আমার পাগল ভাইয়ের হাত-পায়ে শেকল, আর মা ভাইয়াকে গোসল করানোর প্রাণান্ত চেষ্টায় মগ্ন। এই দৃশ্য ছিল বাসায় প্রায় প্রতিদিনকার। মায়ের চোখের জল যেন দেখতে না হয় সে জন্য দেরি করে বাসায় ফেরা, দরজা-জানালা বন্ধ করে এক বসে থাকা, ভাইয়ার চেঁচামেচির শব্দ যেন কানে এসে না পৌঁছে, সেই চেষ্টার অন্ত ছিল না। আমরা আর সব ভাইবোন কেমন জানি যান্ত্রিক হয়ে গেলাম হঠাৎ করেই। যেমন হঠাৎ করেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে আমার প্রিয় ভাইটা। বাবা তার অসহায় দু চোখ দিয়ে বড় ছেলের পাগলামি দেখেন।
এই ঘটনাটা ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়কার কথা। এখন গণ্ডিটা পেরিয়ে অনেক দূর এগিয়েছি। তবুও পিছু ফিরে দেখি এগুইনি এক রত্তি। এক ইঞ্চি। মুহূর্তগুলো এখনও আঘাত করে প্রতিনিয়ত। আমি ভুলতে পারি না সেই সময়গুলো।
এজন পিতা যখন তার বড় ছেলের মৃত্যু কামনা করেন, তখন বোঝা যায় তিনি কতটা অসহায়! মনে পড়ে আমরা যখন ভাইয়াকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি তখনকার কথা। পুরো পথ বাবার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে।
ভাইয়া বাবাকে বললো, “আমার তো অনেক দিন পাবনা হাসপাতালে থাকতে হবে তাই না বাবা? আমি তো পাগল! হয়তো আর ফিরেও আসতে পারব না! আমাকে এভাবে একা ফেলে রেখে যেতে আপনার কষ্ট হবে না ?”
ভাইয়াটা সেদিন একদম স্বাভাবিক আচরণ করছিল। ভাইয়ার একেকটা কথা আমার বুকের ভেতর হাতুড়িঘাত করছিল। আমাদের গাড়িটা যতই পাবনার দিকে ছুটছে ততই বাবার ব্যবহার অস্বাভাবিক হতে থাকে। আমরা হেমায়েতপুর চলে এসেছি। কয়েকজনের কাছে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল, পাবনা মানসিক হাসপাতালটা কোথায়? আমাদের গাড়িটা হাসপাতালের ফটকের সামনে এসে থেমেছে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাগলদের পাগলামি দেখছি। কেউ আজান দিচ্ছে, কেউ বকাবকি করছে, কেউ কেউ চুপচাপ বসে আছে, কেউ ...। আমি বাবাকে বললাম, ভাইয়াকে এখানে ভর্তি না করালে কি হয় না? বাবা খুব সাধারণ উত্তর দিয়েছিলেন, হ্যাঁ হয়। বাবা শুধু আমাদের কারো সমর্থন চাচ্ছিলেন। না, সেদিন ভাইয়াকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়নি। আমরা পাবনা শহরটা ঘুরে আপন শহরে ফিরে আসি। আসার পথে বাবার হাসি হাসি মুখ দেখে আমার কী যে ভালো লাগছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
ভাইয়া দেশের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। সক্রিয় বাম রাজনীতি বলতে যা বোঝায় তিনি তাই করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট আর রাজনীতির কল্যাণে দীর্ঘ সময়ে অনেকেরই প্রিয়ভাজন হতে পেরেছিলেন। শুধু চুশূল হয়েছিলেন একটি বিশেষ গোষ্ঠীর। শেষে তাদেরই মানসিক আর শারীরিক নির্যাতনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। আমি তখন মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করছি। অবশেষে দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদল্যালয়ে মোটামুটি বিষয়ে ভর্তির সুযোগও পেয়ে যাই।
কিন্তু পারিবারিক বিধিনিষেধের কারণে অবশেষে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। রাজনীতিতে কখনো জড়াব না- মায়ের কাছে দেওয়া এই প্রতিশ্র“তির কারণে সক্রিয় রাজনীতিতে আসিনি। কলমটাকেই ভালোবেসে নতুন হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছিলাম। সেখানেও বাধা! পত্রিকার খোলা কলাম আর অভিমত কলামে টুকটাক লিখতে শুরু করি। না, প্রচারের জন্য নয়, শুধু মনের তাগিদেই লিখতাম।
অনেক আগে ভাইয়া আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। এখনো খুব যতেœ আমি চিঠিটা রেখে দিয়েছি--
“কেমন আছিস রে তুই ?
তুই তো বিজ্ঞানের ছাত্র তাই তোকে জিজ্ঞেস করলাম।
আজ অনেক দিন যাব? ভাবছি।
আচ্ছা বাঁদুড় দিনে চোখে দেখে না কেন?
আর রাতেই বা কীভাবে দেখে? তাড়াতাড়ি উত্তর দিস।
আমি এ নিয়ে বিশেষ চিন্তার মধ্যে আচ্ছি।
ইতি...।
২৭ বছরের একজন যুবক বাচ্চা ছেলের মতো আমাকে প্রশ্ন করে চিঠি লিখেছে, আর সে আমার ভাইয়া আমি উত্তর দিতে পারিনি। সবার আগোচরে চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে। সেদিন একটিবারের জন্যও আমার চোখের জল থামাতে চেষ্টা করিনি, আমি কেঁদেছি শুধু আমার পাগড় ভাইয়ার জন্য।
অনেকদিন পর ভাইয়ার সেই কথাগুলো আবার মনে পড়ছে। মাঝখানে সুস্থ ছিলেন। তখন বিয়েও করেন তিনি। ভালোই ছিলেন। আবার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলায় ডিভোর্স হয়ে যায়। তারপর আবার সুস্থ হলেও বাচ্চাটার জন্য এখন পাগল প্রায়।
ও হে ওর মেয়ে নুসরাত। হেভি ট্যালেন্ট।
এখনও আমার সবচেয়ে বড় এবং প্রিয় ভাইটার এই অবস্থার জন্য ঘুমাতে পারি না। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে একটা টং দোকানে বসে থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মনে করি।
সে সময় টং দোকান থেকে দেখতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসগুলো চলে যাচ্ছে। আমার আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া নিষেধ। তখন নীরবে চোখ ভিজে আসতো। আমি একা! আমার আগে-পিছে কেউ ছিল না। বন্ধু! তারা সব লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। আমি অস্পৃশ্য! অনেক পথ পেরিয়ে আমি আবারও সেই শুরুতেই ফিরে যাচ্ছি।
শুধু এবারের চরিত্র আর মঞ্চটা ভিন্ন। কাহিনী সেই একই। শুধু ব্যবধান ছয় বছর।
আলোচিত ব্লগ
চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।
ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন
=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।
আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?


৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।