই ফিরে যাচ্ছি।

শুধু এবারের চরিত্র আর মঞ্চটা ভিন্ন। কাহিনী সেই একই। শুধু ব্যবধান ছয় বছর।
৪১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×